সোহাগকে নিষিদ্ধ করার ৪ কারণ

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে দুই বছরের জন্য ফুটবলের সব ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে নিষিদ্ধ করেছে ফিফা। সংস্থাটির স্বাধীন এথিক্স কমিটির বিচারক চেম্বার কর্তৃক এ নিষেধাজ্ঞা অনুমোদনের প্রেক্ষিতে শুক্রবার নিজেদের ওয়েবসাইটে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টি জানায় সংস্থাটি।
ফিফা কোড অফ এথিক্সের ২০২০ সংস্করণের ১৩ (সাধারণ দায়িত্ব), ১ (আনুগত্যের দায়িত্ব) এবং ২৪ (জালিয়াতি এবং মিথ্যাচার) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করায় এ শাস্তি পান সোহাগ। কেনাকাটা ও ফিফার তহবিল অপব্যবহার নিয়ে আবু নাঈম সোহাগকে পাঠানো ৫১ পৃষ্ঠার চিঠি নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে ফিফা।
অনিয়মের সবগুলো ঘটনাই ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে। যার তদন্ত শুরু হয় ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে। গত বছর অক্টোবরে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ফিফার সদর দপ্তরে জুরিখে শুনানি হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি। যেখানে সোহাগ ও তাঁর পক্ষে চারজন আইনজীবী -আজমালুল হোসেন, মারগুব কবির, ভিনসেন্ট সোলারি ও অ্যান্টোইন বোয়েশ উপস্থিত ছিলেন।
শুনানির পর চেম্বার সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট যে, ফাইলে থাকা তথ্য, প্রমাণ এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রমাণ করে যে সোহাগ লেনদেন ফিফা বিধির ১-৪ এর সুযোগে মিথ্যা নথি ব্যবহার করেছেন । বিশেষ করে দরপ্রস্তাবগুলো যাচাই না করেই নথিতে স্বাক্ষর করেছেন। বাফুফে এবং ফিফার প্রতি তার বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
যে চারটি অনিয়মের উল্লেখ করেছে ফিফা, এক নজরে তুলে ধরা হলো সে বিষয়গুলো—
প্রথম লেনদেন
তিন দরদাতাই একে অপরের সাথে যুক্ত
- দরদাতাদের দ্বারা জমা দেওয়া তিনটি নথিতে একই ভুল বানান "কোটেশন" লেখা ছিল এবং দরদাতাদের স্ট্যাম্প অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
- দুটি দরপ্রস্তাবের শুরুর বিবৃতি ছিল একই 'আমরা আপনাকে জানাতে পেরে আনন্দিত যে আমরা আপনার অর্ডার অনুযায়ী নিম্নলিখিত আইটেমগুলি সরবরাহ করেছি', কিন্তু সেখানে কোনো আইটেম ছিল না এমনকি অর্ডারও করা হয়নি।
- তিনটি দরপ্রস্তাবই একই বিন্যাস/কাঠামোর সঙ্গে একই ফরম্যাটে এবং স্বাক্ষরের স্থানও একই অবস্থানে।
- রবিন এন্টারপ্রাইজের দরপ্রস্তাবে দেওয়া মোবাইল নম্বরের সঙ্গে কোম্পানির সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই।
- স্পোর্টস কর্নার এবং স্পোর্টস লিংক একে অপরের পাশাপাশি ঠিকানায় অবস্থিত।
- স্পোর্টস লিঙ্কের মালিক রবিনই স্পোর্টস কর্নারের একজন সাবেক মালিক বলে মনে হয়।
- স্পোর্টস লিঙ্কের দ্বারা জমা দেওয়া নথিতে দরপত্র প্রস্তাব ও সরবরাহ নিশ্চিতের সময়ে কোনো ধারাবাহিকতা নেই।
- তিনটি দরপ্রস্তাবে একই নিয়োগকর্তা কিংবা একই টেমপ্লেট দ্বারা তৈরি করা হয়েছে, যা ইঙ্গিত করে যে সেগুলো ভিন্ন কোম্পানি নয়।
দ্বিতীয় লেনদেন
২০২০ সালের জানুয়ারিতে, ১৩৯২১ মার্কিন ডলারে ৪০০টি ফুটবল কিনেছিল বাফুফে। চেম্বার উল্লেখ করেছে যে বাফুফে সম্ভাব্য ৪০০টি ফুটবল কেনার জন্য ১৯ এবং ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল, এম/এইচ ইউ জামান ট্রেডিং এবং ওফেলিয়াস ক্লোজেট থেকে তিনটি কোটেশন পেয়েছে।
- উদ্ধৃতিতে দেওয়া ঠিকানায় (দরপ্রস্তাবে জেতা) ওফেলিয়াস ক্লোজেটের অস্তিত্ব নেই। তারা মহিলাদের পোশাক সেলাইয়ের সঙ্গে জড়িত। তাই এই সংস্থাটির বাফুফেকে ফুটবল সরবরাহ করতে পারা অসম্ভব বলে মনে করেছে এথিক্স কমিটির বিচারক চেম্বার।
- ওফেলিয়াস ক্লোজেটের আমদানি লাইসেন্স ছিল না। তারা 'এক বন্ধু'র সনদ ব্যবহার করেছে বলে জানায়।
- ওফেলিয়াস ক্লোজেট থেকে কোনো চালান না পাওয়া সত্ত্বেও বাফুফে সরবরাহকারীকে অর্থ প্রদান করেছে।
- মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল এবং এম/এস এইচ ইউ জামান ট্রেডিংয়ের উদ্ধৃতিগুলোতে তাদের খুঁজে পাওয়ার মতো পর্যাপ্ত তথ্য ছিল না এবং কোম্পানির কোনো সিল নেই দরপ্রস্তাবে।
- দরপ্রস্তাবের সবগুলোই টেবিল দিয়ে তৈরি এবং কিছু কাটাকাটি ছিল।
- মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল এবং এম/এস এইচ ইউ জামান ট্রেডিংয়ের স্বাক্ষর ছিল ফটোকপিতে, আসল নথিতে নয়।
তৃতীয় লেনদেন
নভেম্বর ২০১৯-এ, ২০২২ বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব খেলতে ওমান সফরের জন্য জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের ফ্লাইট টিকিটের জন্য আল মারওয়াহ ইন্টারন্যাশনালকে ১৯ হাজার ৯২৫ ডলার প্রদান করে। এখানে দরপত্র দিয়েছিল আল মারওয়াহ ইন্টারন্যাশনাল, পূরবী ইন্টারন্যাশনাল এবং মাল্টিপ্লেক্স ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস।
- তিনটি দরপ্রস্তাবে বেশ কিছু মিল রয়েছে, বিশেষ করে একইভাবে শুরু হয়েছে প্রতিটি বিবৃতি "আমরা নিম্নলিখিত রুটের বিমান টিকিট কোটেশন জমা দিতে পেরে আনন্দিত" এবং একই ভুল বানান ("রাউট") রয়েছে।
- মাল্টিপ্লেক্স ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস একটি ট্রাভেল এজেন্সি হিসাবে দুটি ব্যবসায়িক বাংলাদেশী ডিরেক্টরিতে তালিকাভুক্ত। কিন্তু দরপ্রস্তাবে সরবরাহকারীর নামে একটি টাইপ করা হয়েছে।
- পূরবী ইন্টারন্যাশনাল একটি জনশক্তি রফতানিকারক সংস্থা। তাদের বিমান টিকিটের জন্য একটি দরপ্রস্তাব প্রদান অসম্ভব বলে মনে করেছে কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপ।
- দরপ্রস্তাবগুলোর মূল লেখাগুলো অভিন্ন। সবকটিতে সংখ্যার ত্রুটি একই রকম এবং একই তারিখে জারি করা হয়েছিল। এই অস্বাভাবিক মিলের কারণে, মাল্টিপ্লেক্স ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস এবং পূরবী ইন্টারন্যাশনাল প্রকৃতপক্ষে উদ্ধৃতিগুলো পাঠিয়েছে বলে মনে করছে না কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপ।
- পূরবী ইন্টারন্যাশনাল এবং মাল্টিপ্লেক্স ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুর উভয়ই নিশ্চিত করেছে যে তারা বাফুফের সঙ্গে কাজ করেনি এবং কোন কোটেশন প্রদান করেনি।
- তিনটি উদ্ধৃতির টেবিল গঠন, তারিখ এবং রেফারেন্স বিন্যাস একই ছিল।
- উদ্ধৃতিগুলির সারণীগুলো একই আকারের এবং মূল বিষয়বস্তু একে অপরের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিলে যায়। একই বানান ভুল যুক্ত বাক্য তিনটি উদ্ধৃতিতেই উপস্থিত ছিল।
-নথিগুলো একই প্যাটার্ন বা টেমপ্লেট দ্বারা তৈরি। অর্থাৎ একই কোম্পানি দ্বারা তৈরি করা হয়েছে এবং তারা ভিন্ন কোনো কোম্পানি নয় বলে মনে করে কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপ।
চতুর্থ লেনদেন
২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ১ হাজার ৪১২ মার্কিন ডলারে লন মাওয়ার (ঘাস কাটার যন্ত্র) কেনে বাফুফে। ১৫ ডিসেম্বর দরপত্র আহ্বান করেন সোহাগ। দরপত্র জমা দেয় বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার ও শোভা এন্টারপ্রাইজ। কাজটা পায় বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার। দুই দিন পর শারমিন এন্টারপ্রাইজ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দেয়।
- কন্ট্রোল রিস্কের অডিটরদের কাছে তিনটি অপ্রচলিত উদ্ধৃতি প্রদান করেছে বাফুফে।
- বাংলাদেশের একটি হার্ডওয়্যারের "বাংলাদেশ হার্ডওয়ার" নামের বানান ভুল ছিল, যার ঠিকানা ছিল কিছুটা ভিন্ন।
- শোভা এন্টারপ্রাইজ এবং শারমিন এন্টারপ্রাইজের উদ্ধৃতিগুলোর মধ্যে বেশ কিছু মিল এবং একই চিত্র ছিল।
- শারমিন এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ফোনে থাকা ব্যক্তি শোভা এন্টারপ্রাইজ বলে সাড়া দেন।
- বাংলাদেশ হার্ডওয়্যারে পৌঁছানো যায়নি অর্থাৎ ঠিকানা ছিল ভুল।
১৯ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে নিজেদের রিপোর্টে উপসংহারে বলেছেন
- দরপ্রস্তাবগুলো হাতে পূর্ণ করা হয়েছে এবং এসমস্ত উদ্ধৃতিগুলোর কোটেশন ও পটভূমি একই।
- শোভা এন্টারপ্রাইজ এবং শারমিন এন্টারপ্রাইজের ভুল বানান, আকার এবং শৈলী সম্পূর্ণ একই। এবং একই টেমপ্লেট ও একই উত্স দ্বারা তৈরি করা হয় যা ভিন্ন কোনো কোম্পানি থেকে নয়।
- বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার দ্বারা জমা দেওয়া নথিগুলোর স্বাক্ষরগুলোতে অসঙ্গতি ছিল।
Comments