বিশ্বকাপ ট্রফি 'ডাকছিল' মেসিকে
হতে পারতো ২০০৬ সালেই। হয়নি সামান্য ভুলে। ২০১০ সালে হতাশায় ফেরা। ২০১৪ সালে তো ফাইনালে উঠে শেষ সময়ে গোল হজম করে ফের হতাশার গল্প। আর ২০১৮ সালে ভাঙাচোরা দলটি দ্বিতীয় রাউন্ডেই হারে ওই বারের চ্যাম্পিয়নদের কাছে। শেষ সুযোগটা ছিল ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে। ক্যারিয়ারের প্রায় শেষ দিকে লিওনেল মেসি। আর শেষেই পেলেন পূর্ণতা। অধরা বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখা হলো তার। তাতে পেয়েছেন অমরত্বের সনদপত্র।
সবমিলিয়ে শেষ কয়েকটি বছরে আর্জেন্টিনার হয়ে যেন সব স্বপ্নের মতো কেটেছে মেসির। আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের আক্ষেপের অবসান ঘটানোর পর গণমাধ্যমে খুব একটা কথা বলতে দেখা যায়নি। বিশ্বকাপ জেতার পর আগের দিন প্রথমবারের মতো সাক্ষাৎকার দিয়েছেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। আর্জেন্টাইন রেডিও স্টেশন 'উরবানা প্লেই'কে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।
বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা
আমি সবসময় সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই। আমি জানতাম তিনি আমাকে এটা উপহার দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন। আমি জানি না এটা কীভাবে টের পেয়েছি, তবে অনুভব করেছি। ঐ দিন থেকে আমরা নিজেদের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরিচয় দিতে পারি। অসাধারণ একটা দিন ছিল। আমি আমার পুরো ক্যারিয়ারে এমন একটা দিনের স্বপ্ন দেখে এসেছি। অবশেষে সেটা সত্যি হলো।
বিশ্বকাপে পরিবারের সঙ্গে কথোপকথন
প্রতি রাতের মতোই আমি ঘুমানোর আগে আন্তোনেলার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। এটা নতুন কিছু নয়। তবে আমরা ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে কথা বলিনি। আর পুরো বিশ্বকাপজুড়েই সবকিছু খুব শান্ত ছিল, ফাইনালের আগেও। একই সঙ্গে আমরা এই ট্রফি জয়ের চেষ্টা করছিলাম। ফাইনালের আগের রাতে আমার ঘুম খুব ভালো হয়েছিল। আমি একদমই চাপে ছিলাম না, খুব শান্ত ছিলাম।
সন্তানদের অনুপ্রেরণা
ওরা আর সব আর্জেন্টাইনদের মতোই, শুরুতে কষ্ট পেয়েছে, পরে আনন্দে ভেসেছে। নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে আমাদের জয়ের পরে থিয়াগো কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। সৌদি আরবের বিপক্ষে আমাদের পরাজয়ের পরে মাতেও আমাদের পরের রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভাবনা হিসাব করা শুরু করেছিল।
কোপা আমেরিকার পর বিশ্বকাপ জয়
আমার বিশ্বাস ছিল, স্রষ্টা এটা আমার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছিলেন, এবং এর চেয়ে ভালো আর কোনো কিছু হতে পারে না। আমি প্রতিনিয়ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, এর চেয়ে বেশি কিছু আমি চাইতে পারতাম না।
বিশ্বকাপ ট্রফিতে প্রথম চুমু
আমি যখন মঞ্চে উঠলাম, ঝলমলে স্টেডিয়ামে ট্রফিটা জ্বলজ্বল করছিল। যেন আমার দিকে তাকিয়ে বলছিল, 'এসো, আমাকে জড়িয়ে ধরো। এরপর আমি আর বেশি কিছু ভাবার চেষ্টা করিনি।'
বিশ্বকাপ জয়ের আগে সমালোচনা
জাতীয় দলের জার্সিতে এত দিন ধরে এত কষ্টের পরে, এতবার ফাইনালে পরাজয়ের হতাশার পরে, এত কাছে গিয়েও ট্রফি ছুঁয়ে দেখতে না পারার পরে, আমাকে অনেক বেশি সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। আমার পরিবারও এই ব্যাপারগুলো সহ্য করেছে, কখনো কখনো আমার চেয়ে বেশি। প্রথমে কোপা আমেরিকা, এবং এরপর বিশ্বকাপ জয়ের পরে এই সমালোচনাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সব শান্ত।
টাইব্রেকারের শেষ শট
ঐ মুহূর্তে আমার মধ্যে যা চলছিল, সেটা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। অনেক কিছু ঘুরছিল মাথায়, মনে হচ্ছিল আনন্দের আতিশয্যে ফেটে পড়ব। আবার একইসঙ্গে অবিশ্বাসও কাজ করছিল, আমরা আসলেই জিতে গিয়েছি! তবে পুরোটা সময় জুড়ে আমি স্রষ্টাকে স্মরণ করছিলাম। খুব করে চাইছিলাম, যেন মন্তিয়েল গোল করতে পারে, আর আমাদের দুঃখগুলো দূর হয়ে যায়।
বিশ্বকাপের কঠিনতম ম্যাচ
আমার মতে, মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচটা আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিল। এছাড়া প্রতিটা ম্যাচেই আমরা আমাদের প্রতিপক্ষের চেয়ে ভালো খেলেছি, কারণ আমরা সবসময়ই আমাদের করণীয় সম্পর্কে ভালোভাবে জানতাম। আমাদের কোচিং স্টাফরাও আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন।
নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের প্রতিক্রিয়া
ঐ সময়ে আমি অনেক বেশি আবেগতাড়িত ছিলাম। এটা অবশ্যই পূর্বপরিকল্পিত কিছু ছিল না। আমাকে কয়েকজন খেলোয়াড় ম্যাচের আগে জিজ্ঞেস করেছিল যে, লুইস ফন হালের মন্তব্য আমি শুনেছি কি না (হাসি)। আর ভেগহর্স্টকে বলা কথাটার ব্যাপারে আমি আসলে নিজের এই রূপটা প্রকাশ্যে আনতে পছন্দ করি না, কিন্তু এটা এভাবেই এসে গেছে। ঐ ম্যাচে অনেক বেশি চাপ ছিল।
ইনস্টাগ্রামে সর্বাধিক লাইকপ্রাপ্ত ছবি
আমি ভাবিনি যে এই ছবিটা ইনস্টাগ্রামে সবচেয়ে বেশি লাইক পাবে। তবে এটা থেকে প্রমাণ হয় যে, কত বেশি মানুষ আমার হাতে ট্রফিটা দেখতে চেয়েছে।
শুভেচ্ছাবার্তা
এত বেশি শুভেচ্ছাবার্তা এসেছিল যে, আমি আমার ইনস্টাগ্রামে লগইন করতে পারছিলাম না। আমি আমি তখন হোয়াটসঅ্যাপে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করছিলাম। সব মিলিয়ে ইনস্টাগ্রামে প্রায় মিলিয়ন খানেক শুভেচ্ছাবার্তা এসেছিল। এত বার্তার কারণে আমি রজার ফেদেরারসহ অনেক অ্যাথলেটের শুভেচ্ছার উত্তর দিতে পারিনি। তাছাড়া আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব বেশি সময় দিই না।
ইনস্টাগ্রামে মেসির অ্যাকাউন্ট
আমি নিজেই আমার ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করি। এই কাজের জন্য কোন আলাদা কোম্পানি বা ম্যানেজার নেই।
কোচিং স্টাফ
পুরো কোচিং প্যানেলটাই অসাধারণ। এই প্যানেলের অনেকেই সাবেক খেলোয়াড়। আমরা প্রতিনিয়ত যে বিষয়গুলোর মধ্য দিয়ে যাই, তারাও সেই বিষয়গুলোর মধ্য দিয়ে গেছেন। তারা জানেন কীভাবে এই ব্যাপারগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। তাঁদের বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা আছে। প্রতিটা মুহূর্তেই তাঁরা জানতেন কী করতে হবে বা কী বলতে হবে।
শেফকে জড়িয়ে ধরা
তারসঙ্গে আমার সম্পর্কটা খুব ভালো। এই ধরনের টুর্নামেন্টে এমন মানুষদের সাথেই আমাদের সময় কাটে। আর আমি আঠারো বছর বয়স থেকে এমন টুর্নামেন্টে তার সঙ্গ পেয়েছি। আমরা অনেক সময় কাটিয়েছি একসাথে। মাঠে খেলার সময়ে আমরা যেমন উত্তেজিত থাকি, তিনি এর চেয়ে কোনো অংশে কম উত্তেজিত থাকেন না।
দিয়েগো ম্যারাডোনা
দিয়েগো যদি বেঁচে থাকতেন, তিনি নিশ্চয়ই আমার হাতে ট্রফি তুলে দিতেন। ঐ ছবিটা খুব সুন্দর হতো। আমার মনে হয়, দিয়েগো এবং আর যারা আমাকে ভালোবাসতেন, তারা প্রত্যেকেই ওপর থেকে আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন, আমাদের সাহস দিয়ে গেছেন।
বার্সেলোনার মেসিকে চ্যাম্পিয়ন মেসির পরামর্শ
ষোল বছর বয়সী মেসিকে এটাই বলবো যে, তার জন্য অসাধারণ কিছু অপেক্ষা করছে। তার যাত্রাটা অনেক সুন্দর হবে। কিছু প্রতিবন্ধকতা আসবে, কিন্তু সেগুলোকে সে অতিক্রম করতে পারবে। কখনোই হাল ছেড়ে দিও না, স্বপ্ন দেখা থামিয়ো না। কারণ শেষ পর্যন্ত সেই পুরস্কারটাই পাবে, যেটা সে সবচেয়ে বেশি চেয়েছিল।
Comments