পাথর ও বালু তুলে নিলে নদীর যে ক্ষতি

সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র এখন পাথরশূন্য হয়ে পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে। ছবি: শেখ নাসির

নদটির নাম নাগর। স্থানীয় লোকেরা ডাকেন 'ছোট নদী' বলে। নওগাঁর পতিসরে অবস্থানকালে এই নদ নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন শিশুতোষ কবিতা 'আমাদের ছোট নদী'। বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন—

'চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,

একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।'

কিন্তু বাংলাদেশের সব নদীতে এখন আর বালু 'চিক্‌ চিক্‌' করে না। পাথর, বালু লুটপাট হয়ে যাওয়ায় নদীগুলো হয়ে গেছে কর্দমাক্ত।

দেশের বিভিন্ন এলাকার নদীগুলো যখন 'প্রাণসংকটে' তখনও সিলেটের জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জের পাহাড়ি নদীগুলোতে বিছিয়ে ছিল ছোটবড় পাথর। এর উপর দিয়ে প্রবাহিত হতো স্বচ্ছ জলধারা। নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে সেখানে যেতেন পর্যটকরা। সেই নদীগুলোই এখন পাথরশূন্য। গত কয়েকমাসে নদীগুলো থেকে প্রায় সব পাথর লুট হয়ে গেছে। পর্যটনকেন্দ্রগুলো শ্রী হারিয়ে খানাখন্দে ভরা বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো নদীর পাথর ও বালু কি শুধু সৌন্দর্যের বিষয়? নদী থেকে পাথর তুলে নিলে পরিবেশের ওপর এর কী প্রভাব পড়ে? নদীর প্রতিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রে বালু, পাথর কতটা ভূমিকা রাখে?

নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীতলদেশের পাথর ও বালু প্রাকৃতিক রক্ষাকবচের মতো কাজ করে, যা স্রোতের আঘাত থেকে নদীর পাড়কে রক্ষা করে এবং ভাঙন প্রতিরোধ করে। সেই সঙ্গে নদীর জলজ প্রাণ তথা মাছের আবাস ও খাদ্য তৈরিতে বালু ও পাথর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশের নদী রক্ষায় দীর্ঘদিনের আন্দোলন করছে রিভারাইন পিপল। সংগঠনটির মহাসচিব শেখ রোকন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, নদীর স্বাস্থ্য ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা টিকে থাকার জন্য বালু ও পাথর তিনটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ:

ক. নদীর বালু ও পাথর প্রাকৃতিক ছাঁকনি হিসেবে কাজ করে পানির গুণগত মান বজায় রাখে। পলি জমার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নদী থেকে ভূমি গঠিত হয়। এটি ছাড়া নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং সেচের জন্য প্রয়োজনীয় প্রবাহ থাকে না।

খ. বালু ও পাথর নদীর খরস্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করে মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর বসবাসের উপযোগী শান্ত পরিবেশ তৈরি করে। এখানেই মাছ ডিম পাড়ে, বংশবৃদ্ধি করে এবং তাদের প্রয়োজনীয় খাবার তৈরি হয়। বালু ও পাথর না থাকলে তীব্র স্রোতের কারণে মাছের আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যায়। আর নদীতে মাছ ও জলজ প্রাণীরা না থাকলে নদীর বাস্তুসংস্থান নষ্ট হয়ে যায়।

গ. নদীর আঁকাবাঁকা পথ এবং তার স্বাভাবিক রূপ, যা মরফোলজি নামে পরিচিত, তা বালু ও পাথরের স্তরের ওপর নির্ভর করে। এটি নদীর প্রবাহকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।

শেখ রোকন জানান, নদী থেকে পাথর ও বালু তুলে ফেললে প্রথমে যে ক্ষতিটা হয় তা হলো নদীতে চর পড়া। যে জায়গায় চর পড়ে তার বিপরীত দিকে নদী ভাঙে। জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে ঝিনাই নদীতে এরকম একটি পরিস্থিতিতে আস্ত ব্রিজ ভেঙে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। ভোলাগঞ্জের পাথর তোলার কারণে কোম্পানীগঞ্জের দিকে চর পড়ে গেছে।

তাহলে নদীর নাব্যতা বজায় রাখতে কি পাথর বা বালু উত্তোলন করা যেতে পারে? ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির ফয়জুল করিমের এরকম একটি বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাকে পাথর উত্তোলনের পক্ষে যুক্তি দিতে শোনা যায়। পরিবেশ রক্ষার দোহাই দিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, পাথর না তোলার কারণে বরং পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। নদী ভরাট হওয়ার কারণে বন্যা হচ্ছে।

সিলেটের নদীগুলো থেকে পাথর উত্তোলনের ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য হতেও দেখা যায়।

নদী থেকে বালু, পাথর তুলে নাব্যতা রক্ষা করা যায় কিনা জানতে চাইলে শেখ রোকন বলেন, এটা করা হলে বরং ব্যাপকভাবে নদী ভাঙন হবে। নদী থাকে বালু সরিয়ে ড্রেজিং না করে পরিবেশবান্ধব একটি উপায়ের কথা জানান তিনি।

বলেন, ড্রেজিং-এর তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হলো আমাদের শত শত বছরের পুরোনো 'বান্ধাল' (ইংরেজিতে Bandalling) পদ্ধতি। বাঁশ ও ধইঞ্চা গাছ দিয়ে স্রোতের গতিপথ সামান্য ঘুরিয়ে দিয়ে নদীর গভীরতা ও নাব্যতা স্বাভাবিক রাখা হতো। এই পদ্ধতিতে কোটি টাকার বাজেট করতে হয় না। মাত্র কয়েক লাখ টাকায় কাজ হয়ে যায়। এতে মাছের ক্ষতি হয় না এবং নদী ভাঙনও প্রতিরোধ করা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞের মতে, পঞ্চাশের দশক থেকে ইউরোপীয় প্রকৌশল পদ্ধতি আমদানি করার ফলেই নদী ভাঙন বেড়েছে এবং মৎস্য সম্পদ কমেছে। নদীর স্বাস্থ্য রক্ষা করতে যান্ত্রিক আগ্রাসন বন্ধ করে 'বান্ধাল'-এর মতো লোকায়ত ও প্রকৃতিবান্ধব পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়াই এই অঞ্চলের নদীগুলোর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সমাধান।

Comments

The Daily Star  | English

ACC finds Tk 57.5cr suspicious transactions in Joy’s bank accounts

The anti-graft agency also uncovered information about Tk 60.14 crore in unexplained wealth

1h ago