‘দমন-পীড়ন নয়, যোগ্য নেতৃত্বই জনপ্রশাসন ঠিক করতে পারে’

অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করে একটি অধ্যাদেশ জারি করার পর তা নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিবাদের মুখে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে সচিবালয়ে।

সরকার অধ্যাদেশটি পর্যালোচনা করছে বলে জানালেও বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি।

নতুন অধ্যাদেশ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভ নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট লেখক ফিরোজ মিয়ার সঙ্গে।

দ্য ডেইলি স্টার: সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ প্রণয়নকে কেন্দ্র করে কর্মচারীদের আন্দোলনকে কীভাবে দেখছেন?

ফিরোজ মিয়া: কর্মচারীরা তাদের অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই আন্দোলন করছেন বলে আমার মনে হয়। এর আগেও এমন একটি আইন ছিল, যেখানে কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত ছাড়াই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল।

যেমন: সদ্য প্রণীত অধ্যাদেশে সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) ১৯৭৯ এর কিছু ধারা যুক্ত করা হয়েছে। এই বিশেষ বিধানটি ২০১৯ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। অতীতে বিশেষ বিধানের অধীনে মূলত নিম্ন স্তরের কর্মচারীদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হতো, যারা প্রকৃত অর্থে নিরীহ। কর্মচারী নেতাদের চাকরি যায়নি, কারণ তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। এসব অভিজ্ঞতা থেকেই কর্মচারীরা অধ্যাদেশের অপপ্রয়োগের আশঙ্কা করছেন, যা অমূলক নয়।

ডেইলি স্টার: ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশের চেয়ে সম্প্রতি প্রণীত অধ্যাদেশের পার্থক্য কতটা?

ফিরোজ মিয়া: সম্প্রতি প্রণীত অধ্যাদেশটি ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশের চেয়ে অনেক বেশি নিবর্তনমূলক। এ কারণে এটির অপপ্রয়োগের আশঙ্কাও বেশি। নতুন অধ্যাদেশে ভাষাগত ও আইনগত অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে।

আগের অধ্যাদেশে কর্মচারীদের মধ্যে 'অসন্তোষ সৃষ্টি'র কারণে শাস্তির বিধান ছিল। বর্তমান অধ্যাদেশে 'অনানুগত্য'র কারণে শাস্তি দেওয়া যাবে। কোনো দুর্নীতিবাজ অফিস প্রধানের কথা যদি ভালো কর্মচারী না শোনে, তখন সেই ভালো কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনানুগত্যের অভিযোগ এনে চাকরিচ্যুত করে দেয়, তখন সেটা কেমন হবে?

নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী অধঃস্তন কর্তৃপক্ষও সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তকে দোষী বা নির্দোষ সাব্যস্ত করতে পারবে। এটা সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদের দফা (১) এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এছাড়া অভিযুক্ত কর্মচারীর বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্তের সুযোগ রাখা হয়নি। এতে অপপ্রয়োগের আশঙ্কা অনেক বেশি। কর্তৃপক্ষ অন্যায় ও খামখেয়ালিভাবে নিজের ইচ্ছামতো যখন তখন যে কাউকে চাকরিচ্যুত করতে পারবে। তাই এটি গ্রহণযোগ্য অধ্যাদেশ হয়নি।

ডেইলি স্টার: সচিবালয় কর্মচারীদের আন্দোলনে সাধারণত নারীদের দেখা যায় না। এবার অনেক নারীও বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিয়েছেন। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

ফিরোজ মিয়া: নিবর্তনমূলক এই অধ্যাদেশটি নারীদের জন্য আরো বেশি ভয়ঙ্কর হওয়ার আশঙ্কা আছে। খারাপ চরিত্রের অফিসার তার অধীনস্ত নারী কর্মকর্তাকে বাজে প্রস্তাব দিলে এবং তাতে সাড়া না পেলে ভিন্ন আঙ্গিকে অনানুগত্যের অভিযোগ আনতে পারে। তাই নারীদের আশঙ্কা প্রকাশের যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ আছে, যে কারণে নারীরা অনিরাপদ বোধ করতে পারেন।

ডেইলি স্টার: নতুন অধ্যাদেশের আর কোন বিষয় অযৌক্তিক মনে হয়েছে?

ফিরোজ মিয়া: সরকারি চাকরিতে অভিযুক্ত কর্মচারীকে শাস্তি দেওয়ার আগে অফিসিয়াল নোটিশ, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি এবং কর্মচারীর বাড়িতে নোটিশ টাঙিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়।

নতুন অধ্যাদেশে বিকল্প হিসেবে 'ই-মেইল'র মাধ্যমেও নোটিশ দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। একজন মানুষ তার ইমেইল কয়েক সপ্তাহ না খুলতে পারেন, ইমেইল হ্যাক হতে পারে বা তিনি এমন কোনো জায়গায় থাকতে পারেন যেখানে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস নেই।

কর্তৃপক্ষ যদি এসবের সুযোগ নিয়ে কোনো কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত বা শাস্তি দেন, তা কি মানবিক হবে? আইন প্রণয়নের সময় রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা যদি এসব বিষয়ে নজর না দেন তাহলে সাধারণ কর্মচারীরা কীভাবে নিরাপদ বোধ করবে?

ডেইলি স্টার: যারা আইনটি খসড়া করেছেন, এটি কি তাদের দুর্বলতা নয়?

ফিরোজ মিয়া: নিঃসন্দেহে এটা তাদের দুর্বলতা। তাড়াহুড়া করে কাজ করলে বা অভিজ্ঞদের সহযোগিতা না নিলে এমন ভুল হতে বাধ্য।

সংসদ থাকলে অনেক খুটিনাটি বিষয় সংসদে আলোচনা হয়। কিন্তু এখন সংসদ না থাকায় যেনতেনভাবে আইন সংশোধন হচ্ছে, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আবার অনেক ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিলেও কিছু সিনিয়র অফিসার নিজেদের পাণ্ডিত্য জাহির করতে গিয়ে সমস্যা তৈরি করেন। আমার কর্মজীবনে দেখেছি, অনেক সিনিয়র অফিসার আইন প্রণয়ন সম্পর্কে ভালো জানেন না, কিন্তু শুধু সিনিয়র হওয়ার কারণে নানান অযৌক্তিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেন। তারা ভাবেন, পাণ্ডিত্য জাহির করতে না পারলে হয়তো জুনিয়ররা তাকে যোগ্য মনে করবে না।

ডেইলি স্টার: সচিবালয়ে আন্দোলন করছেন তুলনামূলক নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা। ক্যাডার অফিসাররা চুপ কেন, আপনিও তো ক্যাডার অফিসার ছিলেন?

ফিরোজ মিয়া: আইন প্রয়োগ হয় দুর্বলদের জন্য। এ কারণে দুর্বলরা আন্দোলন করছেন। ক্যাডার অফিসারদের ইন্ধনও এই আন্দোলনে আছে, কিন্তু তারা প্রকাশ্যে যাবেন না।

আরেকটি কারণ হচ্ছে, ক্যাডার অফিসারদের দুর্নীতি বা অন্য কোনো অপরাধ ক্যাডার অফিসারই তদন্ত করেন। তারা নিজেদের লোকদের সহজে শাস্তি দেন না। যে কারণে আমাদের প্রশাসন আজকের দৈন্য দশায় পড়েছে।

ডেইলি স্টার: সরকারি কর্মচারীরা অনেক প্রশ্নবিদ্ধ কাজ করছেন, খারাপ কর্মচারীদের জন্য কঠোর আইন কি প্রয়োজন নেই?

ফিরোজ মিয়া:  জনদুর্ভোগ সৃষ্টির করার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের দায় আছে, এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বিশেষ করে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর সরকারি কর্মচারীরা জনগণকে জিম্মি করার মতো কাজ কোনোভাবেই করতে পারেন না, এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

তবে এক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্ব থাকলে সামাল দেওয়া যেত। কিন্তু বর্তমান সরকার সেটা পারেনি। তাই তারা কালাকানুন প্রণয়নের দিকে নজর দিয়েছে, যেটা দিয়ে কার্যত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।

ডেইলি স্টার: তাহলে পরিস্থিতি সামালের উপায় কী?

ফিরোজ মিয়া: বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ এবং দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য অফিসার নিয়োগ। এরপর আরও কঠোর আইন বা অধ্যাদেশ প্রণয়নে সমস্যা সেই, কিন্তু সেটি নির্বতনমূলক হওয়া যাবে না। কর্মচারীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।

ডেইলি স্টার: সরকারি কর্মচারীরা কি এভাবে আন্দোলন করতে পারেন?

ফিরোজ মিয়া: আদর্শ দৃষ্টিতে দেখতে গেলে পারেন না। কিন্তু সরকার যখন দমনমূলক আইন-বিধি চাপিয়ে দিতে চায় তখন আন্দোলনের বৈধতা তৈরি হয়।

তাই দমন-পীড়ন নয়, কর্মচারীদের নেতৃত্ব দানে সক্ষম, সেই মানের অফিসারদের দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি স্বাধীনভাবে কাজ করতে সুযোগ দিতে হবে।

ডেইলি স্টার: শেষ কথা কী বলবেন?

ফিরোজ মিয়া: মেরুদণ্ডওয়ালা অফিসার নিয়োগ দিন। একইসঙ্গে সেই অফিসারদের কাজে রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত হস্তক্ষেপ করবেন না। সরকারে বসলেই ভাববেন, যে অফিসার আপনার কথা শোনে, সেই শুধু ভালো, তাহলে তো প্রশাসন চলবে না। সরকারকে দেখতে হবে অফিসাররা আইন-কানুন মেনে চলছে কিনা, দুর্নীতি করছে কিনা। তবেই প্রশাসন ঠিক হতে বাধ্য।

Comments

The Daily Star  | English

Top criminal Subrata Bain held in secret Rab custody since 2022: commission

The Commission of Inquiry on Enforced Disappearances submitted the findings to the chief adviser yesterday

10m ago