শুবমান গিল: তিনি জানেন কথা কীভাবে রাখতে হয়

ছোট্ট কাকার হাতটা শক্ত হয়ে যাচ্ছে, নড়ছে না যেন! চুলগুলো ধুলোয় ধূসর হয়ে গেছে! মাথা বেয়ে বেয়ে ঘামের ফোঁটা হাতে পড়তেই কাকার মনে হলো, ব্যাট ধরা ঠিক আছে তো! পাঁচ বছরের কাকা তাকিয়ে দেখলো, বাবা দাঁড়িয়েই আছেন, সুতরাং ব্যাট ধরা যে ঠিকই আছে, এটা নিশ্চিত।
কিন্তু তার তো আর ইচ্ছে করছে না! এই না-ইচ্ছের মধ্যে হুট করে যদি আউট হয়ে যাই! ভাবতেই, তার হাতের সব আড়ষ্টতা কেটে গেল। না, না। তার আউট হওয়া যাবে না! সে মাকে কথা দিয়ে এসেছে, বাড়ি ফিরে ১০০ টাকা মাকে ফেরত দেবে।
খেত থেকে ফসল কেটে নেওয়ার পর বাবা এই জায়গায় আর চাষ করেননি। এখানে তিনি কাকার জন্য অনুশীলনের একটা জায়গা বের করেছেন। ফসল না থাকার কারণে জায়গাটা ধূসর, আর প্রতিটা বলের আঘাতে রোজ জায়গাটি ধুলোয় ধূসরিত হয়ে উঠে।
ছোট্ট কাকার প্রথমে বেশ ভোগান্তিই হয়েছিল, এখন সে অভ্যস্ত। শুধু অভ্যস্তই না, সে উপভোগও করে! চুলগুলো যে দাদার মতো সাদা হয়ে যায়, এটা তার বড্ড পছন্দের। দাদা অশ্বত্থ গাছের কাঠ দিয়ে তার মাপের ছোট একটা ব্যাট তৈরি করে দিয়েছেন। এটা দিয়েই সে অনুশীলন করে। গ্রামের আশেপাশের ছোট-বড় সবাই এসে এসে পালাক্রমে তাকে বল ছুঁড়ে দেয়, আর সে ব্যাট চালায়। সবাই জানে কাকাকে বোল্ড আউট করতে পারলেই ১০০ টাকা পাওয়া যাবে! এটা বাবার ঘোষণা! আর এখানেই বেধেছে বিপত্তি! তার তো আউট হওয়া যাবেই না। এজন্যই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় প্রতিদিন তাকে তার মার কাছে কথা দিয়ে আসতে হয়, সে এসে এই টাকা মাকে ফেরত দেবে! আর মাকে দেওয়া কথা তো রাখতেই হবে। না হলে আলু পরোটা মা দেবে না!
বেশ কয়েক বছর পর বাবা তাকে শহরের একটা ক্রিকেট একাডেমিতে আনলেন। বাবার বাহিরে এই প্রথম তার খেলা অন্য অপরিচিত একজন দেখবেন, এটা ভেবে কাকার মনটা অস্থির হয়ে উঠছে। বাবার কাছে যেতেই তিনি বললেন, 'প্রতিটা বল ব্যাটের মিডলে লাগাবি, বাবা। আর সবসময় যে বল খেলবি, সেটার কথাই চিন্তা করবি—তার আগের, বা পরের বল নিয়ে না।'
বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাকা বললো, 'বাবা, সন্ধ্যায় এসে স্যারের থেকে শুনবে যে, ওরা আমাকে আউটই করতে পারেনি!' বাবা আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। অজানা আশঙ্কায় বুকের ধুকধুকের আওয়াজ বাড়তেই থাকলো! অনুশীলনে এসে ১২ বছরের কাকা হতভম্ব! এরা কেউই তার সমান না—অনেক অনেক বড়! এদের বল কাকা কী করে খেলবে! কিন্তু সে যে বাবাকে কথা দিয়েছে, সে আউট হবে না!
সন্ধ্যায় বাবা যখন আসলেন, স্যার তাকে বললেন, 'ওহে মশাই, আমরা তো তোমার পুঁচকে ছেলেকে আজ আউটই করতে পারলাম না। কাল আবার চেষ্টা করবো।' বাবার চোখ ভর্তি পানি! কাকা দৌড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো, 'বাবা, আমি ভাইয়াদের প্রায় সব বলই ব্যাটের মিডলে লাগিয়েছি। দু-একটা মিস হয়েছে! কাল আর হবে না। প্রমিজ! আউট কিন্তু হয়নি, বাবা!' বাবা তার পকেট থেকে এক মুঠো হাজমলা ক্যান্ডি বের করে দিলেন। কাকার সবচেয়ে পছন্দের চকলেট।
'কাকা' পাঞ্জাবি শব্দ, যার অর্থ 'বাবু'। ভারতীয় ক্রিকেটের টেস্ট দলের বর্তমান ও ক্রিকেটের নতুন প্রিন্স শুবমান গিলকে তার মা এই নামেই ডাকেন। হ্যাঁ, উপরের ছোট্ট 'কাকা'ই আজকের শুবমান গিল। কথা দেওয়া এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে, সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে সেটাকে রক্ষা করার উপলব্ধি, ভিতটা গিল সেই শৈশবেই আত্মস্থ করেছিলেন।
গতকাল গিলকে এশিয়া কাপের ১৫ সদস্যের ভারতীয় দলের সহ-অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। আগের সহ-অধিনায়ক অক্ষর প্যাটেলকে বদলে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি খেলা গিলকে এই দায়িত্ব দেওয়াতে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।
এর উত্তরে টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব গতকাল সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করে বলেন, 'ভারতের হয়ে শেষবার সে টি-টোয়েন্টি খেলেছিল যখন আমরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়েছিলাম। তখন আমি অধিনায়ক ছিলাম, সে ছিল সহ-অধিনায়ক। সেখান থেকেই আসলে আমরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের নতুন চক্র শুরু করি। এরপর থেকে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে টেস্ট সিরিজগুলোতে। তাই সে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়নি, কারণ সে টেস্ট ক্রিকেট আর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ব্যস্ত ছিল। এখন সে দলে আছে এবং সবাই তাকে দলে পেয়ে খুশি।'
আসলেই কি তাই? নাকি তার উত্থান-পর্ব লেখা হয়েছে ইংল্যান্ডে সদ্য শেষ হওয়া অ্যান্ডারসন-টেন্ডুলকার ট্রফিতে?
দুর্ঘটনাক্রমে 'দলনেতা'
কিন্তু এই প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন তিনি টেস্ট ক্রিকেটে রাখতে পারছিলেন না। ২০২০ সালে টেস্টে অভিষেক হওয়া গিল ৩২ ম্যাচে মাত্র ৩৫.০৬ গড়ে করেন এক হাজার ৮৯৩ রান। দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় তার রানের সংখ্যা ৫১৪। এই চার দেশে তিনি মোট ২১ ইনিংসে মাত্র ২৫.৭ গড়ে রান করেছেন।
ইংল্যান্ডের মাটিতে তার টেস্ট পারফরম্যান্স আরও দুর্বল। এখানে ছয় ইনিংসে করেছেন ৮৮ রান—ব্যাটিং গড় মাত্র ১৪.৬৬। ইংল্যান্ডের মাটিতে তার সর্বোচ্চ স্কোর মাত্র ২৮ রান। সেরা একাদশে জায়গা পাওয়াটাই তার জন্য অসাধ্য হয়ে যাচ্ছিল এবং বারবারই এটা প্রশ্নের মুখোমুখিও হচ্ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র তার বয়সভিত্তিক আর ঘরোয়া ক্রিকেটের অতীত বিবেচনায় ভারতীয় ক্রিকেট মহল তার মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে থাকা প্রতিভাকেই পাঠ করছিলেন। ক্রিকেটের 'ঈশ্বর' শচীন টেন্ডুলকার এবং 'রাজা' বিরাট কোহলির একমাত্র উত্তরসূরি হিসেবেই তাকে বিবেচনা করছিলেন।
কিন্তু কতদিন? এভাবে বিনা পারফরমেন্সে আর কতদিন দলে জায়গা পাবেন? পাশাপাশি এই প্রশ্নগুলোর আওয়াজও বাড়ছিল।
চলতি বছর ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) চলাকালীন হঠাৎই টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেন ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা এবং এর কিছুদিন পর কোহলি। পাঁচ টেস্টের ইংল্যান্ডের সিরিজ শুরু হওয়ার কিছুদিন বাকি থাকতে তাদের এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় ক্রিকেটকে বড় প্রশ্নের মুখে ফেলে—টেস্ট দলের হাল ধরবেন কে? কে হবেন কান্ডারী? কার হাতে এই নতুন, তরুণ, অনভিজ্ঞ একটা দলকে ছাড়বেন?
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রথম ও একমাত্র পছন্দ জাশপ্রীত বুমরাহ। তিনি দলের সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছিলেন, আবার বিগত বছরের অস্ট্রেলিয়া সফরের একমাত্র জয়টাও এসেছে রোহিতের অনুপস্থিতিতে বুমরাহর অধিনায়কত্বে। কিন্তু সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষের পাঁচ টেস্টের সিরিজের শেষ ম্যাচটিতে বুমরাহ খেলাচলাকালীন মারাত্মক ইনজুরিতে পড়েন। সেই টেস্টে তিনি আর বল করতে পারেননি। এরপর থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্ট বিবেচনায় তিনি বেছে বেছে খেলা শুরু করেন।
স্বাভাবিকভাবেই তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় এবং তার ইচ্ছে অনুযায়ী, তাকে অধিনায়ক না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দলের অভিজ্ঞ খেলোয়াড় ৩৩ বছরের লোকেশ রাহুল থাকলেও তার বয়স বিবেচনায় নিয়ে বিসিসিআই তাকেও আর চাচ্ছিলেন না। আবার ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়া রিশাভ পান্তের শারীরিক ফিটনেসও খুব একটা ভালো না। পুরো পরিস্থিতি বিবেচনায় একমাত্র গিল ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না।
কিন্তু গিলের কাছে অধিনায়কত্বের অভিজ্ঞতা বলতে শুধু আইপিএলের বিগত দুই মৌসুম, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের একটা টি২০ আন্তর্জাতিক সিরিজ, আর ঘরোয়া খেলায় পাঞ্জাবকে নেতৃত্ব দেওয়া।
সারমর্ম হলো, ৩২ টেস্ট খেলে ফেলা গিলের পরিসংখ্যানগত রেকর্ড ভালো না, ব্যাটিং গড় ভালো না, অধিনায়কত্বের অভিজ্ঞতাও নেই। প্রশ্ন আসা খুবই স্বাভাবিক, যেই ফরম্যাটে সে এখনো নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি, সেখানে তাকে পুরো দলের দায়িত্ব দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
কিন্তু বিকল্প কোথায়? পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে গিলকেই ঘোষণা করা হয় ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের ৩৭তম কান্ডারী। এ যেন দুর্ঘটনাক্রমে অধিনায়কত্ব পাওয়া। কিন্তু এটা কী নিতান্তই দুর্ঘটনা?
'ক্রিকেট মস্তিষ্ক', 'পরিকল্পনা', 'বাস্তবায়ন' ও 'পরিস্থিতি-পাঠক'
ক্রিকেট জ্ঞান ছাপিয়ে কিছুটা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ধারক গিল আসলে কেমন খেলে, কিংবা তার বিশেষত্ব কী—এই প্রশ্নটার উত্তরে প্রায় ক্ষেত্রেই তার ক্রিকেটীয় দক্ষতা ছাপিয়ে ক্রিকেট-সম্পর্কিত জ্ঞান, মানসিক দক্ষতার বিষয়টাই বেশি শোনা যায়। তার 'ক্রিকেটের মস্তিষ্ক', 'পরিকল্পনা', 'সেটা বাস্তবায়ন' ও 'পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া'—তার ক্যারিয়ার ব্যাখ্যায় সবচেয়ে ব্যবহৃত চারটা বিশেষণ।
২০২১ সালে ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্ট খেলতে নেমে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তার ৯১ রানের ইনিংসের কথা ভুলবার নয়। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজের শেষ টেস্টে ভারতের সামনে ৩২৮ রানের টার্গেট রেখেছিল তারা। গাব্বার এই টেস্টের কথা হলে প্রত্যেকে পান্তের কথা বললেও এই টেস্টে গিলের ইনিংসও একই সমান্তরালে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তৎকালীন ভারতের ব্যাটিং কোচ বিক্রম রাঠোর সেই ৯১ রানের দুর্দান্ত ইনিংসের আগে গিলের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি সেটা পরে একটা সাক্ষাৎকারে বলেন। 'আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী ভাবছো? ওরা তো তোমাকে শর্ট বল করতে চাইছে। সে বলেছিল, যদি শর্ট বল আসে, আমি অন্য প্রান্ত থেকে পুল করব না, কিন্তু যদি স্টার্কের প্রান্ত থেকে আসে, তাহলে করব—কারণ আমি নিশ্চিত, বেশিরভাগ সময় আমি ওই বাউন্ডারি পার করতে পারব। যদি বল কাঁধের নিচে থাকে, আমি নিচে খেলব; যদি ওপরে থাকে, আমি উপরে মারার চেষ্টা করব। আর যদি এই পাশে (অন সাইডে) হয়, আমি ছেড়ে দেব। আর যদি ওই পাশে (অফ সাইডে) হয়, তাহলে হয়তো একটা আপার কাট খেলব।'
ভিন্ন ভিন্ন মুহূর্তকে বোঝা, সেই মুহূর্তের পরিস্থিতিকে পাঠ করা, সেই পাঠ অনুযায়ী তার নিজের খেলাকে পরিচালনা করার মানসিক দক্ষতা তার অসাধারণ ব্যাকফুট টেকনিক, কিংবা নিখুঁত শর্ট-আর্ম জ্যাব খেলার নিয়ন্ত্রণকেও টেক্কা দেয়। সুতরাং, এটা বলাই যায়, অধিনায়কত্ব কখনোই তার কাছে 'দুর্ঘটনাক্রমে' আসেনি।
প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন
কিন্তু ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ২৮ রান করা ১৪.৬৬ গড়ের একজন ব্যাটসম্যানের কাছে 'অধিনায়কত্ব'র সংযোজনকে আসলে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? গিলকে কেন্দ্র করে, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের চারটা গুণকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র কিছু আশা আর বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে ভারতের একটা তরুণ দল তার হাতে তুলে দেওয়া হয়।
গত ২০ জুন লিডসে প্রথম টেস্টে নামার আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে গিল যেন ফিরে গেলেন তার শৈশবের দিনগুলোতে—যখন ১০০ টাকা তার মাকে ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি করেছেন, কিংবা বাবাকে তারচেয়ে দ্বিগুণ বয়সী পেস বলারদের সামনে দাঁড়াবার আগে 'আউট না হওয়ার' প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি কী সেই সময়ের মধ্যে বিভোর হয়ে পড়েছিলেন? সম্ভবত তাই-ই!
এবার তিনি সেই প্রতিশ্রুতি দিলেন তার দিকে তাকিয়ে থাকা প্রায় দেড়শ কোটির অধিক ভারতীকে। দুরু দুরু বুকে যেন কয়েকবার শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে সমস্ত অস্বস্তি একপাশে সরিয়ে রেখে তিনি বলেই ফেললেন, 'প্রতিপক্ষকে আধিপত্য দেখিয়ে এই সিরিজের সেরা ব্যাটসম্যান হতে চাই।'
পাঁচ টেস্টের ১০ ইনিংসে তার রান ছিল—লিডসে ১৪৭ (২২৭), ৮ (১৬), এজবাস্টনে ২৬৯ (৩৮৭), ১৬১ (১৬২), লর্ডসে ১৬ (৪৪), ৬ (৯), ওল্ড ট্রাফোর্ডে ১২ (২৩), ১০৩ (২৩৮) এবং ওভালে ১১ (৯), ২১ (৩৫)। সব মিলিয়েই তিনি সিরিজে ৭৫.৪০ গড়ে করেছেন ৭৫৪ রান।
বাবার সঙ্গে দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ বল মোকাবিলা করা পাঁচ বছরের গিল, অথবা দৈনিক আট ঘণ্টার অনুশীলন করা কিশোরটা যেন তার শৈশবকে, কৈশোরকে বিশ্বের সামনে খোলাসা করতে চেয়েছিলেন। লিডসে ভারতের পরাজয়ের পর নিজের ১৪৭ রানে আউট হয়ে যাওয়ার বিষয়টির জন্য তিনি অনুতপ্ত বোধ করছিলেন। কারণ, সেই পরিস্থিতিতে বল উঠিয়ে না মেরে ধীরস্থিরভাবে উইকেট টিকিয়ে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এরপর এজবাস্টনে অপরপ্রান্তে উইকেট পড়ে যেতে থাকলেও তিনি ছিলেন অনড়। সেঞ্চুরি করতে সেখানে বল খেলেন ১৯৯টা। তারপর ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে এক রানে দুই উইকেট পরে যাওয়ার পরে যে সময়টায় টিকে থাকাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেখানে তিনি শত রান করেন ২২৮ বলে।
ক্রিকেটের পরিসংখ্যান-সম্পর্কিত ওয়েবসাইট ক্রিকবাজের তথ্য অনুযায়ী, এই সিরিজে তার সর্বোচ্চ ২৬৯ রানের ইনিংসটি ছিল ইংল্যান্ডের মাটিতে বাহিরের যেকোনো খেলোয়াড়ের সবচেয়ে নিয়ন্ত্রিত সেঞ্চুরি, যেখানে তার ভুল শট খেলার হার সাড়ে তিন শতাংশ।
সেদিন ২৫ বছর বয়সী গিল যেন হয়ে উঠেছিলেন দৃঢ় কিশোর। যেই কিশোর বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাট করে বোলারদের ক্লান্ত করে তুলতেন। ১৪ বছরের গিল অমৃতসরের বিরুদ্ধে একটা আন্তঃজেলা ম্যাচে রেকর্ডসংখ্যক ৫৮৭ রানের উদ্বোধনী জুটিতে করেছিলেন ৩৫১ রান। কৈশোরের সেই দৃঢ় গিলকেই যেন আন্তর্জাতিক অঙ্গন নতুন করে আবিষ্কার করলো।
এজবাস্টনে গিল বল মোকাবিলা করেছিলেন ৩৮৭টি। তিনি ক্রিজে কাটিয়েছিলেন প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টা। একের পর এক রেকর্ড ভেঙে গড়ে তুলেছেন ভারতীয় টেস্ট অধিনায়কদের মধ্যে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।
তার চারটা সেঞ্চুরি ছিল ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচের, দলের প্রয়োজনে। পরিস্থিতি বিবেচনায় কখনো তিনি মারকুটো হয়ে খেলেছেন, কখনো ঠায় দাড়িয়ে থেকেছেন, কখনো এক রানে দুই উইকেট পরে যাওয়ায় খেলেছেন সবচেয়ে ধীর গতিতে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখা তার প্রতিটা ইনিংস যেন আমার কানে সৃষ্টি করে চলেছিল লুডোভিকো আইনৌদির 'এক্সপেরিয়েন্স' মিউজিকটির সুর। জীবনের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে পদার্পণের পর্যায়গুলোকে খুব শান্ত, ধীরস্থির, কিন্তু ধীরে ধীরে উন্মাদনার দিকে যাওয়া তাল, সুরের মূর্ছনাগুলোর মিউজিকটা যেন গিল মাঠে তার ব্যাট দিয়ে রচনা করছিলেন। তার প্রতিটা ইনিংসই যেন তার সবচেয়ে পছন্দের এই সুরটিই সৃষ্টি করছিল।
হ্যাঁ, তিনি এই সিরিজের 'সেরা ব্যাটসম্যান'। ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের পুরষ্কারটা তার হাতেই উঠেছে। তিনি কথা রেখেছেন। প্রায় দেড়শ কোটির ভারতীয়দের ছাপিয়ে তার এই প্রতিশ্রুতি ও প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন যেন বিশ্বের কাছেও পৌঁছে গেছে। শচীন টেন্ডুলকার, বিরাট কোহলির পর ক্রিকেট বিশ্ব মাঠে নতুন করে কারো পদচারণা অনুভব করলেন, মাত্র!
ক্রিকেটের জন্মস্থান ইংল্যান্ডেই যেন জন্ম হলো ক্রিকেটের নতুন 'প্রিন্সে'র। ক্রিকেটের সূতিকাগারই যেন সাক্ষী হয়ে থাকলো ক্রিকেটের নতুন 'প্রিন্সে'র শুরুর স্বাক্ষরের।
Comments