প্রযুক্তিগত পুনরুত্থানের বছর ২০২২

করোনার ব্যপকতা ও দীর্ঘদিনের লকডাউনের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সাল সমার মনে বিশেষ দাগ রেখে গেছে। তবে ২০২২ সাল ছিল সে অবস্থা থেকে অনেকটাই পুনরুদ্ধারের বছর। কেন না মানুষ আবার আগের মতো সমাজিক জীবনে ফিরে যেতে শুরু করে। করোনা মহামারিতে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের সঙ্গে ২০২২ সালে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এ বছরকে বৈশ্বিক প্রযুক্তি শাখায় পুনরুত্থান ঘটিয়েছে বলা চলে। 
প্রযুক্তিগত পুনরুত্থানের বছর ২০২২

করোনার ব্যপকতা ও দীর্ঘদিনের লকডাউনের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সাল সমার মনে বিশেষ দাগ রেখে গেছে। তবে ২০২২ সাল ছিল সে অবস্থা থেকে অনেকটাই পুনরুদ্ধারের বছর। কেন না মানুষ আবার আগের মতো সমাজিক জীবনে ফিরে যেতে শুরু করে। করোনা মহামারিতে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের সঙ্গে ২০২২ সালে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এ বছরকে বৈশ্বিক প্রযুক্তি শাখায় পুনরুত্থান ঘটিয়েছে বলা চলে। 

তাই আনুষ্ঠানিকভাবে বছর শেষের আগেই চলুন দেখে নেই ২০২২ সালের বৃহৎ প্রযুক্তিগত ঘটনাগুলো।

নতুন বাস্তবতা: মেটাভার্স

ভার্চুয়াল রিয়ালিটির ধারণাটি দীর্ঘকালের হলেও 'মেটাভার্স' শব্দটি ২০২২ সালে বিশেষ আকর্ষণ অর্জন করেছে। কেন না বিশেষ ব্যক্তি ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ভার্চুয়াল রিয়ালিটির এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। গ্লোবাল ম্যানেজমেন্ট কনসালটিং ফার্ম ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানির মতে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত মেটাভার্সের অবকাঠামো তৈরিতে ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়েছে। যার ২০২১ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি, সে বছর এ ব্যয় ছিল প্রায় ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।


 
তবে এত বিশাল বিনিয়োগ থাকা সত্ত্বেও মেটাভার্স ঠিক প্রত্যাশিত ওয়েভ তৈরি করতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। ২০২২ সালে শুধু মেটাভার্স বিভাগ থেকে ক্ষতি হয়েছে ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ফলে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। এমন উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান থাকার পরেও কোম্পানির সিইও মার্ক জাকারবার্গ মেটাভার্সের সাফল্য নিয়ে অবিচল রয়েছেন। নতুনভাবে ভিআর অগমেন্টেড বিভিন্ন হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের পাশাপাশি কোয়েস্ট-প্রো হেডসেট এবং হরাইজন ওয়ার্ল্ড প্রকল্প নিয়ে অপেক্ষাকৃত মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। 

প্রযুক্তিখাতে বিপুল কর্মী ছাঁটাই

করোনা সময়কালীন লকডাউনের এক বছরের বেশি সময় পরে পুনরায় কর্মস্থলে ফিরে আসা অনেকের জন্যই সহজ ছিল না। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এ বছর রেকর্ডসংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো মূল্যস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং লকডাউনের সময় লোকসান কভার করতে না পারা। গতমাসে মেটা তার মেটাভার্স এবং অ্যাপস ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে জড়িত ১১ হাজারের বেশি কর্মীকে ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। 

গত ৪ নভেম্বর ইলন মাস্ক টুইটারের দায়িত্ব নেবার পর ৩ হাজার ৭০০ কর্মীকে বরখাস্ত করেন, যা কোম্পানির মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেক। তিনি প্রথমদিন অফিসে এসেই সিইও পরাগ আগারওয়ালসহ একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছিলেন। এ বছর ৩১ আগস্ট স্ন্যাপ কোম্পানি তাদের অপারেশনাল খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে ১ হাজার ৩০০ কর্মীকে বরখাস্ত করার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এ বছর নেটফ্লিক্স ক্ষতির মধ্যে রয়েছে বলে জানা গেছে। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি ১৫০ জন কর্মীকে ছাঁটাই করেন। 

ফোর্ড মোটর কোম্পানি তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ভারত অফিস থেকে সর্বমোট ২ হাজার ফুলটাইম কর্মী ও ১ হাজার যোগাযোগ কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছেন। 

ইলন মাস্কের টুইটারের দায়িত্বগ্রহণ

প্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে এই বছর সম্ভবত বিলিয়নিয়ার ইলন মাস্কের চেয়ে বেশি স্পটলাইটে আর কেউ ছিলেন না। অগণিত জল্পনাকল্পনা শেষে টেসলার সিইও এলন মাস্ক, জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইট টুইটারকে ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে নিতে সক্ষম হন।  টুইটারে ৯ শতাংশ শেয়ার থেকে শুরু করে এবছর ৪ এপ্রিলে প্ল্যাটফর্মের সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডার হোন মাস্ক। ফলে, ২৭ অক্টোবর মাস্ক টুইটারের সদরদপ্তরে প্রবেশ করেই কোম্পানির নতুন মালিক হিসেবে তার সিংহাসন দাবি করেন। 
মাস্ক টুইটারের নেতৃত্বে আসার পরে থেকেই কোম্পানিটি নানা ধরনের উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যার মধ্যে আছে, কর্মচারী বরখাস্ত, অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ করা, পূর্বে নিষিদ্ধ করা অ্যাকাউন্টগুলো আবারও চালু করা এবং ঘন ঘন ফিচার পরিবর্তন ইত্যাদি।

প্রতি বছরের মতো ২০২২ সালে প্রযুক্তি প্রেমীদের জন্য কোম্পানিগুলো নতুন স্মার্টফোন ও অনেক ধরনের গ্যাজেট বাজারে আনে। সম্ভবত এই বছরে সবচেয়ে আলোচিত নতুন পণ্য হিসেবে ছিল প্রত্যাশিত আইফোন ১৪ এবং এর ভ্যারিয়েন্টগুলো। ৭ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হয়েছিল ফোনটি। সেই সঙ্গে এর প্রো এবং প্রো ম্যাক্স সংস্করণ এবং এ১৬ বায়োনিক চিপ।

বাজারে আসে অ্যাপল ওয়াচের ৪ নম্বর সিরিজ। সেই সঙ্গে লঞ্চ করা হয় অ্যাপেল ওয়াচ আলট্রা ও সেকেন্ড জেনারেশনের অ্যাপেল ওয়াচ এসই এবং সেকেন্ড জেনারেশন এয়ারপডস-প্রো। জুন মাসের ৬ থেকে ১০ তারিখে অ্যাপল তাদের নতুন আইওএস ১৬ ওএস এবং নেক্সট জেনারেশন এমটু সিলিকন চিপের ঘোষণা দেয়। সেই সঙ্গে ঘোষণা আসে নতুন চিপ সমৃদ্ধ ম্যাকবুক এয়ার ও ম্যাকবুক-প্রো এর নতুন ভার্সন। 

একইভাবে স্যামসাং গ্যালাক্সি আনপ্যাক্ট-২০২২ ইভেন্টে ঘোষণা দেওয়া হয় নতুন ফোন গ্যালাক্সি জি ফ্লিপ ফোর, গ্যালাক্সি জেড ফোল্ড ফোর, গ্যালাক্সি বাডস টু প্রো এবং গ্যালাক্সি ফাইভ ওয়াচ এবং এর প্রো ভার্সনের। 

অক্টোবর মাসে গুগল তাদের নতুন গ্যাজেটগুলোর ঘোষণা দেয়। যার মধ্যে পিক্সেল সেভেন ও সেভেন প্রো, পিক্সেল ওয়াচ ও পিক্সেল ট্যাবলেট অন্যতম। এ ছাড়া অন্যান্য গ্যাজেটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হতে পারে নাথিং ফোন ওয়ান। নতুনভাবে গেমিং ল্যাপটপ হিসেবে বের হয়েছে আসুস আরওজি জিফিরাস জি ফিফটিন। ২০২২ সালে ডেল কোম্পানি তাদের নতুন ল্যাপটপ ডেল এক্সপিএস১৩ ঘোষণা করে। 

সৃজনশীলতার জায়গা নিচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স

২০২২ সালে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) মানবিক সৃজনশীলতা অন্বেষনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে। মিড জার্নি, ডাল-ই এবং স্টেবল ডিফিউশনের মতো সহজে ব্যবহারযোগ্য আর্টজেনারেটর গুলোর সাহায্যে প্রি জেনারেট করা ছবিগুলো ব্যবহার করে অসাধারণ আর্ট তৈরি করা সম্ভব।
 
ডাল-ই এর প্রতিষ্ঠাতা দলই নভেম্বর মাসে ওপেন এআই চ্যাট বুট 'চ্যাট জিপিটি' লঞ্চ করে। তবে ২০২২ সালের শেষের দিকে শিল্পী ও লেখকগণ এ জাতীয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহারের নৈতিকতার বিষয়ে প্রতিবাদ করেছেন। 

অসীমের পথে

২০২২ সালে মহাকাশ অনুসন্ধানের জন্য একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছিল নাসা। ১২ জুলাই বিশ্বের বৃহত্তম টেলিস্কোপ জেমস-ওয়েবের তোলা ছবি প্রকাশ করে। 

এই ছবিগুলো প্রধানত এক্সোপ্ল্যানেট ডব্লিউএএসপি-৯৬ বি, সাউথ রিং নেবুলা নামের মৃত নক্ষত্রের নীহারিকা, স্টিফেন কুইন্টেট নামক ৫টি ছায়াপথের দল এবং এনজিসি ৩৩২৪ নামের একটি তারকামণ্ডল রয়েছে। আমরা দূরবর্তী তারা সম্পর্কে একেবারে নতুন বিবরণও শিখেছি এবছর। তাদের জীবন চক্র সম্পর্কে নতুনভাবে জেনেছি।

এ ছাড়া ১৬ নভেম্বর নাসা চাঁদে তাদের প্রথম মানববিহীন ফ্লাইট চালু করে। 

২০২২ সালে নিঃসন্দেহে বিজ্ঞান এবং আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বছর। করোনা কালীন পরবর্তী সময়ে কাজের ধরন থেকে শুরু করে বিশ্ব পুনরুদ্ধার হওয়া সত্বেও বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাত অগ্রগতিতে বিশাল উর্ধ্ব গতি দেখাচ্ছে। অবশ্যই নতুন বছর ২০২৩ সালে প্রযুক্তির এ বিস্ময় আরও আসতে চলেছে।

 

অনুবাদক করেছেন আরউইন আহমেদ মিতু

 

Comments