ম্যাক্সওয়েলের পাগলামিতে অস্ট্রেলিয়ার অবিশ্বাস্য জয়
অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!
মুম্বাইয়ে যা হয়েছে, অগণিতবার অবিশ্বাস্য বলেও কী বুঝানো যাবে? ৯১ রানে ৭ উইকেট তুলে নিয়ে আফগানিস্তানই জয়ের গন্ধ পাচ্ছিল। কিন্তু দৌড়াতে না পারা, ব্যথায় কাতরানো গ্লেন ম্যাক্সওয়েল হার মানেননি। বিগ শোর 'ওয়ান ম্যান শো' চলতে থাকে। ২০১ রানের অপরাজিত ইনিংসে ম্যাক্সওয়েলের পাগলামিতে অস্ট্রেলিয়া পেয়ে যায় অবিশ্বাস্য জয়!
৯১ রানে সপ্তম উইকেট হারানোর পর প্যাট কামিন্সকে নিয়ে জুটি বাঁধেন ম্যাক্সওয়েল। চতুর্থ উইকেটের পর নামা ম্যাক্সওয়েল একের পর এক সঙ্গীকে হারানোর পর শুরু করেন তাণ্ডব। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যেমন হয়! ম্যাক্সওয়েল খেলতে থাকেন বড় বড় শট। মুজিব উর রহমান, নূর আহমেদদের ছক্কা-চার মারতে থাকেন। ৫১ বলে ফিফটি পেয়ে যাওয়ার পর শুরু করেন ধুন্ধুমার মার। আফগানিস্তানের বোলাররা পথ হারিয়েই ফেলেছিল যেন! ভয়ঙ্কর ম্যাক্সওয়েল এতটাই আতঙ্ক ছড়াচ্ছিলেন যেন হিংস্র বাঘ খাঁচা থেকে ছাড়া পেয়েছে।
ফিফটির পর সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ৭৬ বলে। ফিফটির পর পরের পঞ্চাশ আনতে নেন মাত্র ২৫ বল। ম্যাক্সওয়েলের ব্যাটে অস্ট্রেলিয়া অসাধ্য সাধনের আশা দেখতে পায়। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় ক্র্যাম্প, সেঞ্চুরির পরেই ভুগতে দেখা যায় ডানহাতি এই ব্যাটারকে। এরপর ১৪৭ রানে চলে যাওয়ার পর অবস্থা বেগতিক হয়ে যায়। অ্যাডাম জ্যাম্পা চলে এসেছিলেন বাউন্ডারি লাইনের কাছে। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল মাঠ থেকে উঠেননি। দৌড়াতে না পারলেও জায়গায় দাঁড়িয়ে চালাতে থাকেন তাণ্ডব। জিরো বডি মুভমেন্টে শুধু হাতের জাদু দেখাতে থাকেন। কব্জির জোর আর পাওয়ারে ঝড় চালিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দেন আফগানিস্তানকে। আফগান বোলাররা অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। অথচ ৩৩ রানেই ফিরতে পারতেন ম্যাক্সওয়েল। শর্ট ফাইন লেগে মুজিবের হাত ফসকে বেরিয়ে যায় তার লোপ্পা ক্যাচটি। ম্যাক্সওয়েলের প্রতিটি বাউন্ডারি সেই ক্যাচের আক্ষেপের যে আগুন, তাতে তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
ম্যাক্সওয়েলের ব্যাটে শেষ একশর বেশি রানে তারা এগিয়ে যেতে থাকে বলপ্রতি রানে থেকে। একপাশে কামিন্স সঙ্গ দেন শুধু টিকে থেকে। শেষমেশ ৬৮ বলে ১১ রান করে একপাশে থাকেন কামিন্স। এক পায়ে ভর করে ব্যাট করা ম্যাক্সওয়েলের উইকেটটা আর বের করতেই পারেনি আফগানিস্তান। ১৯ বল বাকি থাকতেই অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ জিতে নেয় অবিশ্বাস্যভাবে। ১২৮ বলে ২০১ রানে অপরাজিত থাকেন ম্যাক্সওয়েল, ২১টি চারের সাথে ১০টি ছক্কা আসে তার ব্যাট থেকে।
অথচ চার স্পিনার নিয়ে নামা আফগানরা অস্ট্রেলিয়ার বুকে পাথর ফেলে দেয় শুরুতে পেস দিয়েই। নাভিন উল হক দ্বিতীয় ওভারেই কিপারে ক্যাচ বানিয়ে শূন্য রানে ফিরিয়ে দেন ট্রাভিস হেডকে। ৪ রানে প্রথম উইকেট হারানো অজিরা বিপদ বাড়তে দেয়নি এরপর। ষষ্ট ওভারে চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়া অজিরা কী জানত, বিপদের কতটুকু বাকি! নাভিনকে চারের পর ছক্কা মারেন মিচেল মার্শ। আগ্রাসী ভঙ্গিতে খেলা মার্শ ১০ বলেই পৌঁছে যান ২৪ রানে। দুই বাউন্ডারি খেয়ে এরপর দুর্দান্তভাবে ফিরে আসেন নাভিন। তার ভেতরে আসা বলে এলবিডাব্লিউ হয়ে যখন ফিরে যান মার্শ, তখন ৪৩ রানে অস্ট্রেলিয়া হারায় দ্বিতীয় উইকেট।
এরপর রানের খাতা যেন স্থিরই থেকেছে, উইকেটের ঘরে দৌড় চলেছে! সুইং পেয়ে আফগান পেসাররা আতঙ্ক ছড়িয়ে দেন৷ আজমতউল্লাহ ওমরজাই দুর্দান্ত ইনসুইঙ্গারে বোল্ড করে দেন ওয়ার্নারকে। ২৮ বলে ১৯ রান করে ওয়ার্নারকে ফেরান। পরের বলেই ওমরজাইয়ের আউটসুইং ডেলিভারিতে জস ইংলিসকে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে একই পথ ধরেন। টানা দুই বলে দুই উইকেট হারিয়ে ৪৯ রানেই চতুর্থ উইকেট খুইয়ে ফেলে অজিরা।
৫২ রানে পাওয়ারপ্লে শেষ করা অস্ট্রেলিয়া মারনাস লাবুশেন ও গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ব্যাটে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের জুটি বিশ রানের বড় হওয়ার আগেই ভেঙে যায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে। শর্ট মিডউইকেট থেকে রহমতের করা ডিরেক্ট থ্রোতে রানআউট হয়ে ফিরেন লাবুশেন। ৬৯ রানেই অর্ধেক উইকেট হারিয়ে ফেলা অস্ট্রেলিয়ার স্পিন পরীক্ষার সবে শুরু। রশিদ তার দ্বিতীয় ওভারেই এসে মার্কাস স্টয়নিসকে ফিরিয়ে দেন।
রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে এলবিডাব্লিউ হয়ে যাওয়া স্টয়নিস ফিরেন ৬ রানে। তখন ৮৭ রানে থাকা অস্ট্রেলিয়া ৯১ রানে থাকতেই সপ্তম উইকেট হারিয়ে ফেলে। রশিদের বলে উইকেটরক্ষক ইকরাম আলী খিলের দারুণ ক্যাচে স্টার্ক আউট হন ৩ রানে। এরপর উইকেটের এক নজর দেখতে পায়নি আফগানরা। ম্যাক্সওয়েল ম্যাজিকে তিন উইকেটের জয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলে অজিরা। ৮ ম্যাচে ১২ পয়েন্টে পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়া, সেখানে ৮ ম্যাচে ৮ পয়েন্টেই থাকে আফগানিস্তান।
মঙ্গলবার টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়া আফগানিস্তান ধীরস্থির ব্যাটিংয়ে ভালো শুরু করে। ছন্দে থাকা রহমানুল্লাহ গুরবাজের যদিও হুট করেই ছন্দপতন ঘটে। স্কয়ার লেগে ক্যাচ দিয়ে গুরবাজ ফিরে যান ২৫ বলে ২ চারে ২১ রান করে। তার ওপেনিং সঙ্গী ইব্রাহিম জাদরানের অবশ্য দেখেশুনে খেলে যান। আফগানরা পাওয়ারপ্লে শেষ করে ৪৬ রানে।
ইব্রাহিম অতিরিক্ত ঝুঁকি না নিয়ে নিজের শক্তির জায়গায় থাকেন। স্ট্রাইক রোটেটের উপর গড়ে উঠা তার ইনিংসে বাউন্ডারিও আসে মাঝেমধ্যে। ৬২ বলে ফিফটি পূর্ণ করে ফেলেন এই ডানহাতি। ওয়ান ডাউনে নামা রহমত শাহ মন্থরগতিতে শুরু করেন। ২০.২ ওভারে তবু একশ পেরিয়ে যায় আফগানিস্তান। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অফ স্পিনেও তারা অতটা আগ্রাসী ভূমিকায় যাননি। শতরানের পর রানের গতি কমে আসে তাই কিছুটা। রহমত যখনই এরপর গিয়ার পাল্টাতে গেছেন, মরণ দেখা দেয় তাকে। ম্যাক্সওয়েলের বলে তুলে মারতে গিয়ে সোজা লং অফের হাতে ক্যাচ দিয়ে ৪৪ বলে ৩০ রানে আউট হন রহমত।
১২১ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারানো আফগানরা এগিয়ে যায় ইব্রাহিমের সাথে হাসমতউল্লাহ শহিদির জুটিতে। কিন্তু অধিনায়ক শহিদিকে অজিরা বেধে রাখে শর্ট বলের ঘেরাটোপে ফেলে। ৭৩ বলে পঞ্চাশের জুটি হয়ে যায় তাদের। কিছুটা ভোগান্তিতে থাকা শহিদি রানের গতি বাড়ানোর প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান স্টার্কের বলে। ৪৩ বলে ২৬ রানে শহিদি আউট হওয়ার পর আজমতউল্লাহ ওমরজাই এসে আক্রমণের রঙ মাখান আফগানিস্তান ইনিংসে। তৃতীয় বলেই স্টার্ককে মারেন ছক্কা, এরপর অ্যাডাম জ্যাম্পাকে আরেকটি ছক্কার সাথে দুটি চারও আসে তার ব্যাট থেকে। ৪১তম ওভারে দুইশ পেরিয়ে যায় আফগানরা। কিন্তু ১৭ বলে ২২ রানে থাকা ওমরজাই আবার মারতে যান, ধরা খেয়ে যান বাউন্ডারিতে।
একপাশে ইব্রাহিম খেলতে থাকেন সমানতালে। ৪৪তম ওভারে শতক পেয়ে যান ১৩১ বলে। প্রথম ফিফটির পর পরের পঞ্চাশ করতে ইব্রাহিম নেন ৬৯ বল। গিয়ার পাল্টে সেঞ্চুরির পর ৩ ছক্কায় ১২ বলে আনেন ২৯ রান। ১২ রানে মোহাম্মদ নবি ২৩৩ রানে দলকে রেখে চলে যাওয়ার পর আসেন রশিদ খান। ৩ ছক্কা ও ২ চারের সাথে খেলেন ১৮ বলে ৩৫ রানের ক্যামিও। তাদের দুজনে মিলে শেষ চার ওভারে আনেন ৫৫ রান। শেষের ঝড়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া আফগান ইনিংসে শেষ দশ ওভারে আসে ৯৬ রান। ইনিংস উদ্বোধনে নামা ইব্রাহিম অপরাজিত থাকেন ১৪৩ বলে ৮ চার ও ৩ ছক্কায় ১২৯ রানের ইনিংস খেলে। তার সে ইনিংস যদিও আড়ালে পড়ে যায় ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা এক ইনিংসের বদৌলতে।
Comments