স্টেডিয়ামে জাপানিদের বর্ণিল উৎসব, জার্মানদের বিয়ার পানের কৌশল
জাপানি দর্শক মানেই ভিন্ন কিছু। রঙ-বেরঙের সাজ, নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সবসময় স্টেডিয়াম গরম করে রাখা। কালকে জার্মানির বিপক্ষে খেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। পুরো খেলা জুড়ে জাপানি দর্শকরাই ছিলেন গ্যালারির প্রাণ। খেলার পুরো সময় নাচে-গানে চিৎকার আর হৈ-হুল্লোড়ে কাতারের খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামকে তারা বানিয়ে ফেলেছিলেন মিনি জাপান।
কাতারে যে বিশ্বকাপ হচ্ছে এর পুরো আমেজ পাওয়া যায় শুধু স্টেডিয়ামে গেলেই। বিশ্বকাপ উপলক্ষে কাতারে এত এত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে যে দর্শকরা বিশ্বকাপের সব উন্মাদনা জমিয়ে রাখেন স্টেডিয়ামের জন্য।
স্টেডিয়াম এলাকার বাইরে ফিফার ফ্যান ফেস্ট আর সউক ওয়াকিফ বলে কাতারের রাজধানী দোহার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি বাজার ছাড়া আর কোথাও তেমন একটা পাওয়া যায় না ফুটবল বিশ্বকাপের আমেজ। মেট্রোতে উঠলে নানা স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাওয়া দর্শকদের দেখা যায় ঠিকই, কিন্তু কাতারের কঠিন নিয়ম কানুনের বেড়াজালে পড়ে তারাও যেন বুঝে গেছেন যা করতে হবে তার সবই স্টেডিয়ামে গিয়ে।
স্টেডিয়ামে প্রবেশে কয়েক স্তরের কঠিন নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হতে হয়- এটা দেখে যে কারো মনে হতে পারে দর্শকরা সবাই মনে হয় এমন কোনো জায়গা থেকে এসেছে যারা সুযোগ পেলেই কাতার তছনছ করে চলে যাবে!
গতকাল জাপান আর জার্মানির খেলায় আমার আসন পড়েছিল এমন এক জায়গায় যেখানে একপাশে গান বাজনায় মত্ত জাপানিরা আর অন্যপাশে বিয়ার হাতে বসে থাকা জার্মান দর্শকের সারি!
স্টেডিয়ামে বিয়ারের কথা শুনে আপনার চোখ কপালে উঠতেই পারে। কারণ, কাতারে স্টেডিয়াম এলাকায় তো সবধরনের অ্যালকোহল বিক্রি নিষিদ্ধ করে রেখেছে কাতার সরকার। তবুও স্টেডিয়ামে বিয়ার পাওয়া যাচ্ছে, জার্মানির দর্শকদের গ্লাস গ্লাস ভরে বিয়ার খেতে দেখে প্রচণ্ড কৌতূহল হলো। নিজের আসন ছেড়ে উঠে গেলাম জার্মানির দর্শকরা আমার যে পাশে বসে খেলা দেখছেন সেই স্ট্যান্ডে।
আর্জেন্টিনার দর্শকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে ভাষাগত যে সমস্যা হচ্ছিল জার্মানির দর্শকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে সেই সমস্যা খুব একটা হয়নি। কারণ অনেক জার্মানই ভালো ইংরেজি বলতে পারে। তাদের একজন টমাস। খেলা দেখতে এসেছে বার্লিন থেকে, অথচ সে বায়ার্ন মিউনিখের কট্টর সমর্থক। টমাসের সাথে বিয়ার নিয়ে কথা শুরু করলাম।
-স্টেডিয়ামে না বিয়ার নিষিদ্ধ?
-নিষিদ্ধই তো!
-তাহলে তোমরা সবাই খাচ্ছো কিভাবে?
আমার কথা শুনে টমাসের মুখে হাসি ফুটে উঠলো আর সে আমাকে বললো,
-এখানে তো সবকিছুই নিষিদ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু আমরা তো বিয়ার খেতে খেতে খেলা দেখতে পছন্দ করি। এই যে সবাই বিয়ার খাচ্ছি- এটা জিরো। কোনো অ্যালকোহল নেই। কিন্তু খেলা দেখতে দেখতে বিয়ার খাওয়ার যে অভ্যাস আমাদের সেটা তো এখানে এসে হুট করে ছাড়তে পারি না। তাই আমরা জিরো অ্যালকোহলের বিয়ারই খাচ্ছি।
-এটা খেয়ে কি অ্যালকোহলিক বিয়ারের স্বাদ পাচ্ছো?
আমার এই প্রশ্ন শুনে টমাস তার চেহারায় এমন ভাব ফুটিয়ে তুললো যার অর্থ সহজ বাংলায়- দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে!
তারপর টমাস আমাকে বললো তারা প্রতিদিনই অ্যালকোহলিক বিয়ারও পান করছে আর এই বিয়ার পানের জন্য প্রতিদিনই জার্মানির দর্শকরা একবার হলেও ফিফার ফ্যান ফেস্টে যাচ্ছে। সেখানেও নাকি আরেক নিয়ম- একজন চারটার বেশি বিয়ার কিনতে পারবে না! আর যেমন চড়া দাম- কেউ টাকার কুমির না হলে কাতারে বসে মন ভরে বিয়ারের পর বিয়ার খেতেও পারবে না। ফ্যান ফেস্টে একেকটা বিয়ারের দাম যে ১৫ ডলার! টমাসের সাথে যখন কথা বলছি তখন জার্মানির গ্যালারি স্তব্ধ করে জাপান দ্বিতীয় গোল দিয়ে দিয়েছে। গোলের পর জাপানিদের 'হৈ হৈ হো হো' চিৎকারের সম্মিলিত কোরাস পুরো স্টেডিয়াম কাঁপাচ্ছে।
এই বিশ্বকাপ কি তাহলে অঘটনের বিশ্বকাপ? আগেরদিন সৌদির কাছে আর্জেন্টিনা হারলো, আর এখন জাপানের কাছে ধরাশায়ী হচ্ছে ফুটবল পরাশক্তি প্রাণশক্তির দল জার্মানি। দুশ্চিন্তায় জার্মানির দর্শকদের চেহারায় প্রবল শঙ্কার মেঘ। বিপরীতে আনন্দের রেনু ছড়িয়ে পড়েছে, পুরো গ্যালারিতে উঠেছে নীল ঢেউ। ।
আমার পাশে বসে থাকা দুই জাপানি দর্শকের সঙ্গে কথা হলো। একজনের নাম হচ্ছে তানজি, অন্যজনের নাম শিওরি। দুজনেই থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে। ফুটবলের টানে নিজের দেশকে সমর্থন দিতে চলে এসেছে কাতারে। প্রথম পর্বের জাপানের সবগুলো খেলার টিকেটই ওরা পেয়েছে। আমি তানজিকে জিজ্ঞেস করলাম- জাপান তো এখন দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে পারে, তখন গ্যালারিতে এসে খেলা দেখবে না?
আমার প্রশ্ন শুনে দুজনেই হেসে দিলো। তারপর তানজি জানালো- ওদের সবগুলো টিকেটই জাপান ম্যাচের কন্ডিশনাল টিকেট। বিশ্বকাপে জাপান যতদূর পর্যন্ত যাবে তারা সেই পর্যন্ত খেলা দেখতে পারবে। একেবারে ফাইনাল পর্যন্ত জাপান সমর্থকদের জন্য সংরক্ষিত কন্ডিশনাল টিকেট করে তারা কাতার বিশ্বকাপ দেখতে এসেছে। ফাইনালের আগে যদি জাপান বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় তাহলে যে খেলাগুলো জাপান খেলবে না সেইসব খেলার টিকেটের টাকা তারা ফিফা থেকে ফেরত পাবে। উত্তম ব্যবস্থা।
রেফারি খেলার শেষ বাঁশি বাজাতেই জাপানিরা পুরো স্টেডিয়াম তুমুল উল্লাসে ভরিয়ে দিল, যেন বিশ্ব জয়ের আনন্দ।তানজি আর শিওরিও চিৎকার দিচ্ছে, জয়ের আনন্দে দিশেহারা তারা। অন্যদিকে চুপচাপ গ্যালারিতে বসে অবিশ্বাস্য চোখে মাঠের দিকে তাকিয়ে জার্মানির সমর্থকদের ভাষায় স্বাদহীন বিয়ার গিলেই যাচ্ছে জার্মানির দর্শকরা। জার্মানির পরাজয়ে অ্যালকোহল ছাড়া এই বিয়ারেই হয়তো তারা খুঁজছে পরাজয়ের সান্ত্বনা!
(লেখক: দ্য ডেইলি স্টারের পাঠক, ব্যবহৃত ছবি লেখকের তোলা )
Comments