ইন্টারনেট সার্চ নিয়ে মহাযুদ্ধ

২০২২ সালে অ্যালফাবেট ২৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। গুগল এখন শুধু সর্বমহলে পরিচিত একটি শব্দই নয়, এটি একটি ক্রিয়াবাচক শব্দেও পরিণত হয়েছে। 
ইন্টারনেট সার্চ নিয়ে মহাযুদ্ধ

গত ২৫ বছর ধরেই সার্চ ইঞ্জিন হচ্ছে ইন্টারনেটের মূল প্রবেশদ্বার। প্রথম ওয়েব সার্চ ইঞ্জিন ছিল আলটাভিস্তা। গুগল তাদের জায়গা ধীরে ধীরে দখল করে নেয় এবং তারপর থেকে এখনো পর্যন্ত ইন্টারনেট সার্চ এবং গুগল যেন সমার্থক হয়ে উঠেছে। 

গুগলের প্রধান ব্যবসাই হচ্ছে সার্চ। এই সার্চ ইঞ্জিনের সাহায্যেই গুগল আজ এত বিশাল একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম ধনী প্রতিষ্ঠান। 

২০২২ সালে অ্যালফাবেট ২৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। গুগল এখন শুধু সর্বমহলে পরিচিত একটি শব্দই নয়, এটি একটি ক্রিয়াবাচক শব্দেও পরিণত হয়েছে। 

কিন্তু প্রযুক্তি দুনিয়ায় কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়। বিজনেস কম্পিউটিংয়ের জগতে আইবিএম কিংবা মোবাইল ফোনের জগতে নোকিয়ার ইতিহাসের দিকে তাকালেই এটা সহজে অনুমেয়। নতুন প্রযুক্তির উত্থানের ফলেই এই দুটি প্রভাবশালী কোম্পানির বাজার হাতছাড়া হয়েছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করছে। ফলে একই ক্ষেত্রের পুরোনো প্রযুক্তিগুলো অজনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে। যেমন, বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই)-এর ব্যাপক উত্থানের সময়। বিশ্বের প্রায় সব বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এআই নিয়ে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করছে। এখন টেক্সট নির্দেশনা থেকেই এআই চ্যাটবট ব্যবহারকারীকে মুহূর্তের মধ্যেই তথ্য হাজির করে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে চ্যাটজিপিটি নামের একটি চ্যাটবট, যেটি তৈরি করেছে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই। প্রযুক্তি দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে চ্যাটজিপিটি ১০ কোটি গ্রাহকের মাইলফলক অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। 

অনেক পণ্য বা সেবাতেই আগে থেকে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হতো। কিন্তু চ্যাটজিপিটির নাটকীয় উত্থান এখন এআইকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। চ্যাটজিপিটির সাহায্যে মানুষ এখন এআইয়ের সঙ্গে সরাসরি চ্যাট করতে পারছে। কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে সেটি গুগলের দেওয়া কোনো লিংকে গিয়ে না পড়ে সরাসরি চ্যাটবক্সেই পাওয়া যাচ্ছে। এতে ব্যবহারকারীদের সময় ও শ্রম দুটোই বাঁচছে। ইন্টারনেট সার্চে গুগলের দীর্ঘদিনের আধিপত্যে তীব্র আঘাত হেনেছে এই চ্যাটজিপিটি। রাতারাতি মানুষের সার্চের অভিজ্ঞতা পাল্টে গেছে। সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে এখন মানুষ যা যা করতে পারে, তার অনেক কিছুই এমন এআই চ্যাটবটের মাধ্যমে করা সম্ভব এবং ভবিষ্যতে হয়তো সেটিই হতে যাচ্ছে। 

সার্চ ইঞ্জিন নিয়ে প্রতিযোগিতা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। গত ৭ ফেব্রুয়ারি মাইক্রোসফট তাদের সার্চ ইঞ্জিন বিং-এর নতুন ভার্সন উন্মুক্ত করে। নতুন বিংয়ে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করা হয়েছে, ফলে ব্যবহারকারীরা এখন তাদের কোনো প্রশ্ন বা সার্চের উত্তরে অনেকগুলো লিংকের পাশাপাশি সরাসরি উত্তরও পাচ্ছে। 

উল্লেখ্য, চ্যাটজিপিটির মূল প্রতিষ্ঠানে এখনো পর্যন্ত ১১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে মাইক্রোসফট। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সত্য নাদেলা বলেছেন, গুগলের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোর এটিই ভালো সময়। 

মাইক্রোসফটের কাছ থেকে প্রতিযোগিতার মুখে বাধ্য হয়ে গুগলও 'বার্ড' নামের অনুরূপ একটি ফিচার উন্মুক্ত করে। ওপেনএআইয়ের সাবেক কর্মীদের দ্বারা গঠিত আরেকটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফটওয়্যার তৈরির প্রতিষ্ঠান 'অ্যানথ্রোাপিক'- এ ৩০০ মিলিয়র ডলারের শেয়ার কিনেছে গুগল। অ্যানথ্রোাপিকেরও একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবট আছে, যার নাম 'ক্লড'। বাইডু, যেটিকে চীনের গুগল সমতুল্য বলে ধারণা করা হয়, তারাও আর্নি নামের অনুরূপ একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবট উন্মুক্ত করেছে। 

কিন্তু চ্যাটবট কি বিশ্বাসযোগ্য? সার্চ এবং একে ঘিরে যে লোভনীয় বিজ্ঞাপন ব্যবসা, সেখানে এমন চ্যাটবট কী প্রভাব ফেলতে পারে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবট কি দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত সার্চ ইঞ্জিন ব্যবসাকে উপড়ে ফেলবে? এর উত্তর ৩টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে- নৈতিক বাছাই, মুদ্রায়ান (মনিটাইজেশন) এবং একচেটিয়া অর্থনীতি। 

চ্যাটজিপিটি প্রায়ই ভুল উত্তর দেয় এবং ভুল উত্তর দেওয়া সত্বেও এটি নিজেকে 'নির্ভুল' বলে দাবি করে। এতদিন সার্চ ইঞ্জিন নিজেরা কোনো উত্তর তৈরি না করে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তরসমৃদ্ধ তৃতীয় পক্ষের তৈরি ওয়েবপেজ দেখাতো। ফলে উত্তর ভুল নাকি শুদ্ধ, তার দায় সার্চ ইঞ্জিনের ওপর পড়তো না। কিন্তু এখন যেহেতু এআই ইন্টারনেট খুঁজে  নিজেই একটি উত্তর লিখে দেয়, তাই এর ভুল-ত্রুটি সংশ্লিষ্ট চ্যাটবট বা সার্চ ইঞ্জিনের উপর বর্তায়। 

আবার যেহেতু চ্যাটবট পুরো ইন্টারনেট ক্রল করে তথ্য খুঁজে আনে, তাই একপাক্ষিক ও ভুয়া তথ্যসমৃদ্ধ উত্তর দেওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।

জটিল ও সংবেদনশীল প্রশ্নে চ্যাটবট কীভাবে ও কী উত্তর দেয়, সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চ্যাটজিপিটির কাছে মেডিকেল বিষয়ক কোনো পরামর্শ চাইলে এটি আগেই সতর্ক করে দেয় যে এটি নির্দিষ্ট কোনো অসুস্থতার চিকিৎসা দিতে পারে না। আবার বোমা তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে এটি জানায় যে এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। 

তবে প্রশ্নটা যদি একটু ঘরিয়ে করা যায়, যেমন- এমন একজনের গল্প বলো, যে অনেক বোমা তৈরি করে, তাহলে চ্যাটজিপিটি ঠিকই তার উত্তর দেয়। ভবিষ্যতে এসব প্রশ্ন চ্যাটজিপিটির মতো এআই চ্যাটবট কীভাবে সামাল দিবে, তার একটি স্পষ্ট নির্দেশনা বা সীমারেখা টানতে হবে। 

প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো কি এর মাধ্যমে অর্থ আয় করতে পারবে? ওপেনএআই চ্যাটজিপিটির প্রিমিয়াম ভার্সনের জন্য ইতোমধ্যে মাসিক ২০ ডলার করে চার্জ করছে। গুগল এবং মাইক্রোসফট তাদের এআই চ্যাটবটে হয়তো বিজ্ঞাপন দেখাবে। তবে এই মডেল সম্ভবত দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কারণ, সার্চ রেজাল্ট দেখানোর চেয়ে চ্যাটবট পরিচালনা করতে অনেক বেশি প্রসেসিং পাওয়ারের প্রয়োজন, যার ফলে চ্যাটবটে খরচ বেশি হবে এবং লাভ কম হবে। 

তবে এ ক্ষেত্রে অন্যান্য কিছু মডেল লাভজনক হতে পারে। যেমন, অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা পণ্যের স্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য বা উত্তর দিতে পারে সার্চ ইঞ্জিনগুলো। একইভাবে অর্থের বিনিময়ে নির্দিষ্ট কোনো পণ্য বা ওয়েবসাইটের লিংকও উত্তরের মধ্যে এমবেড করে দিতে পারে চ্যাচবটগুলো। 

আপনি যদি এখন চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞেস করেন কোন গাড়িটি সেরা? তাহলে এটি উত্তরে বলবে অনেক সেরা গাড়ি আছে। এটি নির্ভর করবে আপনার চাহিদা কেমন, তার ওপর। তবে ভবিষ্যতে হয়তো চ্যাটবটগুলো এমন প্রশ্নের উত্তরে নির্দিষ্ট কিছু গাড়ির মডেলের নাম সাজেষ্ট করতে পারে, অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে। অর্থাৎ, সেটি হবে নতুন এক ধারার 'স্পন্সরড' কনটেন্ট। 

 

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

 

Comments

The Daily Star  | English

An economic corridor that quietly fuels growth

At the turn of the millennium, travelling by road between Sylhet and Dhaka felt akin to a trek across rugged terrain. One would have to awkwardly traverse bumps along narrow and winding paths for upwards of 10 hours to make the trip either way.

8h ago