কেবল নাম থেকেই 'অ্যামেচার' মুছেছে, কাজে নয়

কখনো কখনো একটি নাম শুধু নাম নয়, তা হয়ে ওঠে একটি প্রতিচ্ছবি, একটি চরিত্রের প্রতীক। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে 'বাংলাদেশ অ্যামেচার বক্সিং ফেডারেশন' নামে পরিচিত এই সংস্থাটির নাম থেকে সদ্য 'অ্যামেচার' শব্দটি ঝরে পড়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তন আদতে কি কেবল নামেই সীমাবদ্ধ? ফেডারেশনের কর্মকাণ্ড, প্রস্তুতি, ও পেশাদারিত্বে কি মিলেছে কোনো বিবর্তন? সাম্প্রতিক এক আয়োজন বলছে, উত্তরটা বড্ড অনিশ্চিত।
ছয় বছরেরও বেশি সময় পর আবারও জাতীয় নারী বক্সিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে বাংলাদেশ বক্সিং ফেডারেশন। এ উপলক্ষে শনিবার দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে তারা। স্থান হিসেবে জানানো হয়েছিল জাতীয় স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলন কক্ষ। কিন্তু সংবাদকর্মীরা সেখানে পৌঁছে অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, সেখানে কোনো আয়োজনই নেই। এক বৃদ্ধ জানালেন—ভেন্যু পরিবর্তন হয়েছে। নতুন স্থান? ফেডারেশনের নিজস্ব ভবন।
সেই ভবনে পৌঁছেও মেলে নতুন এক চমক। জানা গেলো, মূল কনফারেন্স রুমটি জরুরি কাজে ব্যবহার করছে অন্য কেউ। তাই হুট করে প্রেসিডেন্টের ছোট্ট কক্ষে গাদাগাদি করে আয়োজন করতে হয়েছে সংবাদ সম্মেলনটি। একটুখানি স্থানও পায়নি অনেক সাংবাদিক। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বা বারান্দায় ঠাঁই নিয়েছেন। সম্মেলনের শুরুতে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় এক পৃষ্ঠা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি—যাতে নেই প্রতিযোগিতার নাম পর্যন্ত!
এরপর মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বক্তব্য শুরু করেন সাধারণ সম্পাদক এম এ কুদ্দুস খান। তার কথা শোনার অপেক্ষায় সাংবাদিকদের চোখ খুঁজছিল এক মুখ জিনাত ফেরদৌস। যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী এই বক্সারকে আগের দিন বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে প্রচার করেছিল সংস্থাটি। তার আগমনের আশাতেই হয়তো এত সাংবাদিক ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু জানা গেলো, ফ্লাইট জটিলতায় দেশে ফিরতে পারেননি জিনাত।
এক পর্যায়ে কুদ্দুস খান জানান এই প্রতিযোগিতায় ৪ জন বিদেশি খেলোয়াড়ও অংশ নিচ্ছেন। প্রশ্ন উঠলো, জাতীয় প্রতিযোগিতায় বিদেশিরা কেন? এ নিয়ে জবাব এল না সুস্পষ্ট। অস্পষ্ট ভাষায় বলা হলো, 'আমরা ভেবেছিলাম কিছু ইউনিভারসিটি যোগ দিয়েছে, তাদের বিদেশি স্টুডেন্ট রয়েছে, তারা খেলতে চেয়েছে। তাই আমরা অনুমোদন দিয়েছি। দেখি আমরা এখন তাদের সঙ্গে আলোচনা করে না করে দিব।'
কিন্তু আলোচনার কথা বললেও ঠিক তার কিছুক্ষণ পর কুদ্দুস নিজেই জানালেন বাদ দেওয়া হয়েছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে। এই অনিশ্চয়তার মাঝেই তিনি জানালেন, '৭২ দলের মধ্যে এক দল বাদ যাবে, কারণ সেটিতে বিদেশি খেলোয়াড় রয়েছে। এখন মোট ৭১টি দল অংশ নিচ্ছে—ক্লাব, জেলা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সিটি কর্পোরেশন থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার পর্যন্ত রয়েছে। তবে বিজিবি নেই।'
এই বছর অংশ নিচ্ছে বেশ কিছু নতুন ক্লাব, যারা এখনও ফেডারেশনের নিবন্ধনে নেই। এ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। 'এ' বক্সিং ক্লাবের সভাপতি আসাদুজ্জামান অভিযোগ করেছেন, তাদের শুধু এই কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে যে তারা পেশাদার বক্সিং খেলেন। অথচ ফেডারেশনের দাবি—যারা পেশাদার বক্সিংয়ে গিয়েছেন, তারা ক্ষমা চেয়ে ফিরে এসেছেন বলেই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কুদ্দুস জানালেন—প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্তও কোনো ক্লাব সুযোগ চাইলে তারা বিবেচনা করবেন।
অথচ টুর্নামেন্ট শুরু ২৭ জুলাই, এই ঘোষণা যখন আসে তখন ২২ ঘণ্টাও বাকি নেই আসর রিংয়ে গড়ানোর। সূচি তৈরি হয়ে গেছে, অথচ এখনো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে নতুন ক্লাবকে! একে কি বলে পেশাদারিত্ব? নাকি ঠিক আগের মতোই 'অ্যামেচার' ভাবনা আজও রয়ে গেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে?
চার দিনের এই আয়োজন—২৭, ২৮, ২৯ ও ৩০ জুলাই—প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে চলবে রাত পর্যন্ত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বক্সারদের অংশগ্রহণে মুখর থাকবে এই সময়টা। কিন্তু আয়োজনের এই বিশৃঙ্খলা, সংবাদ সম্মেলনের অপরিকল্পনা, বিদেশিদের অংশগ্রহণ নিয়ে ধোঁয়াশা—সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠছে, সত্যি কি 'অ্যামেচার' শব্দটি শুধুই নাম থেকে মুছে গেছে, নাকি আদতে ফেডারেশনটি এখনও ওই পুরনো চেহারাতেই রয়ে গেছে? গ্লাভস পরে শুধু রিংয়ের লড়াইই নয়, প্রমাণ দিতে হয় পেশাদারিত্বের রিংয়েও।
Comments