প্রযুক্তিবিষয়ক যে মিথগুলো অনেকে বিশ্বাস করেন

অনেক অ্যাপল গ্রাহক মনে করেন যে তাদের ডিভাইস ভাইরাস এবং ম্যালওয়্যারের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য।
প্রযুক্তিবিষয়ক যে মিথগুলো অনেকে বিশ্বাস করেন
ছবি: সংগৃহীত

প্রযুক্তিবিষয়ক কিছু মিথ আছে, যেগুলো প্রচলিত হলেও বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই, তবে এখনো অনেকে বিশ্বাস করেন। 

আসুন, আজকের লেখা থেকে এবার আসল সত্যটা জেনে নিই।

ওয়েব এবং ইন্টারনেট একই জিনিস

আমরা প্রায়ই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ) এবং ইন্টারনেটকে একই মনে করি। কিন্তু দুটি ভিন্ন জিনিস।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব হচ্ছে বিশাল এক তথ্যভাণ্ডার, যাতে ইন্টারনেটের সাহায্যে প্রবেশ করা যায়। আর ইন্টারকানেক্টেড নেটওয়ার্ক এবং সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে ইন্টারনেট। এটি ছোট ছোট নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে তৈরি এক বিশাল নেটওয়ার্ক যা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। ইন্টারনেট হলো এমন একটি নেটওয়ার্ক যার মাধ্যমে সারা বিশ্বের  স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, কম্পিউটার এবং অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে এবং ডাটা বিনিময় করে।

আমরা ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় ব্রাউজার ব্যবহার করি। এই ব্রাউজারের সাহায্যেই আমরা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে প্রবেশ করি, যেখানে যেকোনো ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, শপিং ওয়েবসাইট, স্ট্রিমিং সার্ভিসসহ যেকোনো তথ্যই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে পাওয়া যায়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদানের কাজ হয় এইচটিটিপি অথবা এইচটিটিপিএস- এই দুটো ট্রান্সফার প্রটোকলের যেকোনো একটির মাধ্যমে।  

এআই মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীভিত্তিক সিনেমা ও বই অনেক মানুষের মনে এমন একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এআই নিয়ে যেভাবে কাজ করছে, তাতে মানুষের মনে এই ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই একটা উদ্বেগ রয়েছে যে এআই একদিন মানব সভ্যতা নিয়ন্ত্রণ করবে। আবার অনেকের ধারণা, এআই মানুষকে আরও অলস করবে। 

এটা এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে এআই এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে। ভাষার বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও ব্যবহার, সাধারণ জ্ঞানের ব্যবহার এবং সহজে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য এআই কার্যকরী একটি প্রযুক্তি। 

বর্তমানে চ্যাটজিপিটি ও গুগল বার্ডের মতো এআই চ্যাটবটগুলোর সঙ্গে কথোপকথন করা যাচ্ছে। কিন্তু একজন মানুষের সঙ্গে কথোপকথন আর চ্যাটবটের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্যে এখনো অনেক পার্থক্য রয়ে গেছে। 

২০১৮ সালে জার্নাল অব আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স রিসার্চ-এর একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, আগামী ৪৫ বছরের মধ্যে হিউম্যান-লেভেল মেশিন ইন্টিলিজেন্স (এইচএলএমআই) ঘটার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ। 

এআই এখনো মানুষের সমান যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। তবে বর্তমানে এআই প্রযুক্তি নিয়ে যেভাবে গবেষণা ও সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে হয়তো আরও বৃদ্ধিমান এআই প্রযুক্তি পেতে বেশি দেরি হবে না। 

পাবলিক ওয়াইফাই ক্ষতিকর নয়

আমরা যেখানেই যাই না কেন, সব সময়ই ইন্টারনেটে যুক্ত থাকতে চাই। পাবলিক ওয়াই-ফাই প্রায়ই এই ইচ্ছা পূরণ করে। তবে, ডিভাইসকে পাবলিক ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করাটা বিপজ্জনক হতে পারে। 

পাবলিক ওয়াইফাই জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা থাকে। অর্থাৎ, যে কেউ এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারে। যদিও বেশিরভাগ পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারকারীই শুধু ইন্টারনেট ব্রাউজ করার জন্যই এই নেটওয়ার্কগুলো ব্যবহার করে, তবে একই সঙ্গে ক্ষতিকর ব্যবহারকারীরাও মানুষের মূল্যবান তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে এই নেটওয়ার্কগুলো ব্যবহার করে। 

পাবলিক ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অপরাধীরা চাইলে আপনার তথ্যে প্রবেশাধিকার নিতে পারে এবং আপনার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন- ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের পিন, বিভিন্ন ওয়েবসাইটের লগইন আইডি পাসওয়ার্ড হাতিয়ে নিতে পারে। 

দরজা বন্ধ থাকলে ওয়াইফাই সিগন্যাল চলাচলে বাধা পায়

কাজের সময় ওয়াই-ফাই সংযোগ যদি ঠিকমতো কাজ না করে, তখন খুবই বিরক্ত লাগে। অনেকগুলো কারণে ওয়াই-ফাই সংযোগ বাধাগ্রস্থ হতে পারে। যেমন- প্রচুর ধাতব বস্তুর উপস্থিতি থাকলে। ধাতু ওয়াই-ফাই সংকেতকে দুর্বল বা এমনকি ব্লক করতে পারে। সিরামিক টাইলস, কংক্রিট এবং দূরত্বও দুর্বল ওয়াই-ফাই সংকেতের অন্যতম কারণ হতে পারে। 

যাইহোক, পিভিসি বা কাঠের দরজা বন্ধ করে রাখলে ওয়াই-ফাই সংযোগে কোনো প্রভাব ফেলে না। এটা বহুল প্রচলিত একটি কথা, যা এখনো অনেকে বিশ্বাস করেন। কিন্তু সাধারনভাবে এটি সত্য নয়। ডিভাইস এবং রাউটারের মধ্যে সবচেয়ে খোলামেলা পথ তৈরি করা সর্বদা সেরা বিকল্প, এটা ঠিক। যদি আপনার ওয়াই-ফাই সিগন্যালটি দুর্বল হয়, তবে আপনার দরজার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা নেই।

প্রযুক্তি বিষয়ক সব চাকরিতেই ডিগ্রি থাকা লাগে

সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং ডাটা সায়েন্টিস্টের মতো প্রযুক্তি খাতের কিছু কিছু চাকরির ক্ষেত্রে ডিগ্রি থাকাকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও এই খাতের বহু চাকরির ক্ষেত্রে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির বাধ্যবাধকতা নেই। বিশেষ করে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ডিগ্রির চেয়ে দক্ষতাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। এমনকি এখন সফটওয়্যর ইঞ্জিনিয়ার চাকরির জন্যও আর ডিগ্রিকে তেমন একটা প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। এজন্য গুগল, মাইক্রোসফট, টেসলার মতো কোম্পানির অনেক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই। তবে তারা যথেষ্ঠ দক্ষ। 

সাইবার সিকিউরিটি অ্যানালিস্ট, ওয়েব ডেভেলপার, ডিজিটাল মার্কেটার, ফ্রন্ট এন্ড ডেভলপার, নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার, আইটি সাপোর্ট বিশেষজ্ঞ, গ্রাফিক ডিজাইনারের মতো পোস্টে এখনো অনেক ক্ষেত্রে ডিগ্রি থাকাকে বাড়তি মূল্যায়ন করা হয়। 

তবে এটি পুরোপুরি নির্ভর করছে নিয়োগদাতা কোম্পানির ওপর। 

টেক রেডিয়েশন বা বিকিরণ ক্ষতিকর

আপনি হয়তো কখনো না কখনো শুনেছেন মাথার কাছে ফোন ধরে রাখা বা কোলে ল্যাপটপ রাখলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এমনকি কেউ কেউ  বিশ্বাস করেন এই বিকিরণ ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগও তৈরি করতে পারে। কিন্তু এর কি কোনো ভিত্তি আছে?

সংক্ষেপে বলতে গেলে, আপনার প্রযুক্তি ডিভাইসগুলো থেকে নির্গত বিকিরণ বিপজ্জনক নয়। স্মার্টফোনের মতো অনেক ডিভাইস যোগাযোগের জন্য রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে, তবে নির্গত বিকিরণ উদ্বেগজনক নয়।

আমেরিকান ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাসোসিয়েশন (এফডিএ) বলেছে, মোবাইল ফোন থেকে নির্গত বিকিরণ জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। 

অ্যাপল ডিভাইসে ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে না

অনেক অ্যাপল গ্রাহক মনে করেন যে তাদের ডিভাইস ভাইরাস এবং ম্যালওয়্যারের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয়।

সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো ডিভাইসই পুরোপুরি নিরাপদ নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, কোনো প্রযুক্তি বা ডিভাইস ব্যবহারের সময় সাইবার নিরাপত্তার ব্যাপারটি  সবাইকেই মাথায় রাখতে হবে এবং অ্যাপল ব্যবহারকারীরাও এর ব্যতিক্রম নয়।

সাধারণ অ্যাপল ডিভাইসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অন্যান্য ডিভাইসের তুলনায় কঠিন ও দুর্ভেদ্য। এজন্যই  হয়তো কথাটি প্রচলিত হয়েছে। তবে ইন্টারনেটের এই যুগে এটা মনে রাখতে হবে যে কোনো কিছুই দুর্ভেদ্য নয়। 

সূত্র: মেকইউজঅব

গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

Comments