কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা

চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে লেখা বইয়ের বিক্রি বেড়েছে অ্যামাজনে

চ্যাটজিপিটি যেকোনো বিষয়ে যেভাবে সুন্দরভাবে আর্টিকেল লিখে দেয়, সেটিই মূলত ব্রেটকে সাহায্য করেছে। এই প্রযুক্তির সাহায্যেই মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি বাচ্চাদের জন্য ৩০ পৃষ্ঠার একটি ইলাস্ট্রেটেড বই লিখতে সক্ষম হন। বইটি তিনি অ্যামাজনে বিক্রির জন্য তালিকাভুক্ত করেন। 
ছবি: রয়টার্স

সম্প্রতিকালে চ্যাটজিপিটির সাহায্যে বই লেখা ও অ্যামাজনের মতো প্ল্যাটফর্মে সেসব বই বিক্রির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।  ফেব্রয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত অ্যামাজনের কিন্ডল স্টোরে দুইশরও বেশি বইয়ের লেখক হিসেবে চ্যাটজিপিটির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব বইয়ের মধ্যে আছে 'হাউ টু রাইট অ্যান্ড ক্রিয়েট কনটেন্ট ইউজিং চ্যাটজিপিটি', 'দ্য পাওয়ার অব হোমওয়ার্ক', 'ইকোস অব দ্য ইউনিভার্স'। 

অ্যামাজনে চ্যাটজিপিটির লেখা বইয়ের সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে যে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ওয়েবসাইটে 'চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে লেখা বই, পুরোপুরি চ্যাটজিপিটির সাহায্যে লেখা বই' নামে নতুন একটি সাব-ক্যাটাগরিও করে দিয়েছে। 

ব্রেট শিকলারের অনেকদিন ইচ্ছা ছিল তিনি একটি বই প্রকাশ করবেন। কিন্তু কখনো ভাবেননি এত দ্রুতই তার স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাবে। চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি বাচ্চাদের জন্য একটি বই লিখতে সক্ষম হয়েছেন।  

নিউইয়র্কের এই বিক্রেতা বলেন, 'বই লেখাটা অবশেষে সম্ভব হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম আমাকে দিয়ে এটা হবে না।'

চ্যাটজিপিটি যেকোনো বিষয়ে যেভাবে সুন্দরভাবে আর্টিকেল লিখে দেয়, সেটিই মূলত ব্রেটকে সাহায্য করেছে। এই প্রযুক্তির সাহায্যেই মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি বাচ্চাদের জন্য ৩০ পৃষ্ঠার একটি ইলাস্ট্রেটেড বই লিখতে সক্ষম হন। বইটি তিনি অ্যামাজনে বিক্রির জন্য তালিকাভুক্ত করেন। 

ব্রেট বলেন, 'মানুষ এর সাহায্যে নতুন ক্যারিয়ার গড়ে পারবে।'

গত বছরের নভেম্বরে ওপেনএআই নামের একটি প্রতিষ্ঠান চ্যাটজিপিটি উন্মুক্ত করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন এই চ্যাটবটের ক্ষমতা কোটি মানুষকে হতবাক করে দেয় এবং ইন্টারনেট দুনিয়ায় ব্যাপক শোরগোল সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে মাইক্রোসফট তাদের বিং সার্চ ইঞ্জিনেও এই প্রযুক্তি যুক্ত করে।  বাধ্য হয়ে গুগলও দ্রুততম সময়ে তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবট 'বার্ড' উন্মুক্ত করে। 

চ্যাটজিপিটির টেক্সট তৈরির সক্ষমতা এবং বহু মানুষ যে এটিকে ব্যবহার করেই বই লিখেছে, সেটি গোপন করার কারণে এই চ্যাটবটটি ব্যবহার করে এখন পর্যন্ত কতগুলো বই লেখা হয়েছে, সেটি জানা অসম্ভভ। 

চ্যাটজিপিটির ব্যাপক উত্থান ও এর অভাবনীয় দক্ষতার ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বিনিয়োগকারীরা এখন এই খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে চাইছেন। গত ২-৩ মাস ধরে মাইক্রোসফট সারা বিশ্বে প্রতিদিনই কোনো না কোনো খবর হচ্ছে, যার মূল উৎস চ্যাটজিপিটি। ওপেনএআই নামের যে প্রতিষ্ঠানটি এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবটটি তৈরি করেছে, তাতে বড় বিনিয়োগ আছে মাইক্রোসফটের। 

তবে চ্যাটজিপিটি প্রায়ই ভুল তথ্য উপস্থাপন করে। এজন্য এর উত্তরের সত্যতা নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ আছে। 

চ্যাটজিপিটি কি 'আসল' লেখকদের জন্য হুমকি?

কোনো প্রশ্নের উত্তরে চ্যাটজিপিটি যে দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে দীর্ঘ লেখা প্রদান করতে পারে, তাতে এটি ব্যবহার করে নাটক-উপন্যাস কিংবা দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক বই খুব সহজেই লিখে ফেলা সম্ভব। এমনকি সেগুলো অ্যামাজনের কিন্ডল স্টোরে সরাসরি বিক্রির সুযোগও আছে। যারা এভাবে নতুন নতুন বই লিখছেন এখন, তাদের কাছে বাচ্চাদের ইলাস্ট্রেটেড বই হচ্ছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারা। ইউটিউব, টিকটক এবং রেডিটে এমন হাজার হাজার টিউটোরিয়াল আছে যেখানে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে কীভাবে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রান্নার রেসিপি, বাচ্চাদের জন্য, প্রযুক্তি বিষয়ক, খাদ্যাভ্যাস কিংবা সফটওয়্যার কোডিং টিপস বিষয়ক বই লিখে ফেলা সম্ভব, সেটি শেখানো হচ্ছে।  

লেখকদের সংগঠন অথর্স গিল্ড- এর নির্বাহী পরিচালক মেরি রাসেনবার্গ বলেন, 'এটা সত্যিই উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো ব্যাপার। এই বইগুলো বাজারে ছেয়ে যাবে এবং অনেক আসল লেখকের কোনো কাজ থাকবে না।' তিনি বলেন, মানুষ নিজের নাম গোপন করে বই লিখতো, সেটি অনেকদিনের ঐতিহ্য। কিন্তু চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফটওয়্যার দিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটি বই লিখে ফেলা আলাদা ব্যাপার। 

'এসব বইয়ের ক্ষেত্রে কী হবে, সে ব্যাপারে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। না হলে প্রচুর নিন্মমানের বই তৈরি হবে।'

একজন লেখক, যিনি তার পরিচয় দিয়েছেন ফ্র্যাঙ্ক হোয়াইট হিসেবে, ইউটিউবে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখিয়েছেন তিনি কীভাবে মাত্র একদিনে ১১৯ পৃষ্ঠার একটি নভেলা (নাটকের চেয়ে ছোট কাহিনী) লিখেছেন। বইটি অ্যামাজনের কিন্ডল ই-বুক স্টোরে মাত্র ১ ডলারে পাওয়া যেতে পারে। ওই ভিডিওতে হোয়াইট বলেন, সময় দিলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বছরে এই রকম ৩০০ বই লেখা সম্ভব। 

অনেক লেখকই চ্যাটজিপিটির সাহায্যে নাটক-উপন্যাস লিখলেও সেখানে লেখক হিসেবে নিজের নাম দিয়ে দিচ্ছে। অ্যামাজনে সেই বই বিক্রিও হচ্ছে অনেক। বইয়ের মূল লেখকের ব্যাপারে কড়াকড়ি করে না অ্যামাজন। যার ফলে এমনটি সম্ভব হচ্ছে।  

রয়টার্সের এ সম্পর্কিত একটি প্রশ্নের উত্তরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে লেখা বইয়ের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হেবে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি অ্যামাজন। তবে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, 'তাদের প্ল্যাটফর্মে বিক্রিত সব বইকেই ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস-সহ তাদের সব নীতিমালা মেনে চলতে হয়।'

ধারণা থেকে বেই তৈরি ও বিক্রি, মাত্র কয়েক ঘণ্টায়

ফিজিক্যাল ও ই-বুক বিক্রির দিক থেকে অ্যামাজন বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম। যুক্তরাষ্ট্রে মোট বিক্রি হওয়া বইয়ের অর্ধেকেরও বেশি বই বিক্রি হয় অ্যামাজনে। কোনো কোনো হিসেবে মোট ই-বুক বিক্রির শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি হয় শুধু অ্যামাজন থেকে। অ্যামাজনের 'কিন্ডল ডিরেক্ট পাবলিশিং' টুলের সাহায্যে বহু নতুন লেখক নিজেরাই নিজেদের বই প্রকাশ ও বিক্রি করতে পারছে।  

২০০৭ সালে অ্যামাজন এই টুলটি উন্মুক্ত করে যার সাহায্যে যে কেউ যেকোনো সময় যেকোনো জায়গা থেকে কোনো দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুরসণ করা ছাড়াই নিজেদের বই প্রকাশ ও বাজারজাত করতে পারছে, এ ক্ষেত্রে কোনো যাচাই-বাছাইও হয় না। 

এর ফলে নতুন অনেক লেখক তৈরি হয়েছে, যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফটওয়্যার দিয়ে নিজেদের বই লিখছেন। এমন একজন লেখক হচ্ছেন কামিল বাঙ্ক। তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে বাজি ধরেছেন যে তিনি একেবারে ধারণা পর্যায় থেকে একটি বইয়ের সব কাজ শেষ করে সেটি বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করে দেবেন এবং এই সব কাজ করতে তার সময় লাগবে একদিনেরও কম। বাঙ্ক ২৭ পৃষ্ঠার যেই বইটি লিখেছেন, সেটি এখন অ্যামাজনে পাওয়া যাচ্ছে, নাম 'বেডটাইম স্টোরিজ: শর্ট অ্যান্ড সুইট, ফর এ গুড নাইট'স স্লিপ'। বইয়ের লেখাগুলোর জন্য তিনি চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছেন আর ছবির জন্য আরেকটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফটওয়্যার ব্যবহার করেছেন। এই বইটির সব কাজ শেষ করতে তার সময় লেগেছে মাত্র ৪ ঘণ্টা। 

বাঙ্ক তার বই দিয়ে এখনো অনেক পাঠক টানতে পারেননি। এখন পর্যন্ত তিনি কয়েক ডজন বই বিক্রি করেছেন। তবে পাঠকদের অনেকেই তার বইটি অনেক পছন্দ করেছেন এবং ফাইভ স্টার রিভিউ দিয়েছেন। এমনকি একজন বইটির খুব ভালো রিভিউ লিখেছেনও।

বাঙ্ক এরপর এমন আরও দুইটি বই লিখেছেন এবং আরও অনেকগুলো লেখার কাজ চলছে। তিনি বলেন, 'এটা আসলে খুবই সহজ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বইয়ের কাজ এত দ্রুত করা সম্ভব যে আমি নিজেই অবাক হয়েছি।'  

তবে চ্যাটজিপিটির লেখা বই যে সবাই পছন্দ করছেন, সেটাও না। কিন্ডল ডিরেক্ট পাবলিশিং টুলের সাহায্যে নিজের লেখা লাখ লাখ বই বিক্রি করেছেন মার্ক ডাউসন। তিনি চ্যাটজিপিটির সাহায্যে লেখা নাটকগুলোকে 'নিষ্প্রভ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। 

'বইয়ের ক্ষেত্রে পাঠকদের রিভিউ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ভালো রিভিউ পেতে হলে মেধা থাকতে হবে। পাঠকরা যদি একটি বইয়ের ব্যাপারে খারাপ রিভিউ দেয়, তাহলে খুব দ্রুতই সেটি তলিয়ে যাবে।'

 

সূত্র: রায়টার্স

অনুবাদ করেছেন আহমেদ হিমেল
 

Comments