আমাদের প্রিয় শিক্ষক আবদুল ওহাব

শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যেও যে এত আন্তরিক আর স্নিগ্ধ এক সম্পর্ক থাকতে পারে তা চোখে পড়ত না। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কও যে এতটা প্রাণোচ্ছল হতে পারে তা কল্পনাতেও আসত না। কিন্তু সেসব চলতি নিয়মকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
ফেনী সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন আবদুল ওহাব। ছবি: সংগৃহীত

আমরা তাকে আড়ালে ডাকতাম 'কাগু' বলে। অবশ্য তার সামনে নয়। আঞ্চলিক ভাষায় কাকার প্রতিশব্দ 'কাগু'। তবে তিনি প্রকাশ্যেই আমাদের 'কাগু' বলে ডাকতেন। হোক তা ক্লাসরুম, ক্লাসরুমের বাইরে, রাস্তা ঘাটে, কিংবা মাঠে। যেখানেই তার সঙ্গে ছাত্রদের দেখা হতো, তার প্রথম ডাকই হতো, 'কাগু কী খবর!' এই কাগুটা হয়ে গিয়েছিল তার সমার্থক। শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যেও যে এত আন্তরিক আর স্নিগ্ধ এক সম্পর্ক থাকতে পারে তা চোখে পড়ত না। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কও যে এতটা প্রাণোচ্ছল হতে পারে তা কল্পনাতেও আসত না। কিন্তু সেসব চলতি নিয়মকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

অবশ্য তিনি যে পথ দিয়ে চলতেন ওই পথ দিয়ে অন্তত স্কুলের ক্লাস চলাকালীন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কোনো ছাত্র যেত না বা সাহস করত না। এটাকে একইসঙ্গে বলা যায় শ্রদ্ধা ও ভয়ের সংমিশ্রণ। স্যারকে দেখলে একদিকে যেমন শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসত সবার, ঠিক তেমনি তাকে ভয়ও পেত ছাত্ররা। পুরো ক্লাসে তখন প্রবল হৈচৈ, হট্টগোল, এমন সময়ই তার আগমন। তিনি শ্রেণিকক্ষে ঢোকামাত্রই পুরো ঘর আশ্চর্য ঠান্ডা, পিনপতন নীরবতা।

কখনো কখনো তিনি শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করতেন মজার ছলে। প্রথমে জানালা দিয়ে হালকা ঝুঁকে উঁকি দিয়ে দেখতেন তিনি, দুষ্টুমির শিরোমণি আর নাটের গুরু কে। কখনোবা দরজার আবডালে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ হাসিতে চমকে দেয়ার মতো বলে উঠতেন, 'ও কাগুরা কী খবর!'

বিভিন্ন পরীক্ষার সময়ের কথা মনে পড়ে। পরীক্ষার হলে তিনি বাইরে গেছেন ঠিকই, কিন্তু কখনো পরক্ষণেই আবার লুকিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলতেন 'এরই কিয়াররি কাগুরা অ্যাঁই কিন্তু ব্যাঁক চাইয়ের! (এই কী করছিস কাগুরা, আমি কিন্তু সব দেখতে পাচ্ছি!)

আবদুল ওহাব ছিলেন ফেনী সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। ক্লাসে আমাদের পড়াতেন বাংলা দ্বিতীয় পত্র। বাংলা দ্বিতীয় পত্রের ক্লাসে প্রথমেই আসত বাংলা ব্যাকরণের প্রশ্ন। শ্রেণিকক্ষে ঢুকে প্রথমে হাজিরা নেয়ার পরে স্যারের প্রথম কাজ ছিল পরবর্তী ক্লাসের জন্য ছাত্রদের পড়া বুঝিয়ে দেওয়া। পড়া বুঝিয়ে দেওয়ার সময় একটিবারের জন্যও তিনি বসতেন না। বরং সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে, হাঁটতে হাঁটতে পড়া বুঝিয়ে দিতেন। যত্ন নিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে লাইন ধরে ধরে ব্যাকরণকে ক্লাসেই আত্মস্থ করার পন্থা জানিয়ে দিতেন। যেন ছাত্ররা বাড়ি গিয়ে একবার পরখ করে নিলেই হয়ে যায়। পড়ার পাশাপাশি তিনি বারবার জিজ্ঞেস করতেন, 'সবাই বুঝতে পেরেছ তো? না বুঝলে কিন্তু সরাসরি বলবে।'

যখন একজনও বাদ না থেকে সবাই বলত, বুঝেছি তবেই তিনি পড়ানো শেষ করতেন। যদি কোনো ছাত্র বলত বুঝিনি, তিনি তাকে বোঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। যতক্ষণ না ছাত্রটি পড়া বুঝে না নিতে পারে ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি বুঝিয়েই যেতেন। তাতে যদি ক্লাস শেষ হয়ে যায় তবে তাই হবে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছাত্রদের পাঠদানের বিষয়ে তার ছিল ভীষণ খেয়াল।

পড়া বুঝিয়ে দেওয়ার পালাটি ছিল তার ক্লাসের প্রথম ভাগ। তারপর শুরু হতো গত ক্লাসের পাঠদানের বিষয়। ছাত্রদের কাছ থেকে পড়া বুঝে নেওয়ার পালা। অর্থাৎ এখন তিনি আগের ক্লাসের পড়া ধরবেন। তবে তা ক্রমানুসারে নয়। শ্রেণিকক্ষে ঘুরতে ঘুরতে হুট করে। হঠাৎই তর্জনী তুলে তিনি বলবেন, 'কাগু আমনে খাড়ান'! যার মনোযোগ কিছুটা কম এবং পড়া না পারাটাই যার সহজাত নিয়ম সেই সন্দেহজনকভাব হবে তার প্রধান লক্ষ্য।

অন্যদিকে পরীক্ষার হলে তার আড়চোখে তাকানোর সন্দেহজনক দৃষ্টিতে কেউ পাশ থেকে দেখার চেষ্টাও করত না। কারণ তার দৃষ্টিতে মনে হতো তিনি ক্লাসের সবার দিকেই তিনি তাকিয়ে আছেন।

আবার সেই তিনিই ছিলেন সব ছাত্রদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক এবং নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। ফেনী পাইলট স্কুলে তার সময়ের এমন কোনো ছাত্র নেই যারা তাকে ভালো না বেসে থাকতে পেরেছেন। আমাদের স্কুলটি ছিল সরকারি, যার ফলে ছাত্রদের বেতন মাত্র ১৫ টাকা হলেও পরীক্ষার ফি অনেকটা বেশি ছিল।

একবারের ঘটনা, আমাদের এক মেধাবী সহপাঠী আর্থিক অবস্থার দরুণ পরীক্ষার ফিস দিতে পারেননি, জানতে পেরে নিজের পকেট থেকে টাকা নিয়ে পরীক্ষার ফিস দিয়ে দিয়েছিলেন আবদুল ওহাব স্যার।

এছাড়া তিনি বারবার খোঁজ নিচ্ছেন বাড়ির লোকেরা কেমন আছে, কীভাবে চলছে তাদের জীবন। স্কুলের ছুটিতে ছাত্ররা কেমন পড়াশোনা করছে সে খোঁজও তার গণ্ডির বাইরে নয়। ক্লাসে যে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র, আর যে সবচেয়ে দুর্বল ছাত্র দুয়ের মাঝে খাতিরের বেলায় প্রশ্নাতীত সৎ ছিলেন তিনি। মেধাবী শিক্ষার্থীরা অপ্রয়োজনে তার কাছে আলাদা গুরুত্ব পেত না। বিশেষ করে ক্লাসে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছাত্রের প্রতি তার ছিল আলাদা নজর, যেন সে ছাত্রটি নিজেকে গড়ে নিতে পারে এবং পাঠদানে পুরোপুরি আগ্রহী হতে পারে। অন্যদিকে যদি দেখা যেত কোনো ছাত্র পড়াশোনায় খানিকটা দুর্বল, কিন্তু সহশিক্ষা কার্যক্রম তথা বিতর্ক খেলাধুলায় বেশি পারদর্শী, তাদের স্যার বেশি পছন্দ করতেন। তবে তা তিনি সরাসরি বাইরে প্রকাশ করতেন না। ছাত্রদের কাছে তিনি যেমন ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয়, ঠিক তেমনি শিক্ষকদের কাছেও ছিলেন প্রিয় সহকর্মীর মতো, কারো কাছে তিনি ছিলেন গুরুর মতো। তার ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে হয়েছিলেন সহকর্মীও। তাদের বিষয়েও তার ছিল ভীষণ শ্রদ্ধাবোধ।

ব্যক্তি জীবনেও তিনি ছিলেন ভীষণ মজার এক মানুষ। ছাত্রদের যেমন তিনি মাতিয়ে রাখতেন, ঠিক তেমনি ভীষণ গুরুগম্ভীর পরিবেশেও পরিস্থিতি পাল্টে দেয়ার অসম্ভব প্রতিভা ছিল তার। শ্রেণিকক্ষে কখনো কৌতুক পরিবেশনের মধ্য দিয়েও গুমোট পরিবেশে ফিরিয়ে আনতেন সজীব হাওয়া।

তিনি ছিলেন ভীষণ স্বপ্নবান একজন মানুষ। ছাত্রদের নিয়ে ছিল তার ছিল অজস্র স্বপ্ন। তার ছাত্ররা কেউ ভালো করেছে কিংবা করছে এই খবর শুনলে তিনি শ্রেণিকক্ষে বলতেন এবং বাকিদেরও এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগাতেন। প্রতিমুহূর্তেই বলতেন, 'আর যাই করো পড়ার সময় পড়বে। বাকিদিন যা ইচ্ছে করো সমস্যা নেই। পড়তে বসে ফাঁকি দেবে না। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস রাখবে। ও পেরেছে, আমি কেন পারব না। মানুষের পক্ষে সব সম্ভব, কেবল চেষ্টা থাকতে চাই। চেষ্টা করো দেখবে পারবে।' ক্লাসে স্যার প্রায়ই বলতেন, 'কাগুরা তোমরা যখন এগিয়ে যাও আমার তখন প্রাণ ভরে যায়।'

কেউ হয়তো দুর্বল ছাত্র কিন্তু তার অনুপ্রেরণা আর উদ্দীপনায় নিজেকে নতুন করে খুঁজে নিত। স্যার প্রায়ই বলতেন, 'দেখো তোমাদের মধ্যে কেউ হয়তো একসময় ডাক্তার হবে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হবে কেউ বিজ্ঞানী, বা শিক্ষক কিন্তু সবার আগে ভালো মানুষ হও। মানুষের জন্য কাজ করো।' এই যে উদীপ্ত করা, স্বপ্ন দেখতে শেখানো, নিজের উপর আত্মবিশ্বাস রাখা একজন আদর্শ শিক্ষকের পরিচয় ছিল এটিই।

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যে কতোখানি মধুর হতে পারে তা তাকে দেখলে বিশ্বাস করা যেত। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক যে কেবল পাঠ্যপুস্তক আর শ্রেণিকক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না এটিও বোঝানোর চেষ্টা করতেন তিনি। তাইতো ছাত্রদের আড়ালে ডাকা নামে নিঃসঙ্কোচে তিনি মাঝে মাঝে বলে উঠতেন, 'কি কাগুরা সব খবর ভালা?'

তিনি আমাদের বারবার জিজ্ঞেস করলেও আমরা যারা তার ছাত্র ছিলাম তাদের বেশিরভাগেরই কখনো তাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, 'কাগু আপনার সব খবর ভালা?' কেমন আছেন কাগু আপনি?' আর আর তা সম্ভবও হবে না। হাজার জিজ্ঞাসা করলেও সেই উত্তরটা আর জানা হবে না। কারণ তিনি জীবন নদীর ওপারে। চির প্রশান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন।

২০১৯ সালের আজকের দিনে চিরতরে পাড়ি জমিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় শিক্ষক আবদুল ওহাব স্যার। শারীরিকভাবে হয়তো তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তিনি আজও আছেন তার আদর্শের মধ্য দিয়ে, আছেন অনুপ্রেরণায় আর স্বপ্নপথিক হয়ে। যে অনুপ্রেরণায় তার ছাত্ররা এগিয়ে যাবে, আর আমাদের প্রিয় ওহাব কাগু হয়তো ওপার থেকে বলবেন, 'কাগুরা তোমরা যখন এগিয়ে যাও, আমার তখন প্রাণ ভরে যায়।'

Comments