আন্তর্জাতিক নারী দিবস

দেশের ডিজিটাল সেবা নারীদের জন্য কতটা উপযোগী

ডিজিটাল সেক্টরে জেন্টার বৈষম্য দূর করার জন্য বাংলাদেশের প্রয়াস লক্ষণীয়। বছরের পর বছর ধরে, সব খাতে নারীদের সহায়তা করার জন্য তৈরি করা হয়েছে অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটসহ নানা ডিজিটাল পরিষেবা।
দেশের ডিজিটাল সেবা নারীদের জন্য কতটা উপযোগী

'স্মার্ট বাংলাদেশ', নতুন এই রূপকল্প দিয়ে চেনানো হয় অন্য এক বাংলাদেশকে। আর নাগরিকদের ক্ষমতায়ন প্রকাশ পায় ডিজিটাল সাক্ষরতা কর্মসূচির ব্যাপক বাস্তবায়নের মাধ্যমে। 

এই উচ্চাভিলাষী উদ্যোগটি দেশের দ্রুত ডিজিটাল অগ্রগতি এবং সমস্ত খাতকে ডিজিটাল রূপান্তরের ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য প্রতিফলিত করে।  যাইহোক, এমন উল্লেখযোগ্য উন্নতি সত্ত্বেও নারীদের জন্য সুগঠিত ডিজিটাল পরিষেবার ব্যবস্থা করতে কাজ চলছে এখনো।

ডিজিটাল সেক্টরে জেন্টার বৈষম্য দূর করার জন্য বাংলাদেশের প্রয়াস লক্ষণীয়। বছরের পর বছর ধরে, সব খাতে নারীদের সহায়তা করার জন্য তৈরি করা হয়েছে অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটসহ নানা ডিজিটাল পরিষেবা।

ডিজিটাল ফাইন্যান্সের উদ্ভাবন নারীদের অনন্য আর্থিক চাহিদা ও চাহিদা পূরণের পথ খুলে দিয়েছে। কিছু উল্লেখযোগ্য সরকারি ডিজিটাল ফাইনান্স পরিষেবা অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট- এটুআই-এর 'সাথী'এবং মাইক্রোক্রেডিট সফটওয়্যার 'স্বস্তি' চালু করা হয়েছে যা মোবাইল ব্যাংকিং এবং মাইক্রোলোনের মধ্যে ব্যবধান কমিয়েছে।

নারী উদ্যোক্তাদের একটি নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য সরকারের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে 'সাথী' চালু করা হয় ২০২২ সালে। নারী-কেন্দ্রিক আর্থিক পরিষেবা ছাড়াও ব্যাংকগুলো তাদের সব পরিষেবা ডিজিটালাইজেশন করেছে, যাতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সহজে পরিচালনা করতে পারে। তা সত্ত্বেও, অনলাইন ব্যাংকিংয়ে নারী গ্রাহকের সংখ্যা খুবই কম৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী ব্যাংকার জানান, নারীদের অনলাইন সেবা ব্যবহারে অনীহা বেশি।

সরকারের জরুরি হেল্পলাইন ৯৯৯-এর তথ্যানুযায়ী প্রাপ্ত কলগুলোর মধ্যে মাত্র ১৯ শতাংশ আসে নারীদের থেকে যার ৪১ শতাংশ কল ঢাকা থেকে আসে। এতেই বোঝা যায়, স্বল্পোন্নত শহর বা গ্রামাঞ্চলের নারীরা খুব কমই সাহায্য খোঁজেন। বাঁচাও, ডাক ট্র্যাকার, অভয় ইত্যাদিসহ অন্যান্য সুরক্ষা অ্যাপগুলো নারীদের জন্য সুবিধা বয়ে আনতেই কাজ করে।

স্বাস্থ্যখাতেও উন্নয়ন এনেছে ডিজিটাল ধারা। ২০২০ সালে, ডিজিটাল হেলথ কেয়ার সলিউশনের সহযোগিতায় শক্তি ফাউন্ডেশন 'শক্তি চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র' নামে নতুন প্রযুক্তি প্রতিস্থাপন করে। নারী-কেন্দ্রিক অ্যাপ যেমন 'মায়া আপা' নারীদের জন্য বাংলাদেশের প্রথম ওয়ান-টাচ হেল্প সার্ভিস অ্যাপ। উইমেন সাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ ফোরাম (উব্লিউএসআইএফ) নারীদের দ্বারা পরিচালিত একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যা ২০১৮ সাল থেকে বিভিন্ন মনোসামাজিক সেবা প্রদান করে আসছে।

সীমাবদ্ধতা

বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, ডিজিটাল পরিষেবাগুলোতে পুরুষদের তুলনায় নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এর অন্যতম প্রধান কারণ প্রযুক্তিগত ডিভাইসে দক্ষতার অভাব। একই সঙ্গে, ডিভাইসের ক্রয়ক্ষমতার সামর্থ্য না থাকা। 

একজন নারী ব্যাংকারের মতে, ডিজিটাল জ্ঞান থেকে ছিটকে পড়লে নারী ব্যবহারকারীদের মধ্যে এ নিয়ে জড়তা তৈরি হয়।

তিনি আরও বলেন, 'কিছু নারীর ধারণা এমন যে, তারা যদি ব্যাংকিং পরিষেবাগুলো গ্রহণ করেন তবে তাদের অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তারা ব্যবসার আনুষ্ঠানিকিকরণে কম আগ্রহী। যদিও তারা সহজেই অনলাইনে ব্যবসা-সম্পর্কিত যে কোনো সহায়তা পেতে পারেন।'

তবে উইমেন ইন ডিজিটাল-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী আছিয়া নীলা জোর দেন নারী ব্যবহারকারীদের তথ্যের অপর্যাপ্ততার ওপর।

৯৯৯-এর মতো নিরাপত্তার হেল্পলাইনগুলো ব্যবহারের সময় সাহায্যপ্রার্থী নারীরা নারী-পুলিশের সঙ্গে তাদের সমস্যাগুলো জানাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন৷ যদিও ৯৯৯-এর কল রিসিভারের ৮৫ শতাংশই নারী পুলিশ অফিসার, তবুও চাহিদা মোকাবিলায় তাদের সংখ্যা অপ্রতুল। পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে বিঘ্নিত হয় প্রত্যাশিত সেবা- এমনটাই মনে করেন বাংলাদেশ পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক আমেনা বেগম।

ডিজিটাল পরিষেবা প্রদানের চ্যালেঞ্জ নিয়ে জানাতে তিনি বলেন, 'বিশেষত গ্রামীণ নারীরা এ পরিষেবা সম্পর্কে সচেতন নয়৷ তারপরও পুলিশ তাদের সমস্যায় সাহায্য করতে পারবে কি-না তা নিয়ে এখনো অনেকেই সন্দিহান।'

তিনি আরও যোগ করেন, 'আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে নীতিমালার অভাব। ফলস্বরূপ, যখন ডিজিটাল অপব্যবহারের অভিযোগ আসে, তখন কোন পদক্ষেপ অনুসরণ করা হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত হয়।'

পুলিশ অফিসারদের অপারেশন লেভেলে আরও প্রস্তুত করতে সম্প্রতি জেন্ডার সেনসিটিভ পুলিশিং-এর একটি অনলাইন মডিউল তৈরি করা হয়েছে। আমেনা বেগম মনে করেন এই প্রয়াস জনশক্তিকে উন্নত করতে এবং আরও ভালো সেবা দিতে প্রস্তুত করবে।

ডিজিটালাইজেশনের আশীর্বাদ অসংখ্য এবং সুযোগ অফুরন্ত। এখানে লিঙ্গ সমতা বিবেচনা করার মতো একটি মৌলিক বিষয় এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর অগ্রগতি-ও দৃশ্যমান। নারীদের জন্য ডিজিটাল সেবার সহজলভ্যতাও প্রশংসনীয়। কিন্তু শুধুমাত্র উন্নয়নশীল সেবাই যথেষ্ট নয়; যথাযথ পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।

বেসিসের সিনিয়র সহসভাপতি ফারহানা এ রহমানের মতে, উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায় সম্পন্ন হয়েছে। এখন সময় সঠিক পরিষেবা নিশ্চিতের জন্য মানসম্মত ব্যবস্থা নেওয়ার। প্রয়োজনীয় এসব সেবা নিতে নারী ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির গুরুত্বও তুলে ধরেন তিনি। 

তিনি আরও বলেন, 'ডিজিটাল পরিষেবার গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করার পাশাপাশি এই খাতকে অগ্রাধিকার দিতে বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি খাতকে আকৃষ্ট করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে গণমাধ্যম।'

তিনি নারীদের মধ্যে নেতৃত্ব গড়ে তোলার ওপর জোর দেন যাতে তারা নিজেদের চাওয়া-পাওয়া জানাতে পারে। তিনি বিশ্বাস করেন পাঠ্যপুস্তকে এই ধরনের ধারণাগুলো অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে নারীদের মধ্যে ছোট বেলা থেকেই এই দায়িত্ববোধ শুরু হতে পারে। তাদের কী প্রয়োজন সে সম্পর্কে সচেতন হলে নারীরা সেই অনুযায়ী দাবি তুলতে পারবে। অন্যথায়, ডিজিটাল পরিষেবাগুলো আরও ফাঁক তৈরি করে অনুমানের ওপর নির্মিত হতে থাকবে।

 

অনুবাদ করেছেন তানজিনা আলম

Comments