জরাজীর্ণ লিগে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কঠিন বাস্তবতার ছবি

Dhaka Premier League 2025

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে হতাশাজনক পারফর্ম করে দেশে ফিরে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা খেলতে নামছেন দেশের একমাত্র স্বীকৃত ৫০ ওভারের আসর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে। এই লীগটিকে এখন জৌলুসহারানো প্রায় বাতিল হয়ে পড়া কোন জমিদার প্রসাদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। যার এক বর্ণিল অতীত ছিলো, বিপুল আড়ম্বর ছিলো। যাকে ঘিরে ছিলো মানুষের কোলাহল। এখন একটা কাঠামো আছে বটে তবে তা খোদ ক্রিকেটারদেরই খুব একটা দোলা দিচ্ছে না।

ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের শীর্ষ লিগ ঘিরে আশি, নব্বুই দশকে যে উন্মাদনা ছিলো নানান কারণেই বেশ কয়েক বছরে ধরে তা নেই। তবে দেশের সব সেরা ক্রিকেটারের পাশাপাশি বিদেশিদের অংশগ্রহণে একটা মান ছিলো বলা চলে। বাংলাদেশ ওয়ানডেতে এক সময় সমীহ জাগানিয়া দল ছিল বলা হয় ক্লাব ক্রিকেটের শক্ত ভিতের কারণেই। সাম্প্রতিক সময়ে সেই মানেও লেগেছে আঘাত, প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজ এখন অনেকটাই ম্লান। যার প্রভাব আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পড়ছে বলে মনে করেন সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক ওয়ানডে আসরে বাংলাদের ব্যর্থতা দিচ্ছে তার প্রমাণ।

বাকি সব ঘরোয়া আসর থেকে প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটারদের কাছে বিশেষ গুরুত্বের ছিলো পারিশ্রমিকের কারণে। দেশের বেশিরভাগ ক্রিকেটারের রুটিরুজি এই আসর। ৩ মার্চ থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন আসরে সেই মৌলিক জায়গাতেও লেগেছে বড় ধাক্কা।

কোন কোন ক্লাব এবার পারিশ্রমিক কমিয়ে ফেলেছে অর্ধেকেরও বেশি। গত বছরের তুলনায় সব ক্লাবেরই পারিশ্রমিক নেমে গেছে অর্ধেকে। ৫০ হাজার টাকার পারিশ্রমিকেও লিগ খেলতে বাধ্য হচ্ছেন কিছু ক্রিকেটার। ধানমন্ডি স্পোর্টস ক্লাবের (গত আসরের শেখ জামাল ধানমন্ডি) প্রধান কোচ সাবেক জাতীয় অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল দ্য ডেইলি স্টারকে তুলে ধরলেন বাস্তবতা, '৩০ লাখের খেলোয়াড় খেলছে ৫-৭ লাখে। যে দল আগের বছর ৫ কোটি টাকা খরচ করে দল করেছে, এবার তারা দুই কোটি টাকায় দল করছে। তিন কোটি টাকা কম খরচ করলে পারিশ্রমিক তো কম হবেই।'

প্রতিবছর গরমের মৌসুমে আয়োজিত হয় এই লিস্ট-এ আসর। বৃষ্টি মৌসুম শুরুর আগে শেষ করার তাগদা থাকে বলে সূচি হয় ঠাসা, আবার ঢাকার বাইরের ভেন্যুতে খেলার কারণে খেলোয়াড়দের ভ্রমণ ঝক্কিও হয় বিড়ম্বনার। বিসিবি তৃপ্ত শুধু লিগ আয়োজন করতে পেরে, এর ভেতরে প্রাণ আছে কিনা তা নিয়ে তারা ভাবিত নয়। আশরাফুলের মতে নির্দিষ্ট কোন স্বপ্ন বা তাড়না ছাড়াই শুধু করার জন্যই এই লীগ মাঠে নামানো হচ্ছে,  'এরকম টুর্নামেন্ট করার জন্য করলে তো হবে না। একদিন খেলে, একদিন বিশ্রাম এরপরের দিন আবার খেলবেন। এভাবে কোন উন্নতি হবে না। আমরা শুধু করার জন্য করি আরকি সব কাজগুলো। ডেভোলাপ করার জন্য কোন কিছু না। ডেভোলাপ করতে হলে আরও সুন্দরমতন পরিকল্পনা করে এগুতে হবে। তাছাড়া অনেক দূরের ভেন্যুতে গিয়ে খেলতে হয়। বিকেএসপিতে আপনি ফজরের নাম পড়ে রওয়ানা দিলেন। এখন তো রোজার মাস, সেহরি খেয়েই অনেকটা রওয়ানা দেওয়া হবে। না ঘুমিয়ে খেলবেন। খেলার পর আবার ৫ ঘণ্টা জার্নি করে আসবেন। এভাবে সম্ভব না (মান সম্পন্ন খেলা)। কেবল খেলতে হবে খেলবে সবাই।'

নব্বুই দশকে জৌলুসময় সময়ে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসরে খেলেছেন আমিনুল। আবাহনী, মোহামেডান কিংবা বিমানের খেলায় যখন গ্যালারি থাকত ভরপুর, মানুষের উন্মাদনা ছিলো বিপুল। আমিনুলের মতে ক্লাব ক্রিকেটের সেই জৌলুস পুঁজি করেই বাংলাদেশের ক্রিকেট এতদূর এসেছে। টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আবির্ভাব, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যস্ততা মিলিয়ে দর্শক গ্যালারি ফাঁকা থাকার একটা বাস্তব স্বাভাবিক কারণ বোঝা যায়। তবে খেলার মান একটা ধাপে ছিলো বলে ওয়ানডেতে একটা শক্তি হতে পেরেছিলো বাংলাদেশ।

সেই মান কমেছে একাধিক কারণে। জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের সব সময় না পাওয়া, গত দুই মৌসুম থেকে বিদেশি খেলোয়াড় অনুমোদন না করার পাশাপাশি ক্লাব রাজনীতিও রেখেছে নেতিবাচক ভূমিকা।  ক্লাব রাজনীতির মরপ্যাঁচের দলগুলোর ভেতর ভারসাম্যহীনতায় লড়াই সীমিত হয়ে পড়ছিল অল্প কিছু দলের ভেতর। প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘাটতি ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এখন এমন একটা জায়গায় খেলার ফল নিয়ে খোদ ক্রিকেটারদেরই আগ্রহে পড়েছে ভাটা।

আমিনুল মনে করেন একটা দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের ছবিই ফুটে উঠবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে, বাংলাদেশ সেই বাস্তবতারই মুখোমুখি,  'একটা দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের চেহারাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চেহারাই আসলে। আমাদের তিনটা যদি ইভেন্ট দেখেন, প্রথম শ্রেণী, বিপিএল আর ডিপিএল। প্রথম শ্রেণীতে ওইভাবে প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ হয়ও না। বিপিএল আমাদের টি-টোয়েন্টির প্রস্তুতি। আর ৫০ ওভারের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, লিস্ট-এ ক্রিকেট একমাত্র। তিনটা টুর্নামেন্ট দিয়ে আমাদের তিনটা জাতীয় দল। এরমধ্যে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে। এরমধ্যে যদি আকর্ষণ তৈরি করতে না পারি তাহলে তো আপনি টেবলেট খাইয়ে খেলোয়াড় বানাতে পারবেন না। '

'যে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট যত প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ হয় তারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তত প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ দল হয়ে উঠে। ঘরোয়া ক্রিকেটে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজ না থাকে তাহলে জাতীয় দলে কীভাবে আশা করেন। খেলোয়াড়গুলো তো আর অন্য গ্রহের না। এটা সহজ অঙ্ক। আমরা আল্টিমেট চেহারা দেখি জাতীয় দলে। এগুলো কাজ না করলে জাতীয় দলে কীভাবে ফল আশা করেন।'

আইসিসির গেম ডেভলাপমেন্টের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করা আমিনুলের শঙ্কা বিসিবি এখনি এসব দিক না দেখলে পেছনের দিকে যাবে দেশের ক্রিকেট,   'আমার মনে হয় ক্লাবগুলোর উপর ছেড়ে দিলে হবে না। সবাই মিলে এটাকে ঠিক করার দিকে মন দিতে হবে। বাংলাদেশের ক্রিকেট যারা চালাচ্ছেন এখন তাদের এই জায়গায় মনযোগী হওয়া উচিত। না হলে আমরা পেছনের দিকে যাব। '

'চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আমরা দেখলাম কী পরিমাণ ডট বল খেলি আমরা। আমাদের জেনুইন স্পিনার দলে থাকে না। এগুলো উন্নত হবে যদি ৫০ ওভারের অনেক খেলা হয়। চার-পাঁচটা দলের ভেতর তীব্র লড়াই থাকে।'

সম্প্রতি সাদা বলের ক্রিকেটে নতুন পরাশক্তি হয়ে উঠছে আফগানিস্তান। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে তারা। আফগানিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামো বিনির্মাণে আইসিসির হয়ে কাজ করেছেন আমিনুল। উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখান সেখানকার ৫০ ওভারের আসরে খেলোয়াড় বের করা হয় জাতীয় দলের ঘাটতি বিবেচনায়, 'আফগানিস্তানে ঘরোয়াতে অনেকগুলো ৫০ ওভারের টুর্নামেন্ট হয়। তাদের ডটবল সমস্যা কমাতে উদ্যোগী নিয়েছে এভাবে- যার স্ট্রাইকরেট ৮০'র উপরে থাকবে তাকেই তারা পরের ধাপে নিয়ে আসবে। ৫০ ওভারের খেলায় যার স্ট্রাইকরেট একশোর উপর থাকবে তাকে তারা পয়সা দিয়ে ইনসেন্টিভ দেয়।'

Comments

The Daily Star  | English
Amir Khasru Mahmud Chowdhury

People didn't sacrifice to give responsibilities to any 'Great Man': Amir Khasru

"Whichever government is elected by votes will be accountable to the people"

1h ago