রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে ভারতকে প্রথম হারের স্বাদ দিল দক্ষিণ আফ্রিকা
উত্তেজনার আঁতুর ঘরে পরিণত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। দিনের শুরুতে বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের ম্যাচে হলো তুমুল লড়াই। এরপর ভারতের মামুলি লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুর বিপর্যয়ে হারের শঙ্কায় পড়ল দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে শেষ পর্যন্ত এইডেন মার্করাম ও ডেভিড মিলারের ব্যাটে পরাস্ত হতে হলো রোহিত শর্মার দলকে।
রোববার পার্থে সুপার টুয়েলভের দুই নম্বর গ্রুপের খেলায় ভারতকে ৫ উইকেটে হারিয়েছে টেম্বা বাভুমার দল। ১৩৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে পাওয়ারপ্লেতেই ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলে প্রোটিয়ারা। এরপর মার্করাম-মিলারের ফিফটিতে তা কাটিয়ে উঠে ২ বল বাকি থাকতে জয় নিশ্চিত করে তারা।
শেষদিকে ঝড় তুলে ভারতের পরাজয় ত্বরান্বিত করেন 'কিলার মিলার' (৫৯*)। ৫২ রানের ইনিংস খেলে এই জয়ে ভূমিকা রাখেন মার্কারামও। আগে ব্যাট করে শুরু থেকেই নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে ভারত। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সুরিয়াকুমার যাদব খেলেন ৪০ বলে ৬৮ রানের ইনিংস। তিনি ছাড়া তারকাখচিত ব্যাটিং লাইনআপের বাকিরা ব্যর্থ হলে কোনমতে রোহিতের দল পায় ৯ উইকেটে ১৩৩ রানের পুঁজি। তাদের ব্যাটিংয়ে ধস নামান লুঙ্গি এনগিডি ও ওয়েইন পার্নেল।
বল হাতে দক্ষিণ আফ্রিকার মতোই দারুণ সূচনা করে ভারত। দ্বিতীয় ওভারেই কুইন্টন ডি কক ও রাইলি রুশোকে ফেরত পাঠান আর্শদ্বীপ সিং। ২৩ বছর বয়সী বাঁহাতি পেসারের আউট স্যুইংয়ে পরাস্ত হন প্রোটিয়া উইকেটরক্ষক। তিন বল থেকে এক রান করে বিদায় নেন কক। ওভারের তৃতীয় বলে এলবিডব্লিউর আপিল করেন আর্শদ্বীপ, কিন্তু আম্পায়ার প্রথমে সাড়া দেননি তাতে। রোহিত শর্মা বিচক্ষণতার পরিচয় দেন এই পরিস্থিতিতে।
আর্শ্বদ্বীপ সায় না দিলেও নেন রিভিউ, টিভি রিপ্লেতে দেখা যায় নিয়ম মেনেই বল আঘাত হেনেছে স্ট্যাম্পে। বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি হাঁকানো রুশো ফিরে যান শূণ্য রানেই। তিন রানে দুই উইকেট হারানো দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে ফেরার স্বপ্ন দেখছিল এইডেন মার্কারাম ও অধিনায়ক বাভুমার ব্যাটে। তবে অস্ট্রেলিয়ায় বরাবরই দারুণ বল করা মোহাম্মদ শামি আঘাত হানেন ভারতের হয়ে।
স্কুপ করতে গিয়ে উইউকেটরক্ষক দিনেশ কার্তিককেই ক্যাচ দিয়ে বসেন বাভুমা, সমাপ্তি ঘটে তার ১৫ বলে করা ১০ রানের ইনিংসের। পাওয়ার প্লে শেষে আফ্রিকার সংগ্রহ দাঁড়ায় ৩ উইকেট হারিয়ে ২৪ রান। মার্কারাম টেনে নিতে থাকেন তাদের দলীয় সংগ্রহ। অপর প্রান্তে মিলার শুরু করেন ঠান্ডা মেজাজে। দারুণ বল করে বারবারই আউটের সম্ভাবনা জাগাচ্ছিলেন শামি। তার করা অষ্টম ওভারে দুইবার এলবিডব্লিউর আপিল করে ভারত।
ভারতীয় বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ক্রমেই বাড়তে থাকে প্রোটিয়াদের প্রয়োজনীয় রান রেট। প্রথম দশ ওভারে স্কোরবোর্ডে মাত্র ৪০ রান যোগ করতে সক্ষম হয় তারা। তবে হার্দিক পান্ডিয়ার ১১তম ওভারে খেলার ধরণ বদলে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন মিলার। সেই ওভার থেকে আসে ১৬ রান।
ভারতের সামনে সুযোগ ধরা দিয়েছিল রবীচন্দ্রন অশ্বিনের পরের ওভারে। ডিপ মিডউইকেটে মার্কারামের ক্যাচ ফেলে দেন সময়ের অন্যতম সেরা ফিল্ডার বিরাট কোহলি। ৩৫ রানে জীবন পান ২৮ বছর বয়সী প্রোটিয়া ব্যাটার। শামির পরের ওভারে আবারও রান আউটের সহজ সুযোগ নষ্ট করে ভারত। কাপ্তান রোহিত ব্যর্থ হন সরাসরি থ্রোতে স্ট্যাম্প ভাঙতে।
অশ্বিনের ১৪তম ওভারে দুই ছক্কায় ১৭ রান আদায় করে নেন মিলার-মার্কারাম। আর্শ্বদ্বীপের ওভারেও আসে দশ রান। পঞ্চম বল হাওয়ায় ভাসিয়েছিলেন মার্কারাম, কিন্তু ডিপ মিডউইকেট ও ডিপ স্কোয়ার লেগের মাঝামাঝি দুজন ফিল্ডারকে ফাঁকি দিয়ে সে যাত্রা বেঁচে যান তিনি। দুবার প্রান্ত বদল করে পেয়ে যান ফিফটিও। তবে এরপরই তাকে ফিরিয়ে ভারতকে খেলায় ফেরানোর সম্ভাবনা তৈরি করেন হার্দিক।
ভারতীয় অলরাউন্ডারের শর্ট বলে আবারও পুল করলে সুরিয়াকুমারের হাতে ধরা পড়েন সদ্য অর্ধশতক পূর্ণ করা মার্কারাম। ৪১ বলে ৫২ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে বিদায় নেন তিনি। সমাপ্তি ঘটে ৬০ বলে ৭৬ রানের চতুর্থ উইকেট জুটির। শেষ চার ওভারে আফ্রিকার জয়ের জন্য দরকার পড়ে ৩২ রান। ১৮তম ওভারের প্রথম দুই বলে অশ্বিনকে ছক্কা হাঁকিয়ে রান বলের ব্যবধান নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসেন মিলার।
তবে নাটকীয়তার বাকি ছিল তখনও। এক বল বাদেই ত্রিস্টান স্টাবসকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে আউট করেন অশ্বিন। ছয় বলে ছয় রান করে ফিরে যান এই মিডল অর্ডার ব্যাটার। ১৯তম ওভারের প্রথম বলে বাউন্ডারি হজম করলেও এরপর সামলে নেন শামি। খেলা গড়ায় শেষ ওভারে। ছয় বলে ছয় রানের সমীকরণে ভুবনেশ্বরে আস্থা রাখেন রোহিত।
প্রথম দুই বলে মাত্র এক রান এলেও পরের দুই বলে টানা দুই চারে খেলার সমাপ্তি ঘটান মিলার। ৪৬ বলে ৫৯ রান করে অপরাজিত থাকেন তিনি। অপর প্রান্তে দুই বল থেকে পাঁচ রান করে টিকে ছিলেন ওয়েইন পার্নেল। ভারতীয় বোলারদের মধ্যে দুই উইকেট নেন আর্শদ্বীপ, একটি করে উইকেট ঝুলিতে পোরেন শামি, হার্দিক ও অশ্বিন।
এর আগে টসে জিতে ব্যাটিং নেয় ভারত। তবে প্রথম নয় বলে কোন রান করতে পারেনি তারা। কাগিসো রাবাদাকে ছক্কা হাঁকিয়ে ব্যক্তিগত ও দলীয় রানের খাতা খোলেন রোহিত। পরের ওভারেও পার্নেলকেও ছক্কা হাঁকান লোকেশ রাহুল। তবে পঞ্চম ওভারে দুজনকেই তুলে নেন এনগিডি। রোহিত ১৫ ও রাহুল নয় রান করে বিদায় নেন।
এক ওভার বাদে কোহলিকেও আউট করে ভারতের টপ অর্ডার গুড়িয়ে দেন ২৬ বছর বয়সী এনগিডি। মাত্র ১২ রান আসে তার ব্যাট থেকে। পাওয়ারপ্লেতে দুই উইকেটের বিনিময়ে কেবল ৩৩ রান করতে সক্ষম হয় ভারত। সতীর্থকে দেখে উইকেট শিকারের ভূত চেপে বসে আনরিখ নরকিয়ার ওপরেও দীপক হুডাকে কট বিহাইন্ড বানিয়ে ফেরত পাঠান তিনি। পরের ওভারে এনগিডির চতুর্থ শিকারে পরিণত হন হার্দিক (২), ৪৯ রানে চতুর্থ উইকেট হারায় ভারত।
এরপর দিনেশ কার্তিকের সঙ্গে ৫২ রানের জুটি গড়ে ড্রেসিংরুমে কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনেন সুরিয়াকুমার। নিজের স্বভাবসুলভ ব্যাটিংয়ে মাত্র ৩০ বলে ফিফটি সম্পূর্ণ করেন ৩২ বছর বয়সী এই আক্রমণাত্মক ব্যাটার। তবে ১৫তম ওভারে নিরাশ করেন কার্তিক, ১৫ বলে মাত্র ছয় রান করে পার্নেলের শিকার বনে যান তিনি। তবু চালিয়ে যাচ্ছিলেন যাদব, শেষ পর্যন্ত তাকে থামান পার্নেল।
১৯তম ওভারে অশ্বিন ও যাদবকে তুলে নেন এই বাঁহাতি প্রোটিয়া পেসার। তার বিদায়ে শেষ হয় ভারতের মাঝারি পুঁজির স্বপ্ন। তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৯ উইকেটে ১৩৩ রান। নরকিয়ার শেষ ওভারে আসে ছয় রান, রান আউট হন শামি। চার উইকেট নিয়ে প্রোটিয়া বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিলেন এনগিডি। এই পারফরম্যান্স তাকে এনে দেয় ম্যাচসেরার পুরস্কার। তিনটি উইকেট নেন পার্নেল, নরকিয়ার শিকার একটি।
Comments