লিওনেল মেসি: সমাপ্তি কি ঘটবে অর্জনে?
সময়ের সেরার প্রশ্নে সবসময়ই আসবে লিওনেল আন্দ্রেস মেসির নাম। তবে সর্বকালের সেরা হতে আর্জেন্টাইন মহাতারকার প্রয়োজন কেবল একটি বিশ্বকাপ। আর কাতারেই এই কীর্তি গড়ার সম্ভাব্য শেষ সুযোগটা পাবেন ক্ষুদে জাদুকর, বয়সের কাছে যে একদিন হার মানতে হয় সবাইকেই। তবে মেসি শিরোপা জিতুক বা না জিতুক, তার ভক্তদের জন্য ২০২২ বিশ্বকাপ হতে চলেছে অনেক আবেগের, অনেক কান্নার। ফুটবলপ্রেমীদের জন্যও অবসান ঘটতে চলেছে দীর্ঘ একটি যুগের।
হরমোনের সমস্যায় ভোগা শিশুটি যে একদিন কাঁপাবে বিশ্ব-সেকথা জানা ছিল না আর্জেন্টাইন ক্লাব নিওয়েলস ওল্ড বয়সের। ফলে মেসির চিকিৎসার খরচ চালাতে প্রথমে সাহায্য করতে রাজি হলেও পরবর্তীতে এই অবস্থান থেকে সরে আসে তারা। পিতা হোর্হে মেসির মাথায় ভেঙে পড়ে আকাশ, ব্যয়বহুল এই চিকিৎসার ভার বহন করা ছিল তার সাধ্যের বাইরে। ফলে বাধ্য হয়ে ধর্ণা দিতে শুরু করেন অন্য আলবিসেলেস্তে ক্লাবগুলোর দরবারে।
বুয়েনস আইরেস ক্লাব রিভার প্লেট রাজিও হয় মেসিকে নিতে, তবে চিকিৎসার ব্যয় বহনে অস্বীকৃতি জানায় তারা। কোন উপায় না দেখে ২০০০ সালে ছেলেকে নিয়ে স্পেনে পাড়ি জমান হোর্হে। বার্সেলোনায় মেসির একটি ট্রায়াল সেশন আয়োজনেই সক্ষম হন তিনি। প্রথম দেখাতেই সবাইকে মুগ্ধ করেন লা পুল্গা। কাতালান ক্লাবটির যুব একাডেমির দরজা খুলে যায় তার জন্য। সেস ফাব্রেগাস ও জেরার্দ পিকেকে সেখানে সতীর্থ হিসেবে পান মেসি।
একাডেমিতে আলো ছড়িয়ে সুযোগ পান বয়সভিত্তিক দলে। সেখানে আরও অদম্য হয়ে ওঠেন মেসি, একের পর কীর্তি গড়ে ২০০৩ সালে নাম লেখান বার্সেলোনা 'সি' দলে। এরপর 'বি' দল ঘুরে দুই বছর পার না হতেই মাত্র ১৮ বছর বয়সে মূল দলে সুযোগ পেয়ে চমকে দেন বিশ্বকে। সেখানেই ব্রাজিল কিংবদন্তী রোনালদিনহোর সান্নিধ্যে আসেন ক্ষুদে জাদুকর। এরপরই শুরু হয় তার স্বপ্নযাত্রা।
লা লিগার অভিষেক ম্যাচে এস্পানিওলের বিপক্ষে ৮২ মিনিটে মাঠে নামার সুযোগ পান মেসি। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই অতিমানবীয় ড্রিবলিং ছিল তার বিশেষত্ব। বলের ওপর দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণ ও স্কিল মুভে পারদর্শীতা প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের মনে করত ভীতির সঞ্চার। চার-পাঁচজনকে অনায়াসেই পার করে ফেলতে পারতেন লা পুল্গা, গোল করা বা করানো কোনটিতেই ছিলেন না পিছিয়ে।
২০০৫ সালে জাতীয় দলের সুযোগও ধরা দেয় মেসির হাতে। আলবিসেলেস্তেদের বর্তমান কোচ লিওনেল স্কালোনিও ছিলেন সেই দলের সদস্য। প্রায় সাত মাস অপেক্ষার পর ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে প্রথম গোলের দেখা পান মেসি। যদিও শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি হেরে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বমঞ্চে খেলেন ক্ষুদে জাদুকর। সেবার তিন ম্যাচ খেলে এক গোল করেছিলে তিনি।
পরের বছরই প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা উঠতে পারত মেসির হাতে, তবে কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে পাত্তাই পায়নি আলবিসেলেস্তেরা। জাতীয় দলে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে না পারলেও ক্লাব ফুটবলে সাফল্য পেতে শুরু করেন লিও। ২০০৮-০৯ মৌসুমে লা লিগায় ৩১ ম্যাচ খেলে করেন ২৩ গোল, বিশ্বকে দেন একদিন সেরা হওয়ার বার্তা। সেই মৌসুম শেষেই জয় করেন প্রথম ব্যালন ডি অর।
২০০৯-১০ মৌসুমটা ব্লগ্রানা শিবিরে দুর্দান্ত কাটে মেসির। সেবার লা লিগায় ৩৫ ম্যাচে ৩৪ গোল করে আবারও চমকে দেন তিনি। তবে জাতীয় দল মেসির জন্য পরিণত হতে থাকে আক্ষেপের এক নামে। ২০১০ বিশ্বকাপে তারকাখচিত দল নিয়ে গিয়েও হতাশ করে আর্জেন্টিনা। গঞ্জালো হিগুয়েন, কার্লোস তেভেজ, আনহেল দি মারিয়াদের দল শেষ আটে ০-৪ গোলে বিধ্বস্ত হয় জার্মানদের কাছে। গোটা আসরেই অনুজ্জ্বল ছিলেন মেসি।
এরপরই বিতর্ক পিছু নেয় মেসির, শুধু ক্লাবেই পারেন তিনি-রটতে শুরু করে এমন কথাও। বিশ্বকাপ খেলে ফিরে বার্সেলোনার হয়ে আবারও সাফল্যের রথ চালাতে থাকেন মেসি। ফলে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার ছিল না উপায়ও। ২০১১ সালের কোপা আমেরিকাতেও হতাশ করে আর্জেন্টিনা, লা পুল্গাও কাটান গোলহীন এক আসর। সেই আসরের পরই আলবিসেলেস্তেদের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড উঠে মেসির হাতে।
২০১১-১২ মৌসুমে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান লিও। জার্মান কিংবদন্তি গার্ড মুলারের এক মৌসুমে ৮৫ গোলের রেকর্ড ভেঙে থামেন ৯১ গোল করে। জাতীয় দলের হয়েও মনে রাখার মতো একটি বছর কাটান তিনি। আকাশী নীলদের হয়ে ১৯ গোল করেন সেবার। মৌসুম শেষে চতুর্থ ব্যালন ডি অর জিতে গড়েন আরও একটি রেকর্ড। ২০১৪ সালে অপবাদ ঘুচানোর সুবর্ণ সুযোগ ছিল মেসির সামনে।
ব্রাজিল বিশ্বকাপের গোটা আসরে অনেকটা একাই দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালে, কিন্তু শিরোপা নির্ধারণী মঞ্চে মারিও গোটজের শেষ মুহূর্তের গোলে অশ্রুর বন্যা বয়ে যায় ভক্তদের চোখে। এরপর ফাইনাল হারাটা যেন নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয় আর্জেন্টিনার। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে কোপা আমেরিকার দুই আসরের ফাইনাল হারে তারা। দুঃখে-ক্ষোভে-অপমানে অবসরই নিয়ে ফেলেছিলেন মেসি, সমালোচকরাও বেশ সরব হয়ে উঠে সেই সময়।
২০১৮ বিশ্বকাপে শেষ ষোলতেই থামে আকাশী নীলদের যাত্রা। তবে এরপরই একটু একটু করে সব বদলে দিতে থাকেন লিওনেল স্কালোনি। তার অধীনে ২০১৯ কোপা আমেরিকার সেমিফাইনাল খেলে আলবিসেলেস্তেরা। ব্রাজিলের বিপক্ষে হারে সেবার শিরোপার লড়াই থেকে ছিটকে গিয়ে আরও একবার হতাশ হতে হয় মেসিদের। তবে সবাই ভেঙে পড়লেও স্কালোনির মনোবল ছিল অটুট, সেখান থেকেই শুরু হয় নতুন আর্জেন্টিনার উত্থান।
শেষ পর্যন্ত ২০২১ সালে মেসির হাতে ধরা দেয় প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি। খোদ ফুটবল ঈশ্বরও হয়ত সেদিন কেঁদেছিলেন, ২৮ বছরের শিরোপাখরা কাটে আলবিসেলেস্তেদের। গোটা আসরে চার গোল ও পাঁচটি অ্যাসিস্ট করেন ক্ষুদে জাদুকর, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে রক্তাক্ত হয়েও ছাড়েননি হাল। দলের সকল সদস্যকে মারাত্মক অনুপ্রাণিত করে তার এই হার না মানা মনোবল।
মহাদেশীয় এই অর্জন বদলে দেয় গোটা দলকে। আত্মবিশ্বাসে টগবগ করতে শুরু করে তারা, বিশ্বকাপ বাছাইয়ে দেখা মিলে অদম্য আর্জেন্টিনার। উয়েফা কাপ অব নেশন্সের ফাইনালেও হেসে খেলে হারায় ইতালিকে। ফলে কাতারে মেসির দলের সঙ্গী হবে টানা ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকার আত্মবিশ্বাস। আগুনে ফর্মে আছেন মেসিও, তার ভাবনার পুরোটা জুড়েই এখন কেবল আর্জেন্টিনা। সাতটি ব্যালন ডি অর ও চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পর একটি বিশ্বকাপ তো জিততেই পারেন লা পুল্গা। মরুর বুকে মেসির হাতে উঠলে যেন স্বার্থকতা পাবে সোনায় মোড়ানো ট্রফিও।
Comments