ইউটিউবে নতুন সিইও, তবে নাটকীয় কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই
ইউটিউবের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুজান উইজিসকি গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তবে তার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন যিনি, তিনিও গুগলের নের্তৃত্ব পর্যায়ের সবার পরিচিত মুখ। ইউটিউবে সুজানের পরের আসনেই ছিলেন নীল মোহন।
উল্লেখ্য, বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মটি গুগলের মালিকানাধীন।
সুজানের মতোই নীল মোহনকে সিলিকন ভ্যালির বাইরে তেমন কেউ চেনেন না। তারও উত্থান হয়েছে গুগলের প্রভাবশালী বিজ্ঞাপনী বিভাগ থেকেই। সুজানের পদত্যাগের পর ইউটিউবের প্রধান নির্বাহীর পদে তার পদায়নকে অনেকে যথার্থ হিসেবেই দেখছেন এবং প্রযুক্তি দুনিয়ার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীল মোহনের অধীনে ইউটিউবে নাটকীয় কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। বিজ্ঞাপনী জগতের পরিচিত মুখ রব নরম্যান বলেন, 'তার (নীল মোহন) চেয়ে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।'
ইউটিউবে নীল মোহনের যাত্রা শুরু হয়েছিল সুজানের হাত ধরেই। ২০১৫ সালে তিনিই নীল মোহনকে ইউটিউবে নিয়ে আসেন। এই দুজন দীর্ঘ সময় গুগলের ডিসপ্লে অ্যাড বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। ইউটিউবের অধিকাংশ আয় আসে এই এই ডিসপ্লে অ্যাডের সাহায্যেই।
২০০৮ সালে গুগল যখন বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডাবল-ক্লিককে অধিগ্রহণ করে, সেই সঙ্গে গুগলে যোগ দেন মোহন। বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে তার বিশাল জ্ঞাণ রয়েছে। বিজ্ঞাপনী সংস্থা ওমনিকম ডিজিটালের প্রধান নির্বাহী জনাথন নেলসন বলেন, 'তিনি দীর্ঘদিন ইউটিউবে ছিলেন। এই প্ল্যাটফর্মটি তিনি খুব ভালো বোঝেন, কারণ তিনিই এটি তৈরি করেছেন।'
২০১৭ সাল থেকে ইউটিউবের তারকা নির্মাতারা নীল মোহনকে চিনতে শুরু করে। নিন্ম মানের ভিডিওর অভিযোগে ইউটিউব তখন বিজ্ঞাপণদাতাদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল, যার ফলে কনটেন্ট নির্মাতাদের আয় কমে যাচ্ছিল। নীল মোহন তখন সুজান উইজিসকির সঙ্গে আভ্যন্তরীণ ও সার্বজনীন অনুষ্ঠানগুলোতে মঞ্চে উঠে বিভিন্ন জিজ্ঞাসা ও উৎকণ্ঠার জবাব দিতেন।
নীল মোহনের পদায়ন সম্পর্কে জনপ্রিয় ইউটিউবার হাঙ্ক গ্রিন এক টুইটে বলেন, 'এটাই সবচেয়ে যৌক্তিক ও স্থিতিশীল সিদ্ধান্ত। এই নিয়োগ প্রমাণ করে যে সামনে কোনো বড় পরিবর্তন আসছে না।'
এটা অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে ইউটিউবে নিকট ভবিষ্যতে বড় কোনো পরিবর্তন আসছে না, কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জনপ্রিয় এই ভিডিও স্টিমিং প্ল্যাটফর্মটিতে বড় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী নেটফ্লিক্সের সঙ্গে পাল্লা দিতে 'অরিজিনিাল শো' আনার যে পরিকল্পনা করেছিল ইউটিউব, সেটি পরে বাতিল করে দেওয়া হয়, যাতে কনটেন্ট নির্মাতাদের অর্থ আয়ের দিকে প্ল্যাটফর্মটি আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারে। টিকটকের অভাবনীয় উত্থানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য ইউটিউব 'শর্টস' নামে নতুন একটি ফিচারও উন্মুক্ত করে, যেটি সফলতা পেতে বেশি সময় নেয়নি।
ইউটিউবের মতো প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে থেকেও নিজেকে পাদপ্রদীপের আলোর বাইরে রাখার ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন সুজান। ফেসবুকের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা শেরিল স্যান্ডবার্গের মতো তিনি কখনোই জনসম্মুখে নিজের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। মঞ্চেও তিনি কখনো নিজেকে সেভাবে উপস্থাপন করেননি।
নরম্যান বলেন, 'আমি যখন ইউটিউবের ইতিহাস নিয়ে একটি বই লেখার জন্য গবেষণা করছিলাম, তখন এমন একজনকে খুঁজে পেতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল যিনি ইউটিউবে কাজ করতেন এবং সুজানকে ভালোভাবে জানতেন। নরম্যানের ধারণা, হয়তো সুজান এমনভাবে ইউটিউব পরিচালনা করতেন, যাতে তার বেশি কথা বলার প্রয়োজন হতো না।'
মোহনের ব্যক্তিত্বও অনেকটা একই রকম। মোহনের সাক্ষাৎকারগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তিনি অনেক দীর্ঘ উত্তর দেন, কিন্তু তার উত্তরের সারবস্তু অনেক কম। তবে তার যে মেধা, সেটা গুগলের নের্তৃত্ব অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল। আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় মোহন যাতে টুইটারে চলে না যান, এজন্য গুগলের পক্ষ থেকে তাকে ১০০ মিলিয়ন ডলার অফার করা হয়েছিল। এজন্য মজা করে গুগলের অনেকে তাকে '১০০ মিলিয়ন ডলার ম্যান' নামে ডাকে।
সুজান সব সময় সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। এ জন্য তিনি সবার চোখের আড়ালে থেকেছেন, তাকে নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে অনেক কম। ক্যাপিটল হিলে মার্কিন আইনপ্রনেতাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি তাকে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কিন্তু ফেসবুট, টুইটারের পাশাপাশি ইউটিউবেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু সবাই মেতে ছিল ফেসবুক আর টুইটার নিয়ে। ইউটিউবের ব্যাপারে তেমন কোনো আলোচনাই হয়নি।
স্ট্যানফোর্ড ল' স্কুলের অধ্যাপক এবং ইউটিউবের একজন সমালোচক ইভলিন ডুয়েক বলেন, 'যেভাবেই হোক, উইজিসকি সব সময় বিতর্কিত ইস্যুগুলোতে আলো এড়িয়ে চলেছেন। নীল মোহনও একই কাজ করতে পারবেন কি না, সেটা দেখাটা হবে এক মজার মুহূর্ত।'
তবে ইউটিউবের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমস্যার ব্যাপারে নীল মোহনকে সতর্ক থাকতে হবে। ৫ বছর আগে ইউটিউবে যখন বিজ্ঞাপণের খরা যাচ্ছিল, নীল মোহন তখন নিজের কাজের পরিধি বাড়িয়ে প্ল্যাটফর্মের নীতিমালা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। এসব নীতিমালা আসন্ন ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কী প্রভাব ফেলে, অনেকেই তার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। গুগলের বিজ্ঞাপনী নীতিমালা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যে আপত্তি রয়েছে এবং সেখানে যদি বড় ধরনের কোনো রদবদল করতে হয়, তাহলে ডাবল-ক্লিকের কার্যক্রমকে আবারও নতুন করে সাজাতে হতে পারে। এ কাজের জন্য তখন নীল মোহনের চেয়ে যোগ্যতর আর কেউ হবেন না।
Comments