বাণিজ্যিক যানবাহন খাতের যত সমস্যা

২০২২ সালের মার্চে দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাণিজ্যিক যানবাহনের অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার ২০১০ সালে ২ হাজার কোটি টাকা থেকে ২০২১ সালে প্রায় ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। অর্থাৎ, গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। রাস্তা এবং অবকাঠামো সুবিধার উন্নতি অব্যাহত থাকার কারণে এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় বলে বিশ্লেষকরা মত দেন।
বাণিজ্যিক ট্রাক। প্রতিকী ছবি
বাণিজ্যিক ট্রাক। প্রতিকী ছবি

মূলত সড়ক অবকাঠামো ও শিল্প খাতের উন্নয়নের কারণে গত এক দশকে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক যানবাহনের বাজারে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। তবে এই খাত বর্তমানে ধারাবাহিকভাবে দাম বেড়ে যাওয়া, বিক্রি কমে যাওয়া ও বিভিন্ন আইনের সংস্কারের কারণে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।

২০২২ সালের মার্চে দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাণিজ্যিক যানবাহনের অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার ২০১০ সালে ২ হাজার কোটি টাকা থেকে ২০২১ সালে প্রায় ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। অর্থাৎ, গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। রাস্তা এবং অবকাঠামো সুবিধার উন্নতি অব্যাহত থাকার কারণে এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় বলে বিশ্লেষকরা মত দেন।

বাণিজ্যিক যানবাহনের চাহিদার বড় একটি অংশ আসে পোশাক শিল্পখাত থেকে। শিল্প বিশ্লেষকদের মতে, ২০২২ সালে হালকা বাণিজ্যিক যানবাহন (এলসিভি) বাজারের আকার প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায় পৌঁছে। যেখানে, গত ৩ বছরে গড়ে ১১ হাজার করে এলসিভি বিক্রি হয়। বাণিজ্যিক যানবাহনের বাজারের ৪২ শতাংশ দখল করে আছে এই এলসিভি। ২০২২ সালে বিক্রি আরও ৬ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় মার্কেট শেয়ারের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৫ শতাংশ।

এই খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মতে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে নতুন ট্রাকের বার্ষিক বিক্রয় ২০ হাজার ইউনিটে পৌঁছেছে, যার মধ্যে ১০ হাজারটিই হচ্ছে এলসিভি। বিভিন্ন ধরনের ট্রাকের মধ্যে ৩ থেকে ৭ টন ওজনের মাঝারি বাণিজ্যিক যান (এমসিভি) মহাসড়কে চলার জন্য বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু শহরে একটি নির্দিষ্ট সীমার যানবাহন চালানোর আইন আছে বিধায় এখানে এলসিভির চাহিদাও যেমন বেশি, তেমনি বাজারে প্রতিযোগিতাও কম নয়।

অন্যদিকে ট্রাকের ক্ষেত্রে বাজারে বিকল্প কম থাকায় ট্রাকবহরের মালিকরা ভোগান্তিতে পড়েন। তবে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান টাটা মোটরস এক্ষেত্রে অনেক ধরনের বৈচিত্র্যময় মডেল নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশে টাটা মোটরসের প্রধান পরিবেশক নিটল-নিলয় গ্রুপ। দেশে বাণিজ্যিক যানবাহন বাজারের ৩১ শতাংশই নিটল-নিলয়ের হাতে, যা এককভাবে সর্বোচ্চ। এলসিভি বাজারে প্রধানত টাটা, মাহিন্দ্রা, অশোক লেল্যান্ডের মতো ভারতীয় গাড়ি নির্মাতাদের এবং সেই সঙ্গে জেএসি ও ফোটনের মতো চীনা ব্র্যান্ডগুলোর আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। এসব ব্র্যান্ড বাজারের প্রায় ৮৩ শতাংশ দখল করে আছে। ফোটন ট্রাক মাত্র ৩ বছরেই ১০ শতাংশ বাজার দখল করতে সক্ষম হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, গত ২ বছরে এই বাজারে বেশ অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০২২ সালে ডলারের বিনিময় হার ও জ্বালানীর দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি কমে যায়। যার ফলে ২০২২ সালে যানবাহন বিক্রি প্রায় ২২ শতাংশ কমেছে। বিশেষ করে, হেভি-ডিউটি ট্রাক বিক্রির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। নিটল নিলয় গ্রুপের মতে, তাদের হেভি-ডিউটি ট্রাক বিক্রি প্রায় ৪৮ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৪ হাজার ৫২৮টি ট্রাকের নিবন্ধন হয়। অথচ, আগের বছরে নিবন্ধন হয়েছিল ৫ হাজার ৭৮৯টি ট্রাক।

এসিআই মোটরস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস এই শিল্পে শৃঙ্খলার অভাবকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা, চালকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও বেতন এবং শ্রম ঘণ্টা নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেন। তার মতে, সীমিত সড়ক অবকাঠামোর ওপর চাপ কমাতে এবং সামগ্রিক সড়ক নিরাপত্তা উন্নত করতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, চলাচল এবং যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা বাস্তবায়ন  কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

আরেকটি বড় সমস্যা হল ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার অপর্যাপ্ত সুবিধা, যা ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। তার ওপর, প্রায় ১০ শতাংশ যানবাহন মালিক ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। যার ফলে তাদের যানবাহন ব্যাংক ফেরত নিয়ে নেয়।

বর্তমানে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ওপরও কোনো চাপ নেই এবং প্রচলিত কর কাঠামো বাণিজ্যিকভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ি চলাচলের পক্ষেও নেই। পুরানো যানবাহন বিষয়ে বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, কমপক্ষে ৩৮ হাজার ১২৩টি ট্রাক, লরি ও ট্যাঙ্কার তাদের ২৫ বছরের মেয়াদ পার করা সত্ত্বেও সড়কে চলছে।

এসব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এ খাত সংশ্লিষ্টরা বিশ্বাস করেন, এ বাজার আবারও আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। সবকিছু স্থিতিশীল থাকলে, এ বাজার থেকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব বলে আশা করা হচ্ছে। তবে তা দেশী ও বৈশ্বিক বিভিন্ন নিয়ামকের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক যানবাহনের বাজার উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখেছে। তবে, বর্তমানে এটি এমন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। সরকার এই সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করে এই খাতকে একটি সম্মানজনক ক্যারিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

এতে সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবে এবং বাণিজ্যিক যানবাহন খাতের সামগ্রিক মানোন্নয়ন হবে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন :আহমেদ বিন কাদের অনি।

মূল লেখা পড়তে ক্লিক করুন Roadblocks ahead for commercial vehicles: surging demand vs challenges

Comments