আবারও ফিক্সিং মহামারীর কবলে বাংলাদেশের ফুটবল

ম্যাচ পাতানো এবং আপোষকৃত ফলাফল একসময় বাংলাদেশের শীর্ষ স্তরের ফুটবলে নিয়মিত ঘটনা ছিল। প্রায়ই লীগ শিরোপা নিশ্চিত করার বা অবনমন এড়ানোর উপায় হিসাবে তা ব্যবহৃত হত। তবে, লাইভ বেটিং, স্পট-ফিক্সিং এবং অনলাইন জুয়ার উত্থান এই অবৈধ অনুশীলনগুলিকে একটি পদ্ধতিগত সংকটে রূপান্তরিত করেছে। যা কেবল প্রিমিয়ার বিভাগকেই নয়, নিম্ন-স্তরের লীগগুলিকেও সংক্রমিত করছে।

এই মারাত্মক জুয়া খেলার বিষয়টি মূলত ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু কোভিড-পরবর্তী সময়ে এটি দেশের ঘরোয়া ফুটবল সার্কিটকে গ্রাস করেছে। ২০২০-২১ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) মৌসুম একটি মোড় পরিবর্তনকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়। আরামবাগ ক্রীড়া চক্র ম্যাচ ম্যানিপুলেশন, লাইভ বেটিং এবং ফিক্সিংয়ের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়া প্রথম ক্লাব হয়ে ওঠে।

আরামবাগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক এজাজ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিবর্তন সম্পর্কে বর্ণনা করেন, 'এটি আগে শিরোপার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বা অবনমন এড়াতে চেষ্টাকারী দলগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন লাইভ বেটিং এবং স্পট-ফিক্সিং খেলাটিকে ধ্বংস করছে, যার মধ্যে ক্লাব কর্মকর্তা, খেলোয়াড় এবং এমনকি রেফারিরাও জড়িত।'

এক সময় যা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে শুরু হয়েছিল, পরে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ২০২১-২২ মৌসুমে দ্বিতীয় স্তরের বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লীগ এবং দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগকে কলুষিত করেছে।

যদিও ২০২৩-২৪ মৌসুমটি মূলত বিতর্ক থেকে মুক্ত ছিল, ২০২৪-২৫ প্রচারাভিযানে ইতিমধ্যেই তিনটি শীর্ষস্থানীয় ক্লাব - চট্টগ্রাম আবাহনী, ফকিরেরপুল ইয়ং মেনস ক্লাব এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স - জুয়া এবং ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগের সামনে পড়েছে যা পুরনো উদ্বেগ ফিরিয়ে এনেছে।

২০২১ সালে এই বিষয়টি সামনে আসার পর থেকে, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বিএফএফ) পাঁচটি ক্লাব - আরামবাগ ক্রীড়া চক্র, উত্তর বারিধারা ক্লাব, কারওয়ান বাজার প্রগতি সংঘ এবং বিজি প্রেস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাব থেকে ৩৭ জন খেলোয়াড়কে শাস্তি দিয়েছে, যার মধ্যে তিনজন বিদেশী রিক্রুটও রয়েছেন, যাদের তিন মাস থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে এবং তিনটি ক্লাবকে এক থেকে দুই স্তর অবনমন করা হয়েছে।

উল্লিখিত ক্লাবগুলি থেকে- ক্লাব সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজার, কোচ, ফিজিও, ফিটনেস ট্রেনার এবং খেলোয়াড়দের এজেন্ট সহ ১৭ জন ক্লাব কর্মকর্তাকে ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ছয় মাস থেকে আজীবন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

তবুও এই উদ্যোগগুলো জুয়া সিন্ডিকেটগুলির ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্লাব কর্মকর্তা জানান, জুয়া সিন্ডিকেটগুলি কীভাবে ক্লাবগুলিকে ম্যানিপুলেট করে, 'এক ক্লাব থেকে অন্য ক্লাবে যায়, তারা লোভী কর্মকর্তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে প্রলুব্ধ করে, তাদের বোঝায় যে জুয়া তাদের আর্থিক সমস্যার সমাধান করতে পারে।'

এদিকে, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ২০২৩ সালের শেষের দিকে জুয়া এবং ফিক্সিংয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে আজমপুর এফসি উত্তরার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার পরে তাদের শাস্তি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

নতুন কেলেঙ্কারি

চলতি মৌসুমে চট্টগ্রাম আবাহনীর সভাপতি বা ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান কেউই দল নামাতে রাজি হননি, যার ফলে প্রাক্তন এবং বর্তমান খেলোয়াড়দের এগিয়ে আসতে হয়েছে। এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন ক্লাব কর্মকর্তা এবং প্রাক্তন খেলোয়াড়দের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে যখন বন্দরনগরীর ক্লাবটি এখন ফিক্সিং এবং জুয়ার অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছে।

কোন কারণ আসলে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের মতো লজ্জাজনক কাজে জড়িত হতে চালিত করে? ফোর্টিস এফসি-র প্রধান কোচ মাসুদ পারভেজ কায়সার বলেন, 'যদি কোনও কর্মকর্তা সত্যিই ফুটবলকে ভালোবাসেন তবে তিনি জুয়া খেলা এবং ম্যাচ বিক্রির সঙ্গে জড়িত হতে পারেন না। তারা শুধুমাত্র আর্থিক লাভের জন্য এটি করে কারণ ক্লাব কর্মকর্তাদের জড়িত না থাকলে খেলোয়াড়রা এই ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারে না।'

স্পষ্টতই, সংকটের শিকড় অনেক গভীরে। ক্লাব কর্মকর্তা, কোচ এবং খেলোয়াড়রা আর্থিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি, তদারকির অভাব ও স্বচ্ছতা, বাফুফের সক্রিয়তার অভাব এবং অবশ্যই জুয়া চক্রকে এই বিশেষ মহামারীর উত্থানের জন্য দায়ী করেছেন।

বাফুফের অভ্যন্তরের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'যখন ক্লাবগুলি জুয়াড়িদের ফাঁদে পড়ে, তখন জুয়াড়িরা টিম ম্যানেজমেন্টে তাদের নিজস্ব কর্মকর্তাদের নিয়োগ করে। এমনকি তারা নিশ্চিত করার জন্য এক বা পজিশন (খেলোয়াড়ের) কিনে নেয়। এবং তাদের এসব নিজস্ব খেলোয়াড়দের মাধ্যমে ম্যাচ ফিক্সিং অনিবার্য করে তোলে।'

ফিফার সতর্কতা এবং বাফুফের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা

কোভিড-পরবর্তী সময়ে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত লীগগুলিতে জুয়া এবং ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ঝুঁকির বিষয়ে ফিফার বারবার সতর্কবার্তা সত্ত্বেও বাফুফে কেবল প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে দায় সেরেছে। অভিযোগের তদন্ত তখনই হয়েছে যখন ফিফা সরাসরি প্রমাণ দিয়েছে। এমনকি বাফুফে নিজস্ব ফিক্সড ম্যাচ ডিটেকশন কমিটির (এফএমডিসি) সুপারিশগুলিও প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়েছে।

এফএমডিসি চেয়ারম্যান হুমায়ুন খালিদ জুয়া খেলা এবং ফিক্সিংয়ের বিপদ সম্পর্কে ক্লাব কর্মকর্তা এবং খেলোয়াড়দের শিক্ষিত করার জন্য বাফুফের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তাদের খেলোয়াড়দের সময়মতো বেতন পাওয়াও নিশ্চিত করা উচিত যাতে আর্থিক হতাশা কমে।'

তিনি জানান, যে বাফুফে তার শৃঙ্খলা কমিটি কর্তৃক আরোপিত শাস্তি কী সেটা স্পষ্ট করেনি। 

বাফুফের সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন এই সংকট স্বীকার করেছেন তবে সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার দিকেও ইঙ্গিত করেছেন, 'বাফুফে নির্বাচনের কারণে আমরা এই মৌসুমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারিনি, তবে আমরা অভিযোগগুলি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছি। কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

নিষেধাজ্ঞা ছাড়িয়ে: ফৌজদারি মামলার আহ্বান

যদিও স্থগিতাদেশ এবং জরিমানা এখন পর্যন্ত প্রধান শাস্তি ছিল, আরামবাগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর যুক্তি দেখান যে এই ধরনের ব্যবস্থা কার্যকর নয়, 'যদি কোনও কর্মকর্তা জুয়া খেলে এক কোটি টাকা আয় করেন, তবে আজীবন নিষেধাজ্ঞা অর্থহীন। পরিবর্তে, এই মামলাগুলি দেশের প্রচলিত [ফৌজদারি] আইনের অধীনে মোকাবিলা করা উচিত - তবেই লোকেরা পরিণতির ভয় পাবে।'

ঐতিহাসিকভাবে, ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িত ক্লাবগুলি ছিল আর্থিকভাবে সংগ্রামরত। এবং এসব ক্লাবের হয়ে নতুন যারা সংগঠক এসেছেন তারাই এসব কাজে যুক্ত হচ্ছেন। 

অবিলম্বে হস্তক্ষেপ - কঠোর আর্থিক তদারকি, সক্রিয় শাসন এবং আইনি প্রতিক্রিয়া - ছাড়া দেশের ফুটবলের ভবিষ্যৎ মাঠের দক্ষতায় নয় বরং সর্বোচ্চ দরদাতার দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English

The elephant in the room no one is talking about

Reform of political parties is of urgent need

10h ago