যে গবেষণার জন্য রসায়নে নোবেল পেলেন ৩ বিজ্ঞানী

ক্লিক কেমিস্ট্রি অ্যান্ড বায়োঅর্থগোনাল কেমিস্ট্রির উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় ২০২২ সালে রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের আর বারতোজ্জি ও কে ব্যারি শার্পলেস এবং ডেনমার্কেরর মর্টেন মেলডাল।   
ছবি: নোবেলপ্রাইজ/ফেসবুক

ক্লিক কেমিস্ট্রি অ্যান্ড বায়োঅর্থগোনাল কেমিস্ট্রির উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় ২০২২ সালে রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের আর বারতোজ্জি ও কে ব্যারি শার্পলেস এবং ডেনমার্কেরর মর্টেন মেলডাল।   

রসায়নবিদরা দীর্ঘদিন ধরে ক্রমবর্ধমান জটিল অণু তৈরির চেষ্টা করছিলেন। ফার্মাসিউটিক্যালস গবেষণায়, প্রায়শই কৃত্রিমভাবে ঔষধি গুণাবলীসহ প্রাকৃতিক অণুগুলোকে পুনরুৎপাদন করা হয়। এই কাজটি প্রশংসনীয় হলেও সাধারণত সময়সাপেক্ষ এবং খুবই ব্যয়বহুল। সেই পরিস্থিতিতে ক্লিক রসায়নই আশীর্বাদ হয়ে আসে বিজ্ঞানীদের কাছে। 

২০২২ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার গিয়েছে মূলত রসায়নের কঠিন কিছু বিষয়কে সহজ করে তোলার জন্য।

এ ক্ষেত্রে ব্যারি শার্পলেস এবং মর্টেন মেলডাল রসায়ন শাস্ত্রের একটি কার্যকরী ভিত্তি স্থাপন করেছেন। ক্লিক কেমিস্ট্রি; যেখানে আণবিক ব্লকগুলো দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে একত্রিত হয়। ক্যারোলিন বার্টোজি জীবন্ত প্রাণীর ক্ষেত্রে
ক্লিক রসায়নের ব্যবহার শুরুর মাধ্যমে একে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

ব্যারি শার্পলেস – ইতিহাসের পঞ্চম ব্যক্তি হিসেবে দ্বিতীয়বার নোবেল পুরষ্কার অর্জন করলেন। আবার শুধু রসায়নে দু'বার নোবেল পাওয়ার ক্ষেত্রেও দ্বিতীয় তিনি। ২০০০ সালের দিকে তিনি ক্লিক রসায়নের ধারণাটি তৈরি করেন, যা একটি সহজ এবং নির্ভরযোগ্য রসায়ন। ক্লিক রসায়ন কোনো নির্দিষ্ট  বিক্রিয়া বা অণু কাঠামো না, বরং এটি একটি সহজাত ধারণা, যেখানে বিক্রিয়াগুলো দ্রুত ঘটে এবং অবাঞ্ছিত উপজাতগুলো এড়ানো হয়।

ক্লিক রসায়নের ব্যাপারটি অনেকটা লেগোর মতো। লেগো যেমন একটির সঙ্গে আরেকটি জোড়া দিয়ে নানা ধরনের কাঠামো তৈরি করা যায়। তেমনি, ক্লিক রসায়নে উপযুক্ত অণুগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে খুব সহজেই যুক্ত হয়ে রাসায়নিক কাঠামো তৈরি করে। সাবলীল এক ধরনের প্রচ্ছন্নতা থাকবে যুক্ত হওয়ার জন্য, অণু গঠন হবে সোজাসাপ্টা, অনেক বেশি শর্তের ওপর নির্ভর করবে না। 

বায়োঅর্থগোনাল কেমিস্ট্রি। ছবি: সংগৃহীত

 
আইডিয়া প্রকাশের বছরখানেকের মধ্যেই, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যারি শার্পলেস এবং ডেনমার্কে মর্টেন মেলডাল– দুজনই স্বাধীনভাবে ক্লিক রসায়নের গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। অ্যাজাইড-অ্যালকাইন সাইক্লোঅ্যাডিশন হয়ে ওঠে তাদের মূল ফোকাস, যেখানে একযোজি তামাকে ব্যবহার করা হতো অনুঘটক হিসেবে। অ্যাজাইড হলো এক ধরনের ঋণাত্মক অণুকাঠামো আর অ্যালকাইন হাইড্রোজেন কার্বনের এক ধরনের কার্যকরীমূলক। 

বর্তমানে এই বিক্রিয়াপদ্ধতি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ওষুধশিল্প এর জন্য একেবারে মোক্ষম একটি প্ল্যাটফর্ম। এ ছাড়া ডিএনএন ম্যাপিং (জিনের অবস্থান শনাক্তকরণ), পলিমার রসায়ন এবং ম্যাটেরিয়াল রসায়নের ক্ষেত্রে ক্লিক রসায়ন নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। ক্লিক রসায়নের বিপ্লব সহজে অতিকায় অণু তৈরি করার পথ রচনা করেছে। 

ইতিহাসে রসায়নে সপ্তম নারী নোবেলজয়ী ক্যারোলিন বের্তোজ্জি ক্লিক রসায়নকে নিয়ে যান আরেক ধাপ এগিয়ে। শার্পলেস ও মেলডালের ভিত্তির ওপর কাজ করে তিনি জীববিজ্ঞানে প্রয়োগ করেন ক্লিক রসায়ন। জীবদেহে ব্যবহারের একটি বাঁধা ছিল তামাকে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করা, কারণ জীবকোষের জন্য তামা বিষাক্ত। 

ক্যারোলিন কাজ করছিলেন বিভিন্ন জটিল স্যুগার অণু নিয়ে। গ্লাইকেন হলো এমন এক জটিল কার্বোহাইড্রেট, যা বহু জৈবিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্লাইকেন থাকে কোষপ্রাচীরে, ক্যারোলিন বের করে ফেললেন এর সঙ্গে এজাইড গ্রুপকে জুড়ে দেওয়া যায়। আর তখন একে ব্যবহার করা হয় উজ্জ্বল অণুর সঙ্গে যুক্ত করতে, যার ফলে গ্লাইকেনের চলাফেরা সহজেই অনুসরণ করা যায়। 

তিনি দেখালেন এজাইড এবং অ্যালকাইনকে যদি রিং-এর মতো গাঠনিক কাঠামো দেওয়া যায় তবে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এরা রাসায়নিক বন্ধন গঠন করে। তামাকে আর অণুঘটক হিসেবে ব্যবহার করতে হয় না। বায়োঅর্থোগোনাল রসায়নের এই সাফল্য এনে দিয়ে ক্যারোলিন প্রশস্ত করে দিলেন টিউমার চিকিৎসা, রোগ গবেষণা ও ক্যান্সার চিকিৎসার সক্ষমতা। 

সর্বোপরি জৈবরসায়নের জগতেই এ এক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যেই কোষের কার্যক্রম এবং জৈবিক বিভিন্ন রাসায়নিক কর্মকাণ্ডের নজরদারি করতে পারছেন ক্লিক রসায়ন এবং বায়োঅর্থোগনালিটির বদৌলতে। ক্যান্সার গবেষণায় তেজস্ক্রিয় পরমাণুকে ব্যবহার করা যাবে আরও দক্ষতার সঙ্গে, আরও সূক্ষ্মভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব হবে।
 
 

তথ্যসূত্র: নোবেলপ্রাইজ.ওআরজি
 

Comments