বাটারফ্লাই ইফেক্ট: মানতে না চাইলেও অস্বীকার করা যায় না

বাটারফ্লাই ইফেক্ট। ছবি: সংগৃহীত

ব্রাজিলে যদি একটি প্রজাপতি তার ডানা ঝাপটায়, তবে সেই ডানা ঝাপটানোর সুবাদে কি টেক্সাসে টর্নেডো হতে পারে? এমন প্রশ্ন কেবল মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিই করতে পারেন। কারণ প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর কারণে আর যা-ই হোক, টর্নেডো হতে পারে না। আর টর্নেডো যদি হয়েই থাকে, তবে ব্রাজিলে না হয়ে সেটা টেক্সাসে হবে কী করে!

অবিশ্বাস্য হলেও বিজ্ঞানের মতে এমন হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মতো যেকোনো ছোটখাটো কাজ কোনো ঘটনার শেষ পরিণতির ওপর ব্যাপক আকারে প্রভাব ফেলতে পারে। আর এই তত্ত্বকে বলা হয় 'বাটারফ্লাই ইফেক্ট' বা 'প্রজাপতি প্রভাব'।

এই তত্ত্বের আবিষ্কারক ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আবহাওয়াবিদ্যার অধ্যাপক ও গণিতবিদ এডওয়ার্ড লরেঞ্জ। ১৯৫০ সালে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য নতুন পদ্ধতির সন্ধান করতে গিয়ে মূল সংখ্যা ০.৫০৬১২৭ এর বিপরীতে কেবল ০.৫০৬ গাণিতিক মান ব্যবহার করেন। তারপর দেখতে পান মানের সামান্য পরিবর্তনের জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে যে প্রভাব পড়ে, সেটি মোটেও সামান্য নয়, বরং ব্যাপক। যাকে বলা হচ্ছে বাটারফ্লাই ইফেক্ট নামক বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব।

সাধারণত বিস্ময়কর, অরৈখিক এবং অনিশ্চিত ঘটনাসমূহের বিজ্ঞানকে বলা হয় বিশৃঙ্খলার বিজ্ঞান। মূলত তড়িৎ বিজ্ঞান, মহাকর্ষ কিংবা রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো বিজ্ঞানের যেসব শাখা সরলরৈখিক, গণিতনির্ভর এবং নির্দিষ্ট ফলাফল প্রাপ্তির ঘটনা নিয়ে কাজ করে সেসব ক্ষেত্রে যে মান পাওয়া যায়, তা গণনা করে বের করা সম্ভব। কিন্তু বিশৃঙ্খলা তত্ত্বে সাধারণত আবহাওয়া, মানুষের মনস্তত্ত্ব, ব্যবসার মতো যেসব ঘটনার সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না, সেসব ঘটনা বর্ণনা করা হয়।

'আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স' এর ১৩৯ তম অধিবেশনে প্রজাপতির পাখা ঝাপটানোর প্রশ্নের মাধ্যমে লরেঞ্জ আসলে বোঝাতে চেয়েছেন, কোনো জটিল বিষয়ের ক্ষুদ্র পরিবর্তনের কারণে ওই বিষয়ের বৈশিষ্ট্যে কতটুকু প্রভাব পড়তে পারে।

আরও সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে একটি গল্প বলা যাক। মো. রহমান (কাল্পনিক) অফিসে মিটিং চলাকালে খবর পেলেন তার মেয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়ে ভীষণ চোট পেয়েছে। অগত্যা অফিস ছুটি দিয়ে তিনি ছুটলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। এদিকে, সেই অফিসের কর্মী মো. হাসান সময়ের আগে বাড়ি ফিরতে পেরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সিনেমা দেখতে বের হলেন। সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার পথে আইসক্রিম খেতে গিয়ে আচমকা গাড়ি দুর্ঘটনায় তিনি শয্যাশায়ী।

ভেবে দেখুন, মো. রহমানের মেয়ের পা পিছলে পড়ে যাওয়ায় ঘটনা না ঘটলে মো. হাসান বাড়ি ফিরে সিনেমা দেখার পরিকল্পনা করতে পারতেন না, আর দুর্ঘটনাও ঘটতো না। চাইলে বিপরীত যুক্তি দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু ঐতিহাসিক কিছু ঘটনা জানলে বাটারফ্লাই ইফেক্টকে অগ্রাহ্য করা যায় না।

জাপানের কুরোকো সৌভাগ্যবান শহর, আর নাগাসাকি ধ্বংসের শহর হওয়ার পেছনের ঘটনা শুনলে রীতিমত অবাক হতে হয়। কারণ মার্কিন পাইলটদের নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের কথা ছিল না। বরং তাদের লক্ষ্য ছিল কুরোকো শহরের সামরিক অস্ত্রঘাঁটি।

যখন মার্কিন বোমারু বিমান কুরোকো শহরে বোমা ফেলার উদ্দেশে উড়াল দেয়, তখন কুরোকোর আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। যার ফলে কোনোভাবেই অস্ত্রঘাঁটি দেখতে পাননি পাইলটরা। টানা ৩ বার চেষ্টা করেও সেখানে আঘাত করা সম্ভব না হওয়ায় তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে লক্ষ্য নির্ধারণ হয় নাগাসাকি শহর। 

এই সামান্য মেঘের কারণেই কুরোকো শহর ভয়ংকর বোমা বিস্ফোরণের হাত থেকে রক্ষা পেলো। অপরদিকে, এই সামান্য মেঘের কারণে নাগাসাকি মার্কিন পাইলটদের টার্গেট না হয়েও ধ্বংস হয়ে গেল।

১৯০৬ সালে ভিয়েনার এক চিত্রশিল্পী ছবি আঁকতে গিয়ে প্রেমে পড়েন এক ইহুদী তরুণীর। তারপর প্রিয় কুকুরের মাধ্যমে চিঠি আদান-প্রদান করতে গিয়ে ধরা পড়েন। ইহুদী ধনাঢ্য পরিবার তার অস্বচ্ছলতার কথা জানতে পেরে কুকুরটিকে হত্যা করে বসে। সেই দুঃখ সইতে না পেরে তিনি পরবর্তীকালে যোগ দেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে।

সেখানেও ঘটে আরেক বিপত্তি। ১৯১৮ সালে এক ব্রিটিশ সেনা তাকে পিটিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করেন এবং হত্যা করতে উদ্যত হন। তারপর তাকে দয়া করে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর সেই চিত্রশিল্পী হলেন অ্যাডলফ হিটলার। যার নির্দেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৬৩ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কী হতো, যদি হিটলার প্রেমে প্রত্যাখ্যাত না হতেন কিংবা সেদিন তাকে হত্যা করা হতো? হয়তো বেঁচে যেতে পারতো এত এত প্রাণ।

এই হওয়া না হওয়ার মাঝখানে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাটারফ্লাই ইফেক্ট। যা মানতে না চাইলেও অস্বীকার করা যায় না।

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ, ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং, সায়েন্স এবিসি

Comments

The Daily Star  | English

Failure in state formation leads to the rise of fascist rule: Prof Ali Riaz

He made the remarks at the beginning of a discussion between the commission and the Amjanata Party.

1h ago