অর্ধেক ভেন্যু, অনেক খেলা

মিরপুর সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামের বাইরে দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। খোলা আকাশের নিচে, মাটির উপর আবার কখনো পিচঢালা পথে কুস্তিগিররা ঘাম ঝরাচ্ছেন অনুশীলনে। পথচারীরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে, যেন ক্রীড়ার মঞ্চ সরাসরি চলে এসেছে রাস্তায়। কিন্তু কেন জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের এমন দুরবস্থা? উত্তর একটাই -ভেতরে জায়গা নেই।

মাত্র ১৮০০ স্কয়ার-ফিট আয়তনের এই ইনডোরের এক-তৃতীয়াংশ দখল করে রেখেছে বাংলাদেশ আর্মি। অবশিষ্ট অল্প জায়গায় একসঙ্গে চারটি ফেডারেশন -ফেন্সিং, উশু, কুস্তি ও জুডো চালাচ্ছে অনুশীলন। আসন্ন সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসকে সামনে রেখে প্রতিটি ডিসিপ্লিনেই অংশ নিচ্ছেন কয়েক ডজন করে ক্রীড়াবিদ। হিসাব বলছে—ফেন্সিংয়ে ৪৫ জন, উশুতে ৪৬ জন, কুস্তিতে ৫২ জন আর জুডোতেও পঞ্চাশাধিক খেলোয়াড় প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চার ডিসিপ্লিন মিলিয়ে শতাধিক ক্রীড়াবিদের জন্য কার্যকর জায়গা পড়ে মাত্র কয়েকশ স্কয়ার-ফিট। এমন সীমাবদ্ধতায় আন্তর্জাতিক মানের প্রস্তুতি কতটা সম্ভব, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

এই সংকট কোনো নির্দিষ্ট খেলাধুলার নয়। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ৫০টিরও বেশি ডিসিপ্লিন থাকলেও, বেশিরভাগেরই নেই নিজস্ব ভেন্যু। তাই আজ এখানে, কাল অন্যখানে; এই অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়েই এগোতে হয় খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ার। স্থানীয় প্রতিযোগিতা কোনোভাবে সামলে নেওয়া গেলেও, আন্তর্জাতিক আসরের আগে দীর্ঘমেয়াদি ক্যাম্প আয়োজন সবসময়ই হয়ে ওঠে সীমাহীন বিড়ম্বনার বিষয়।

মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে পাশাপাশি বিছানো চারটি ম্যাটে চলছে চার ডিসিপ্লিনের সম্মিলিত ক্যাম্প। প্রতিদিন শতাধিক খেলোয়াড় সেখানে ঘাম ঝরাচ্ছেন। তবে জায়গার সংকটের কারণে সবার কাঙ্ক্ষিত প্রস্তুতি নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রতিদিনই তাই তৈরি হয় জটিল এক চিত্র। চারটি ফেডারেশন একসঙ্গে অনুশীলনে নামলে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে অস্বস্তিকর। তরবারি চালাতে গিয়ে ফেন্সিং খেলোয়াড়ের আঘাত লাগতে পারে পাশের উশুকারীর শরীরে, কুস্তিগীরদের ধাক্কা গিয়ে পড়ে জুডো দলের উপর। কখনও কখনও অনুশীলন থেমে যায় মনোমালিন্যে। তাই সমস্যা এড়াতে প্রত্যেকে চেষ্টা করে এগিয়ে এসে সমাধান করতে। কিন্তু সবার তো একই প্রয়োজন! শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই দুই-তিনটি ফেডারেশনকে একত্রে গাদাগাদি করে কাজ চালাতে হয়।

তখনই ভিন্ন চিত্র দেখা যায় স্টেডিয়ামের বাইরে। নিরাপদ মাদুরের বদলে কখনো শক্ত কংক্রিটে আবার কখনো মাটিতে পড়ে-উঠে অনুশীলন করেন কুস্তিগিররা। উশু দলের খেলোয়াড়েরা লাফঝাঁপের জায়গা না পেয়ে চলে যান খোলা জায়গায়। ফেন্সিং বা জুডোর মতো খেলাগুলোতেও চলে যায় একে অন্যের জায়গা ধার নেওয়ার গল্পে। এতে অনুশীলনের ধারাবাহিকতা ভাঙে, খেলোয়াড়দের মনেও জন্ম নেয় ক্ষোভ।

প্রিস্তের পাশেই থাকা সীমানার দড়ি দেখিয়ে ফেন্সার হাসান আলী বললেন, 'যখন প্রতিপক্ষ অ্যাটাকে আসে আমি ওর সোর্ডটা ধরতে যাই মানে ব্লক করতে যাই, তখন এই সাইডের দড়িগুলোতে লাগে তাতে ঠিকভাবে করা যায় না। এতে আমাদের সমস্যা হয়। জায়গাটা এতো ছোট যে সবাই এক সঙ্গে অনুশীলন করার কোনো সুযোগ নেই। যদি আরেকটু বড় জায়গা হতো তাহলে ঠিকভাবে অনুশীলন করতে পারতাম।'

উশু ফেডারেশনের কোচ মেজবাহ উদ্দিনের কণ্ঠে শোনা গেল দীর্ঘশ্বাস, 'এখানে সব কিছু ঠিক আছে, কিন্তু জায়গাটাই সমস্যা। এত অল্প জায়গায় আসলে হয় না। হ্যাঁ, এখানেই অনুশীলন করে ২০১০ সালে আমরা স্বর্ণ জিতেছিলাম। কিন্তু এবার একসঙ্গে চার ফেডারেশন আসায় ঝামেলা বেড়েছে। আমাদের যদি আলাদা স্টেডিয়াম থাকতো, ফলাফল আরও ভালো হতো। অন্তত আরও বিস্তৃত জায়গা দরকার।'

উশু খেলোয়াড় বিপ্লব রুদ্রও কণ্ঠও মিলল তার গুরুর সঙ্গে, 'আমরা যেখানে অনুশীলন করছি, তার আশেপাশে আরও অনেকেই অনুশীলন করছে। এখানে যখন আমরা যখন অনুশীলন করি তখন অস্ত্র-টস্র দিয়ে করতে হয় তখন একটা ভয় থাকে ছুটে গেলে অন্য যারা সাইডে অনুশীলন করছে তাদের গাঁয়ে লাগতে পারে। তাই আমাদের মানসিকভাবে একটা চাপ থাকে। ফলে অনুশীলনে একটা ঘাটতি থেকে যায়। জায়গাটা আরেকটু বিস্তৃত হলে আমাদের চাপটা কম থাকতো, অনুশীলনও ভালো হতো।'

একটি স্পোর্টস ভিলেজের দাবি করে ফেন্সিং ফেডারেশনের কোচ আবু জাহিদ চৌধুরী বললেন, 'আমাদের আসলে একটা স্পোর্টস ভিলেজ দরকার। এই ক্যাম্পের পরিবেশ আসলেই কি উপযুক্ত? গা ঘেঁষাঘেঁষি করে অনুশীলন, নিরবচ্ছিন্ন কিছুই সম্ভব নয়। এত বড় টুর্নামেন্টের আগে এই প্রস্তুতিতে ভালো ফলাফল আশা করা কঠিন। সবকিছু গুলিস্তান-কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। কিন্তু গুলিস্তান কি অনুশীলনের জায়গা? ধুলাবালি, ময়লা—এসব দেখে বিদেশি কোচরা আসতেই চায় না। একমাত্র আর্চারিই আর কেউ কি ভালো কোচ আনতে পেরেছে?'

রেসলিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন আজাদের বক্তব্য অবশ্য বাস্তবধর্মী, 'আমরা যা পেয়েছি তাই নিয়েই কাজ করতে হবে। আলাদা ভেন্যু নেই, তবে থাকলে অবশ্যই ভালো হতো। আমরা তো সবসময় অন্য ফেডারেশনের ভেন্যু ভাগাভাগি করে ব্যবহার করি। এখানে জায়গা পেয়ে করছি, কিন্তু দেখেন, অনেক খেলোয়াড় ওই পাশে বসে থাকে, কারণ জায়গা নেই। অনেকে বাইরে গিয়ে অনুশীলন করে। একসঙ্গে সম্ভব হয় না, দুই-তিন ভাগে ভাগ হয়ে করতে হয়।'

স্বাভাবিকভাবেই আসন্ন এসএ গেমসের আগে এভাবে প্রস্তুতি নেওয়া শুধু খেলোয়াড়দের শারীরিক সক্ষমতাকেই সীমাবদ্ধ করছে না, মানসিকভাবেও তৈরি করছে চাপ। প্রতিদিনকার এই সংগ্রাম তাদের ভেতরের আগুনকে নিভিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। অথচ এই ক্রীড়াবিদরাই তো দেশের পতাকা উঁচিয়ে ধরার স্বপ্ন নিয়ে লড়াই করছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh Bank reduces cash reserve requirement

Three banks agree to merge, two oppose

Among the five Shariah-based banks slated for merger by the central bank, three have agreed to the regulator’s plan, while two have opposed it during separate meetings in the last three days..Those that agreed are First Security Islami Bank PLC (FSIB), Global Islami Bank PLC (GIB), and Uni

17m ago