‘কর্মীবান্ধব’ অবস্থান থেকে সরে আসছে গুগল

অনেক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম কর্মীবান্ধব প্রতিষ্ঠান গুগল শুধু একটি ই-মেইলের মাধ্যমে একদিনে ১২ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে, এই ব্যাপারটা এখনো অনেক কর্মী মানতে পারছেন না। 
‘কর্মীবান্ধব’ অবস্থান থেকে সরে আসছে গুগল
কর্মীদের উন্নত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে গুগলের সুনাম আছে। ছবি: রয়টার্স

গুগলের একজন কর্মী গত ২০ জানুয়ারি হঠাৎ করেই নিজের ওয়ার্ক সিস্টেমে প্রবেশ করতে না পেরে সাপোর্ট সেন্টারে কল করে জানতে পারেন তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়ছে। আরেক কর্মীর ম্যানেজার ছিলেন ছুটিতে, তাই তিনি বুঝতেও পারছিলেন না কার সঙ্গে যেগাযোগ করবেন। আরেকজন সকালে নিজের বাচ্চাদের সামলাচ্ছিলেন, এমন সময় তার ফোনে অসংখ্য মেসেজ আসা শুরু করলো। সবার একই জিজ্ঞাসা 'তোমার চাকরি আছে তো?'

ওই দিন গুগল যে ১২ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছিল, এই ৩ জন কর্মীই ছিলেন সেই তালিকায়। গুগলের ইতিহাসে এই প্রথম এত বিশাল সংখ্যক কর্মীকে একদিনে ছাঁটাই করা হলো। কিন্তু যে উপায়ে ছাঁটাই করা হয়েছে, সেটিই অনেক কর্মীর গভীর মর্মবেদনার কারণ। 

অনেক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম কর্মীবান্ধব প্রতিষ্ঠান গুগল শুধু একটি ই-মেইলের মাধ্যমে একদিনে ১২ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে, এই ব্যাপারটা এখনো অনেক কর্মী মানতে পারছেন না। 

চাকরি হারানো কর্মীদের মধ্যে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গুগলে কাজ করেছেন, এমন কর্মী যেমন ছিলেন, তেমনি অসুস্থতার ছুটিতে থাকা এবং সন্তান জন্মদানের জন্য ছুটিতে থাকা কর্মীরাও ছিলেন। এমনকি কর্মীদের অফিসে গিয়ে তাদের জিনিসপত্র নিয়ে আসা ও বাকি কর্মীদের বিদায় বলার সুযোাগও দেওয়া হয়নি। 

প্রযুক্তিবিশ্বে যেভাবে সবার চাকরি যায়, গুগলও সেভাবেই কর্মীদের চাকরিচ্যুত করেছে। তবে এত বছর ধরে গুগলের যে কর্মীবান্ধব সুনাম ছিল, তার সঙ্গে এই আচরণ মানানসই নয়। গুগল সব সময়ই কর্মীদের চাহিদা, সুযোগ-সুবধিাকে বেশি প্রাধান্য দিতো। বড় বড় বোনাস ও সুযোগ সুবিধা, শিশু যত্ন কেন্দ্র, বিনামূল্যে উন্নতমানের খাবার, ইত্যাদি ছিল গুগলের কর্মীবান্ধব নীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। গুগলের যে কেউ যে কাউকে যেকোনো ব্যাপারে প্রশ্ন করতে পারত- কিন্তু এখন এই সুযোগও সঙ্কুচিত করা হয়েছে।  

সদ্য চাকরিচ্যুত হওয়া অনেক কর্মী বলছেন, গুগল যে তার কর্মীবান্ধব নীতি থেকে অনেক দিন ধরেই সরে আসছিল, এই ঘটনা তার সবশেষ উদাহরণ। স্বচ্ছতা, উদারতার যে রীতি গুগলে ছিল, সেটি এখন অনেকটাই নেই। 

গুগলের বর্তমান ও সাবেক ৬ জন কর্মী মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে জানিয়েছে, কয়েক বছর ধরেই গুগল কর্মীবান্ধব নীতি থেকে সরে আসছে। কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা কমানো হয়েছে, জেষ্ঠ্য নেতৃত্বের কাছে কর্মীদের প্রবেশাধিকারও সীমিত করা হয়েছে। এমনকি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসার দীর্ঘমেয়াদি সুফলের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি সুফলের দিকে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে এখন। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মী বলেন, 'কর্মীদের ওপর এসবের কেমন প্রভাব পড়বে, সেসব না ভেবেই এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।'

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের প্রযুক্তি-ইতিহাসবিদ ও সিলিকন ভ্যালির পরিবর্তন নিয়ে লেখালেখি করা প্রফেসর মার্গারেট ও' মারা বলেন, 'এত বিশাল সংখ্যক কর্মীকে ই-মেইলের মাধ্যমে চাকরিচ্যুত করাটা এটাই প্রমাণ করে যে, গুগল একটি বিশাল এবং আমলাতান্ত্রিক কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।'

'গতানুগতিক কোম্পানি নয়'

গুগলের প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিন ও ল্যারি পেজ ২০০৪ সালে কোম্পানিটির প্রথম শেয়ারহোল্ডারদের লেখা এক চিঠিতে বলেছিলেন, 'গুগল কোনো গতানুগতিক কোম্পানি না। আমরা তেমনটি হতেও চাই না।' এই চিঠিতে গুগলের প্রতিষ্ঠাতারা বলেছিলেন, 'আমাদের কর্মীরাই (যারা নিজেদের গুগলার বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন) আমাদের কাছে সব। কর্মীদের আমরা আরও সুযোগ সুবিধা দেব, এমনটা অনুমান করতে পারেন।'

চিঠিতে সের্গেই ব্রিন ও ল্যারি পেজ জোর দিয়ে বলেছিলেন, গুগলের কর্মীরা বিশ্বকে আরও উন্নত করার দীর্ঘস্থায়ী মিশনে জড়িত আছেন। কর্মীদের নিজের কাজের বাইরে বিভিন্ন সাইড প্রজেক্টে ২০ শতাংশ সময় ব্যয় করার উৎসাহ দিতো গুগল। এটা নিয়ে গুগলের সুনাম আছে। এসব অনেক প্রজেক্ট থেকেই গুগলের অনেক সফল পণ্যের জন্ম হয়েছে। 

দীর্ঘদিন ধরে গুগলে কাজ করেছেন এমন একজন কর্মী বলেন, প্রথমদিকে ব্রিন ও পেজ প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে সব কর্মীদের নিয়ে একসঙ্গে মিটিং করতেন, অভ্যন্তরীণভাবে যা 'টিজিআইএফ' (থ্যাংক গড ইটস ফ্রাইডে) নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে সুন্দর পিচাই এই মিটিংটি বন্ধ করে দেন। ফলে উন্মুক্ত মিটিংয়ে কর্মীরা যেসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা ও প্রশ্ন করার সুযোগ পেতো, সেটি বন্ধ হয়ে যায়। 

প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কাজের ধরন ও রীতি নিয়ে গুগল যে আদর্শ নির্ধারণ করে দিয়েছিল, সেটি অনুসরণ করেই পরবর্তীতে বড় ও সফল কোম্পানিগুলো উন্মুক্ত অফিস কাঠামো, উচ্চ বেতন, অফিসের ভেতর বিনোদন ও শরীরচর্চার সুযোগ, কর্মীদের বাইরে পিকনিকে নিয়ে যাওয়া, ইত্যাদি সুবিধা চালু করে। কিন্তু ২০১৫ সালটি ছিল অনেকদিক থেকেই এসব সুযোগ-সুবিধার জন্য বাঁক বদলের বছর। 

সে বছরের মার্চে মর্গান স্ট্যানলির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) ও ওয়াল স্ট্রিটের অন্যতম প্রভাবশালী নারী রুথ পোরাট গুগলের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। এর কয়েকমাস পর গুগলের প্রধান নির্বাহী নিযুক্ত হন সুন্দর পিচাই। ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন গুগলের মূল কোম্পানি 'অ্যালফাবেট' প্রতিষ্ঠা করেন। তখনই গুগলের কর্মীদের আচরণবিধি থেকে 'ডোন্ট বি ইভিল' টার্মটি বাদ দিয়ে 'ডু দ্য রাইট থিং' লেখা হয়। গুগলের স্বাতন্ত্র্য বোঝাতে কোম্পানিটির শুরুর দিক থেকেই 'ডোন্ট বি ইভিল' মোটো ব্যবহার করা হতো। 

গুগলের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে একজন সাবেক কর্মী বলেন, 'অপনি ওয়াল স্ট্রিট থেকে সিএফও এবং ব্যাংকারদেরকে নিযোগ দেবেন, তারাতো ওয়াল স্ট্রিটকেই খুশি করতে চাইবে। ফলে প্রতিষ্ঠানের মূল নীতি থেকে আপনি ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকবেন।'

অ্যলফাবেট প্রতিষ্ঠা করে এর অধীনে গুগলসহ সবগুলো কোম্পানিকে অঙ্গীভুত করার ফলে কোম্পানির শেয়ারমূল্য অনেক বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এটা সত্যি। তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে গুগলের যে পরিচিত কর্মীবান্ধব পরিবেশ ছিল, সেটিও বদলে গিয়েছিল।   

২০১৭ ও ২০১৮ সালের কিছু ঘটনাও গুগলের কাজের পরিবেশ ও সুনামের ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ও এসব বিষয়ে গুগলের যথাযথ পদক্ষেপের অভাবের বিরুদ্ধে অনেক কর্মীই তখন ধর্মঘট করেছিল। কর্মীরা তখন চীন ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে গুগলের ব্যবসায়িক চুক্তি, চুক্তির ব্যাপারে স্বচ্ছতার অভাব এবং এসব চুক্তির বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে গুগলের পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেন। কর্মীদের এসব বিক্ষোভের মুখে গুগল যৌন হয়রানি ও পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে ইতিবাচক কিছু পরিবর্তন আনে। তবে একই সঙ্গে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির যে দীর্ঘ ঐতিহ্য ছিল, তাতে অনেকখানি নিজেদেরকে গুটিয়ে আনে।  

ব্যাপক চাকরিচ্যুতি নিয়ে কর্মীদের মধ্যে দুশ্চিন্তা ও ক্ষোভ

অন্যান্য বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মতো গুগলও চাকরিচ্যুতির কারণ হিসেবে আর্থিক দুরবস্থাকেই সামনে এনেছে। করোনা মহামারির কারণে ইন্টারনেটভিত্তিক সেবার চাহিদা অনেক বেড়ে যাওয়ায় গত ২ বছরে গুগল বিশ্বজুড়ে ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মী নিয়োগ দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মন্দা পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ায় অনেক বিজ্ঞাপনদাতা তাদের ব্যয় সংকোচন করেছেন এবং এর প্রভাব পড়েছে গুগলের আয়ে। গুগল বলছে, এসব কারণে তাদের বাধ্য হয়ে কর্মীছাঁটাই করতে হয়েছে। 

এত বড় কর্মীছাঁটাইয়ের ফলে কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা ও দুশ্চিন্তা বেড়েছে।

চুকরিচ্যুত কর্মীদেরকে কিছু সুযোগ-সুবিধাসহ ৬ সপ্তাহের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ দিয়েছে গুগল। সাম্প্রতিক বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মীছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে, সে তুলনায় গুগলের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বেশি।

তা সত্বেও বর্তমান এবং সাবেক কর্মীদের মধ্যে এভাবে কর্মীছাঁটাই নিয়ে অসন্তোষ আছে। সম্প্রতিকালে সুইজারল্যান্ডে কর্মরত শতশত গুগল কর্মী সাম্প্রতিক কর্মীছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধর্মঘট করেছে। যারা এখনো কর্মরত, তাদের অনেকেই 'ক্ষুদ্ধ' ও 'আতঙ্কিত'।

ছবি: কর্মীদের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, শরীরচর্চা, খাবারসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবধিা দেওয়ার জন্য গুগলের অনেক সুনাম ছিল। ক্রেডিট: রয়টার্স

সূত্র: সিএনএন
গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

Comments