বাংলাদেশের ক্রিকেটে ফের সামনে এলো লিঙ্গ বৈষম্য

গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা দেশের দুটি শীর্ষ ক্রিকেট সংস্থা – বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এবং ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) – থেকে চরম অবহেলার শিকার হয়েছেন। দুটি ভিন্ন ঘটনায় এই অবহেলা স্পষ্ট হয়েছে।
গত এপ্রিলে নারী দল আইসিসি নারী বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনের পর থেকে তাদের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক সিরিজ আয়োজন করতে ব্যর্থ হয়েছে দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিসিবি।
এর ফলে নিগার সুলতানা জ্যোতির দল আগামী মাসে কোনো ম্যাচ অনুশীলন ছাড়াই ভারতে বিশ্বকাপ খেলতে যাবে। সমাধান হিসেবে এই মাসে বিকেএসপিতে নারী দলের জন্য অনূর্ধ্ব-১৫ পুরুষ দলের বিপক্ষে কয়েকটি অনুশীলন ম্যাচের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এদিকে আগামী ৪ সেপ্টেম্বর আসন্ন নির্বাচনের আগে কোয়াব সম্প্রতি কয়েকটি সভা করেছে, যেখানে অনেক বর্তমান ও প্রাক্তন পুরুষ ক্রিকেটার উপস্থিত থাকলেও কোনো নারী ক্রিকেটারকে দেখা যায়নি।
বিসিবির এই অবহেলা নারী ক্রিকেটারদের জন্য হতাশাজনক হতে পারে, তবে এটি অবাক করা নয়। কারণ পুরুষ ও নারী ক্রিকেটের মধ্যে সমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিসিবি বিশ্বমানের চেয়ে অনেকখানি পিছিয়ে।
বর্তমানে ভারত, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা পুরুষ ও নারী ক্রিকেটারদের একই ম্যাচ ফি দেয়। অন্যান্য দেশও এই লক্ষ্যে কাজ করছে। অথচ বাংলাদেশে পুরুষ ও নারী দলের মধ্যে বেতনের বিশাল ব্যবধান রয়ে গেছে এবং এটি কমানোর বিষয়ে তেমন কোনো আলোচনাও নেই।
তবে কোয়াবের অবহেলা নারী ক্রিকেটারদের জন্য আরও বেশি অপমানের কারণ হওয়া উচিত। কারণ বিসিবির মতো নয়, এই সংস্থাটি ২০০৪ সাল থেকে ক্রিকেটারদের দ্বারা ক্রিকেটারদের জন্য পরিচালিত হচ্ছে। সুতরাং তাদের মিটিংয়ে আমন্ত্রণ না জানানো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে এই সংস্থার কাছে অথবা অন্তত যারা এটি পরিচালনা করছেন, তাদের কাছে নারী ক্রিকেটাররা গুরুত্বহীন।
নারী দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি শুক্রবার সকালে ফেসবুকে এক পোস্টে পোস্টে এই অবহেলাকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, 'একজন ক্রিকেটার এবং একজন নারী ক্রিকেটারের মধ্যে পার্থক্য আছে, বন্ধু।'
এরপর অলরাউন্ডার রুমানা আহমেদ আরও বিস্তারিত একটি পোস্টে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, 'সম্প্রতি কোয়াব নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। অনেক পুরুষ ক্রিকেটারকে জড়িত থাকতে দেখা গেলেও একজনও নারী ক্রিকেটারকে দেখা যায়নি। তাহলে আমরা কোথায় আছি?'
দ্য ডেইলি স্টার যোগাযোগ করলে রুমানা জানান যে তাদের কোয়াবের কোনো মিটিংয়ে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণও জানানো হয়নি, 'কোয়াব কীভাবে কাজ করে সে বিষয়ে আমরা এখনও স্পষ্ট নই। কয়েক দিন আগে তারা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, কিন্তু আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আসলে আমাদের নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি... এটা নারী ক্রিকেটারদের মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন। আমার ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে আমি এর অভাব অনুভব করছি।'
তিনি আরও জানান যে তিনি আসন্ন কোয়াব নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন কিনা সে বিষয়েও তিনি নিশ্চিত নন।
কোয়াবের আহ্বায়ক সেলিম শাহেদের মতে, বিসিবির চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটাররা বার্ষিক ফি দিয়ে সংস্থার স্থায়ী সদস্য হতে পারেন এবং নারী ক্রিকেটাররা আবেদন ও ফি জমা দিলে পরবর্তী নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন। তারা ১,০০,০০০ টাকা এককালীন ফি দিয়ে আজীবন সদস্যপদও পেতে পারেন।
গত ৩০ জুন মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া নারী দলের শেষ চুক্তিতে ১৮ জন কেন্দ্রীয় চুক্তিতে এবং আরও ৩০ জন জাতীয় চুক্তিতে ছিলেন।
এদিকে কোয়াবের এইসব সভায় উপস্থিত থাকা পুরুষ ক্রিকেটার মোহাম্মদ মিঠুন দাবি করেন নারী ক্রিকেটারদের এই ক্ষোভ ভুল বোঝাবুঝির ফল, 'আমাদের এখন একটি অ্যাড-হক কমিটি আছে। যেকোনো মিটিংয়ের জন্য খেলোয়াড়দের আমন্ত্রণ জানানো তাদের দায়িত্ব। অ্যাড-হক কমিটি আমাদেরও আমন্ত্রণ জানায়নি। আমরা নিজেদের ইচ্ছেতেই সেখানে গিয়েছিলাম।'
'আমি মনে করি এটা একটা ভুল বোঝাবুঝি। যেহেতু তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন না, তাই তারা কী ঘটছে তা জানতেন না। সুতরাং, আমি মনে করি এটি একটি আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া।'
এই ঘটনাকে আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হোক বা সমতার জন্য একটি আকুতি হিসেবে দেখা হোক, এই সমস্যার দ্রুত সমাধান করা উচিত।
এই নারী ক্রিকেটাররা ২০১৮ সালে এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। যা পুরুষ ক্রিকেটাররা আজও পারেননি। সংকট সমাধান না করলে এই ক্রিকেটাররা অবহেলিত এবং কোণঠাসা বোধ করতে থাকবেন।
Comments