রবার্ট লেভানদোভস্কি: বয়স যার কাছে কেবলই সংখ্যা
বিশ্ব এখন কাঁপছে ফুটবল জ্বরে। মরুর বুকে কোন দল উঁচিয়ে ধরবে গৌরবের শিরোপা, আসরজুড়ে কোন তারকারা বিস্তার করবেন প্রভাব, সেসব নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক। ২০২২ বিশ্বকাপ শেষেই বিদায় বলবেন কেউ আবার খেলা চালিয়ে গেলেও অনেকের নাও মিলতে পারে আগামী (২০২৬) বিশ্বকাপে সুযোগ। দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ও ক্লাব ফুটবলে দাপিয়ে বেড়ানোর পর বয়সের কাছে হয়তো হার মানতে হবে একদিন, রবার্ট লেভানদোভস্কিকেও তো একদিন তুলেই রাখতে হবে বুট।
ক্লাব ফুটবলে অর্জনের কোন কমতি নেই পোলিশ মহাতারকার। জিতেছেন ১০টি বুন্দেসলিগা ট্রফি, বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ২০১৯-২০ মৌসুমে আছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের গৌরবও। ৩১২ গোল নিয়ে জার্মানির সর্বোচ্চ এই লিগের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। কিংবদন্তি গার্ড মুলারের পরই উচ্চারিত হয় লেভানদোভস্কির নাম। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে নাম লিখিয়েছেন চার বার।
জাতীয় দলের হয়েও বেশ ভালো তার পরিসংখ্যান। বিয়ায়ো চেরওয়ানিদের হয়ে ১৩৪ ম্যাচ খেলে ৭৬ বার জাল খুঁজে নিয়েছেন দুইবারের 'ফিফা বেস্ট' (২০২০ ও ২০২১) পুরস্কার জয়ী। ২০২০ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন ইউরোপের সেরা খেলোয়াড়ও। তবে এতো অর্জনের ভিড়েও লেভানদোভস্কির নেই কেবল জাতীয় দলের হয়ে মেজর কোন শিরোপা।
পোলান্ডের বয়সভিত্তিক দলে আলো ছড়িয়ে জাতীয় দলের দরজা খুলে গিয়েছিল ২০০৮ সালেই। তখন লেভানদোভস্কির বয়স মাত্র ২০ বছর। সান ম্যারিনোর বিপক্ষে নিজের অভিষেক ম্যাচেই গোল পেয়ে যান তিনি। এরপর থেকে পোল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন নিয়মিতই।
ক্যারিয়ারের শুরুতে পোলিশ ক্লাব লেহ পোজনানে আলো ছড়িয়ে নজরে পড়েন বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের। ২০১০ সালে পাড়ি জমান জার্মানিতে। তবে সেই বছরেও একটা আক্ষেপ সঙ্গী হয়েছিল তার, ২০১০ বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি পোল্যান্ড। জাতীয় দলে লেভানদোভস্কির অভিষেকের পর সেটাই ছিল প্রথম বিশ্বকাপ।
বিশ্বমঞ্চে সুযোগ না পেলেও সেই বছরটা পোল্যান্ডের হয়ে দারুণ কাটান লেভানদোভস্কি, ১৩ ম্যাচে করেন ছয় গোল ও দুই অ্যাসিস্ট। এদিকে ডর্টমুন্ডে চলছিল তার স্বপ্নযাত্রা। বড় ক্লাবগুলোর আগ্রহে পরিণত হন অল্প সময়েই। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ২৬ মার্চ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে প্রথমবারের মতো অধিনায়কত্ব করেন পোল্যান্ডের। অভিষেক ম্যাচের প্রতিপক্ষ সান ম্যারিনোকেই পেয়েছিলেন সেদিন সামনে।
নেতৃত্ব যে এই লেভানদোভস্কির জন্য কোন চাপ নয় বরং তার সেরাটা বের করে আনতে কার্যকরী তার আঁচ পাওয়া গিয়েছিল সেদিনই। দুই গোল করে জাতীয় দলের হয়ে নয় ম্যাচের গোলখরা সেদিনই কাটান 'দ্য বডি'। কিন্তু সেবারও বাছাইপর্ব বাধা টপকাতে না পারায় তার বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখেনি আলোর মুখ। ২০১৪ বিশ্বকাপেও দর্শক হয়ে থাকতে হয় লেভানদোভস্কিকে।
তবে সেবছরই নতুন দিকে মোড় নেয় পোলিশ তারকার ক্যারিয়ার, ডর্টমুন্ডের চিরপ্রতিদ্বন্দী বায়ার্ন মিউনিখে পাড়ি জমান তিনি। একই বছর স্থায়ীভাবে লাভ করেন জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব। নেতৃত্ব পেয়েই নিজের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেন লেভানদোভস্কি। শুরু হয় আন্তর্জাতিক পোশাকে তার দুরন্ত পথচলা। দাপটের সঙ্গে ২০১৬ ইউরোর বাছাইপর্ব পার করে মূল পর্বে জায়গা করে নেয় পোল্যান্ড।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগ পর্যন্ত ১৬ ম্যাচে মাঠে নেমে ১৬ গোল করেন অধিনায়ক লেভানদোভস্কি। তবে ইউরোতে এসে হঠাৎই খোলসে বন্দী হয়ে পড়েন তিনি। সেই আসরে পাঁচ ম্যাচ খেলে করেন এক গোল। তার দল পোল্যান্ডও কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের সঙ্গে টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নেয় টুর্নামেন্ট থেকে।
ইউরোর পর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ শুরু হতেই আবার সরূপে ফেরেন লেভানদোভস্কি। ১০ ম্যাচে ১৬ গোল করে পূরণ করেন নিজের স্বপ্ন, ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো খেলতে নামেন বিশ্বকাপে। নিজের প্রথম ও একমাত্র বিশ্বকাপ সেবার রাঙাতে পারেননি তিনি, ২০২২ বিশ্বকাপই তাই হতে পারে এই মঞ্চে বড় কিছু করে দেখানোর একমাত্র সুযোগ।
পোলিশ তারকার বর্তমান বয়স ৩৪। ২০২৬ বিশ্বকাপে যেটা গিয়ে ঠেকবে ৩৮ এ। ফলে সেই বিশ্বকাপে লেভানদোভস্কিকে দেখতে পাবার সম্ভাবনা থাকলেও তা খুবই ক্ষীণ। ফলে তার ভক্তরা এবারই হয়ত শেষবারের মতো বুক বাঁধবে আশায়। ৩৭৭ লাখ পোলিশও চেয়ে থাকবে লেভানদোভস্কির দিকেই, বিশ্বকাপে সর্বশেষ বলার মতো সাফল্য এসেছিল যে সেই ১৯৮২ সালে!
সেমিতে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল সেবার, এর আগে ১৯৭৪ সালেও বিদায় নিতে হয়েছিল শেষ চার থেকেই। দুবারই তৃতীয় হয়ে ক্ষত ভুলতে হয়েছিল পোল্যান্ডকে। এবার যে সেই সাফল্যকে ছাড়িয়ে যাবার প্রত্যয় নিয়েই মাঠে নামবে লেভানদোভস্কির দল তা নিয়ে নেই কোন সন্দেহের অবকাশ। কারণ তাদের অধিনায়ক এমনই একজন যিনি বিশ্বাস করেন করে দেখানোতে, হার মানা নেই যার স্বভাবে।
Comments