রোনালদো: সেরার বিতর্কের ইতি টানতে পারে একটি বিশ্বকাপ

ছবি: সংগৃহীত

মরুর বুকে আসন্ন বিশ্বকাপ ইতোমধ্যে উত্তাপ ছড়াচ্ছে গোটা বিশ্বে। আর মাত্র একদিনের অপেক্ষা। এরপরই 'গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ' এক মাসের জন্য মাতিয়ে রাখবে ফুটবলপ্রেমীদের। এবারের আসর নিয়ে যেমন উত্তেজনা-রোমাঞ্চের প্রত্যাশা থাকছে, তেমনি তা হতে চলেছে আবেগেরও। অনেক মহাতারকার বিশ্বজয়ের স্বপ্ন পূরণের শেষ সুযোগ এবার। তাদের কেউ হাসবেন বিজয়ীর হাসি, কেউ বাড়ি ফিরবেন সকলকে কাঁদিয়ে। পর্তুগালের ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো দোস সান্তোস অ্যাভেইরো তার পরম আকাঙ্ক্ষিত বিশ্বকাপ ট্রফিটা পারবেন উঁচিয়ে ধরতে?

আন্তর্জাতিক ফুটবলের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা রোনালদো বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলেছিলেন মাত্র ২১ বছর বয়সে। ২০০৬ সালের আসরে শিরোপার বেশ কাছ থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল তাকে। সেবার জার্মানিতে অনুষ্ঠিত আসরে পর্তুগাল হয়েছিল চতুর্থ। এরপর ২০১০, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আরও তিনবার তিনি গেছেন ফুটবলের সর্বোচ্চ মর্যাদার মঞ্চে। কিন্তু শেষ ষোলো পার হতে পারেননি একবারও, সঙ্গে আছে ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ার কষ্ট। ৩৭ বছর বয়সী কিংবদন্তি এসে পড়েছেন ক্যারিয়ারের শেষলগ্নে। এবার বিশ্বকাপ জয়ের লক্ষ্য পূরণ না হলে আর কবে? হয়ত সেই প্রশ্নই করে ফিরছেন নিজেকে।

ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলোর নজরে তরুণ রোনালদো এসেছিলেন নিজ দেশের ক্লাব স্পোর্টিং সিপির হয়ে আলো ছড়িয়ে। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন বুঝে ফেলেছিলেন, ছেলেটি একদিন শাসন করবে ফুটবল বিশ্ব। যত দ্রুত সম্ভব তিনি দলে ভেড়ান রোনালদোকে। ২০০৩ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে নাম লিখিয়ে পরের ছয় বছর ফার্গুসনের আস্থার প্রতিদান দেন সিআর সেভেন। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে পাড়ি জমানোটা আশীর্বাদ বয়ে এনেছিল তার জন্য। মাত্র আট দিনের মাথায় অভিষেক হয় জাতীয় দল পর্তুগালের জার্সিতে।

ছবি: এএফপি

পর্তুগালের হয়ে যাত্রা শুরুর এক বছরের মাথায় ইউরোর দলেও জায়গা করে নেন রোনালদো। লুইস ফিগোর নেতৃত্বাধীন দল সেবার ফাইনালে গিয়ে হারে গ্রিসের বিপক্ষে। দুই গোল ও দুই অ্যাসিস্ট করেছিলেন উদীয়মান রোনালদো। বছরের বাকি অংশেও আলো ছড়ান, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের পাঁচ ম্যাচে করেন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের সমান সংখ্যক গোল ও অ্যাসিস্ট। ফলে ২০০৬ আসরের দলে জায়গা পাওয়াটা অনুমিতই ছিল রোনালদোর। সেই আসরে পর্তুগাল সেমিফাইনাল খেললেও নিজের প্রথম বিশ্বকাপ রাঙাতে পারেননি তিনি।

ইউনাইটেডের হয়ে ২০০৬-০৭ মৌসুম থেকে খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসতে শুরু করে রোনালদোর সেরাটা। সেবার রেড ডেভিলদের হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৫৩ ম্যাচ খেলে ২৩ গোল করেন তিনি। সঙ্গে ছিল ১৪ অ্যাসিস্টও। পরের মৌসুমে হয়ে ওঠেন ভয়ঙ্কর। প্রিমিয়ার লিগে ৩৪ ম্যাচে করেন ৩১ গোল। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতে নেয় ম্যান ইউনাইটেড। দলের সাফল্যে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম ব্যালন ডি'অর জিতে নেন পর্তুগিজ তারকা, ২০০৮ সালে।

জাতীয় দলের জার্সিতে অবশ্য সেই বছর খুব একটা ভালো কাটেনি রোনালদোর। ইউরোর শেষ আটেই থেমে যায় পর্তুগিজরা। তবে ২০০৮-০৯ মৌসুম শেষে নতুন দিকে মোড় নেয় রোনালদোর ক্যারিয়ার, তৎকালীন বিশ্বরেকর্ড ৯৪ মিলিয়ন ইউরোতে স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদে নাম লেখান তিনি। প্রথম বছরেই লা লিগায় ২৯ ম্যাচে ২৬ গোল করে দেন লস ব্লাঙ্কোদের আস্থার প্রতিদান। মৌসুম শেষে বিশ্বমঞ্চে তার নেতৃত্বে খেলতে যায় পর্তুগাল। রোনালদোর মতোই বিবর্ণ এক বিশ্বকাপ কাটায় গোটা দল, এক উত্তর কোরিয়া ছাড়া আর কারো জালেই সেবার বল পাঠাতে পারেনি তারা।

এই ব্যর্থতা ঝেড়ে সিআর সেভেন ক্লাবে ফিরে হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। স্প্যানিশ লিগে ৩৪ ম্যাচে করেন ৪০ গোল। ২০১১-১২ মৌসুমে ছাপিয়ে যান এই পরিসংখ্যানও, ৩৮ ম্যাচে ৪৬ গোল দিচ্ছে সেটারই প্রমাণ। প্রথমবারের মতো সেই মৌসুমেই লা লিগার শিরোপা জিতেন রোনালদো। ২০১২ ইউরো জিতে নিলে বছরটাই হয়ে যেত তার। কিন্তু সেমিতে স্পেনের বিপক্ষে পেনাল্টিতে হেরে আক্ষেপে পুড়তে হয় এই মহাতারকাকে। পরের মৌসুমে ৫৫ ম্যাচে ৫৫ গোল করে তিনি পেয়ে যান দ্বিতীয় ব্যালন ডি'অর, দারুণভাবে প্রলেপ পড়ে তার ক্ষতে।

২০১৩-১৪ মৌসুমে রিয়ালের হয়ে প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতেন রোনালদো। ১১ ম্যাচে ১৭ গোল করে ছিলেন আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা। এই অর্জন ফের ব্যালন ডি'অর এনে দেয় তাকে। তবে মৌসুম শেষের বিশ্বকাপটা ভুলে যেতেই চাইবেন পর্তুগিজ কিংবদন্তি। সেই আসরে গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে যায় তার দল। পরের বছরও লা লিগায় ৩৫ ম্যাচে ৪৮ গোল করে তিনি ছিলেন আপন মহিমায় উজ্জ্বল।

২০১৫-২০১৮ পর্যন্ত স্বপ্নের মতো তিনটি মৌসুম কাটান সিআর সেভেন। টানা তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা ও আরও দুটি ব্যালন ডি'অর যোগ হয় তার নামের পাশে। তিনি জেতেন দ্বিতীয় লা লিগার শিরোপাও। এই সময়ে জাতীয় দলের জার্সিতে রোনালদোর জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল অধিনায়ক হিসেবে ২০১৬ ইউরো জয়। আন্তর্জাতিক মঞ্চে এটি ছিল তার প্রথম শিরোপা। পরের বছর পর্তুগাল খেলে কনফেডারেশন্স কাপের সেমিফাইনাল। ২০১৮ সালে স্পেনের পাঠ চুকিয়ে ইতালিয়ান পরাশক্তি জুভেন্তাসে যোগ দেন তিনি।

সেই বছরের রাশিয়া বিশ্বকাপে অন্যতম ফেভারিট হিসেবে গিয়েও প্রত্যাশার পালে হাওয়া দিতে পারেনি পর্তুগাল। তাদেরকে থামতে হয় শেষ ষোলোতে। রোনালদো হ্যাটট্রিকসহ চার গোল করলেও বাকিরা পারেননি জ্বলে উঠতে। ২০২০ ইউরোতেও আসরের সর্বোচ্চ পাঁচ গোল করে একাই দলকে টানার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সে যাত্রাতেও প্রত্যাশিত সমর্থন পাননি তিনি। ফলে শেষ ষোলোতে বেলজিয়ামের বিপক্ষে হেরে তাদের ছিটকে যেতে হয়।

ছবি: এএফপি

গত ২০২১-২২ মৌসুমে স্বপ্নের দলবদলে রোনালদো ফেরেন ম্যান ইউতে। প্রথম মৌসুমে তিনি ব্যক্তিগত সাফল্য পেলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয় ইউনাইটেড। তাই সবশেষ গ্রীষ্মকালীন দলবদলে ক্লাব ছাড়তে মরিয়া হন রোনালদো। তবে ইউরোপের বড় বড় ক্লাব আগ্রহ না দেখানোয় সফল হননি। চলতি মৌসুমের শুরু থাকে ইউনাইটেডের নতুন কোচ এরিক টেন হাগের সঙ্গে চলছে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন। বিবর্ণ পারফরম্যান্স তিনি জায়গা হারিয়েছেন শুরুর একাদশে। সম্প্রতি তিনি দিয়েছেন বিস্ফোরক এক সাক্ষাৎকার। এতে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ক্লাব কর্তৃপক্ষ।

সব মিলিয়ে একাধিক বিতর্ক সঙ্গী করে বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাব্য শেষ অভিযান শুরু করবেন ৩৭ বছর বয়সী রোনালদো। যদিও বাছাইপর্ব থেকেই ছিটকে যাওয়ার শঙ্কায় ছিল পর্তুগাল। শেষ পর্যন্ত তুরস্ক ও উত্তর মেসিডোনিয়াকে হারিয়ে ফুটবলের মহাযজ্ঞের টিকিট নিশ্চিত করে পর্তুগিজরা।

ওই সাক্ষাৎকারের পর অনেক সাবেক ফুটবলার ও বিশ্লেষকদের সমালোচনা ধেয়ে আসছে রোনালদোর দিকে। বিতর্কের আগুনে জল ঢালার একমাত্র উপায় যে সোনালী ট্রফিটা জয়, সেটা নিশ্চয়ই জানা আছে তার। একইসঙ্গে সেরার প্রশ্নের ইতি টানার সুবর্ণ সুযোগও পাঁচবারের ব্যালন ডি'অর জয়ী এই ফরোয়ার্ডের সামনে। গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে লিওনেল মেসির সঙ্গে চলছে তার দ্বৈরথ। বিশ্বকাপ জিততে পারলে সর্বোচ্চ দলীয় সাফল্য অর্জনে আর্জেন্টাইন অধিনায়ককে পেরিয়ে যাবেন রোনালদো। এতে তর্কসাপেক্ষে সময়ের সেরার পাশাপাশি ইতিহাসের সেরা ফুটবলারের আসনেও বসার জন্য বিবেচিত হবেন তিনি।

আসন্ন কাতার বিশ্বকাপে সেরার মুকুট উঁচিয়ে ধরতে পারবেন রোনালদো? অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ফুটবলপ্রেমীদের।

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

5h ago