বন্ধ হয়ে গেল উপকূলের একমাত্র ভাসমান স্কুল

৪ বছর মেয়াদের ভাসমান স্কুল প্রকল্পটি গত ডিসেম্বরে বন্ধ হয়ে যায়। শেষদিনে স্কুলের সামনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। ছবি: সংগৃহীত

নদীতে নৌকায় বসবাস, নৌকাতেই জীবন পার। ডাঙ্গায় ঠিকানাবিহীন এ সম্প্রদায় 'মান্তা' নামে পরিচিত। যুগ যুগ ধরে এ সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ ছোট ডিঙ্গি নৌকায় করে পটুয়াখালীর সাগর উপকূলের বিভিন্ন নদ-নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। এ ঘাট থেকে ও ঘাটে নৌকায় সপরিবারে বিচরণ করে তারা। ডাঙ্গায় তাদের কোনো ঠিকানা না থাকায় নৌকায়ই কাটে জীবন।

যাযাবর এ সম্প্রদায়ের শিশুরাও তাদের মা-বাবার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই মাছ ধরার কাজে জড়িয়ে পড়ে। লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় এরা নিরক্ষরই থাকে। তবে এ সম্প্রদায়ের শিশুদের নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে ২০১৯ সালের জুনে পটুয়াখালীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ এলাকায় চালু হয় একটি ভাসমান বোট স্কুল। প্রতি বছর ৫০ জন করে শিশু প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে শিক্ষার সুযোগ পেত। কিন্তু ৪ বছর মেয়াদের ভাসমান স্কুল প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বন্ধ হয়ে গেছে। একতলা লঞ্চ আকৃতির সেই ভাসমান স্কুলটি সংস্থার জাগো নারীর তত্ত্বাবধানে বরগুনায় নিয়ে যাওয়া হয়। এতে মান্তা সম্প্রদায়ের শিশুদের আবার নিরক্ষর হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ভাসমান স্কুলের শিক্ষক আইয়ুব খান জানান, মান্তা সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছে শিক্ষা ছিল বিলাসিতা। কিন্তু ২০১৯ সালের জুন মাসে বেসরকারি সংস্থা জাগো নারীর উদ্যোগে মুসলিম চ্যারিটির অর্থায়নে মান্তা সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য ভাসমান বোট স্কুল স্থাপন করায় তাদের শিশুদের জীবনে লাগে শিক্ষার ছোঁয়া। প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার সুযোগ পেয়ে অনেক শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। ফলে তাদের জীবনে পরিবর্তনের ছোয়া লাগতে শুরু করে। দূর হতে থাকে ডাঙার মানুষের সঙ্গে বৈষম্যও।

স্কুলটিতে প্রতি বছর ৫০ জন করে শিশু প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে শিক্ষার সুযোগ পেত। ছবি: সংগৃহীত

স্কুলটি নিয়ে যাওয়ার সময় বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর তীরে এসে অঝোরে কাঁদছিল স্কুলের শিশু শিক্ষার্থী রাজিয়া, মিম, ছখিনা, সায়েম, শাহিদা, দ্বীন ইসলাম, রহমান, খুকুমণি, শেফালী, মর্জিনা, আমেনাসহ স্কুলটির কমপক্ষে অর্ধশত শিক্ষার্থী ।

অভিভাবক শেফালী বেগম জানান, আমরাতো শিক্ষার আলো পাই নাই। ভাসমান স্কুলের সুবাদে আমাদের ছেলে-মেয়েরা কিছুটা হলেও শিক্ষার আলোতে আসার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু স্কুলটি চলে যাওয়ার আমাদের সন্তারদের শিক্ষার সুযোগও হাতছাড়া হয়ে গেল।

আরেক অভিভাবক লিপি বেগম বলেন, আমাদের জীবনতো অন্ধকারেই কাটছে এখন আমাদের সন্তানদের জীবনও অন্ধকারেই থাকবে। আমরা আমাদের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ চাই।

স্কুলটির শিক্ষক আইয়ুব খান আরও বলেন, নদী ও ডাঙায় মিলিয়ে ৩০০ শিশু রয়েছে। ভাসমান স্কুলের কারণে ধীরে ধীরে তারা স্কুলগামী হচ্ছিল। কিন্তু স্কুলটি বন্ধ হওয়ায় মান্তা শিশুদের শিক্ষা জীবন অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

স্কুলটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী সংস্থা জাগোনারীর পরিচালক (যোগাযোগ) ডিউক ইবনে আমিন জানান, 'ভাসমান বোট স্কুল প্রকল্পের মেয়াদ শেষ। প্রকল্পটির মাধ্যমে শিশুদের স্কুলগামী করার অভ্যাস করা হয়েছে। তবে স্কুলটির শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা এখানে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়েছি।

'এডুকেশন ফর ইনক্লুশন অফ মান্তা কমিউনিটি (ইআইএমসি)'- নামের চার বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৭৫ ফুট লম্বা এবং ১৮ ফুট প্রশস্ত স্টিল বডির একটি ভাসমান নৌকা নির্মাণ করা হয়। প্রকল্প সমন্বয়কারী ফজলুল করিম বলেন, প্রকল্পের মোট খরচ হয়েছে ৬০ লাখ টাকা, যার মধ্যে শিক্ষকদের বেতন এবং বই, স্টেশনারি, ব্যাগ, টিফিন বক্স, ম্যাট এবং লাইফজ্যাকেটের খরচ রয়েছে।

নৌকাটিতে কম্পিউটার এবং টেলিভিশনসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল, যা সৌরশক্তি দ্বারা চালিত হয় এবং একটি অভ্যন্তরীণ জেনারেটর। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত স্কুল পরিচালনার জন্য দুজন শিক্ষক নিয়োগা করা হয়।

স্কুলের আরেক শিক্ষিকা নাজমুন্নাহার বলেন, আমরা টিফিন বক্স সরবরাহ করেছি, কিন্তু শিশুরা তাদের নিজস্ব খাবার নিয়ে আসতে পারে।

এ ব্যাপারে রাঙ্গাবালী উপজেলার ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার মো. বায়েজিদ বলেন, মান্তা সম্প্রদায়ের শিশুদের শিক্ষার জন্য চর মোন্তাজ স্লুইজগেট এলাকায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের জন্য জেলা শিক্ষা কমিটিতে দু'মাস আগে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত অনুমোদনের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পাওয়া গেলেই স্কুল স্থাপন কার্যক্রম শুরু হবে।

Comments

The Daily Star  | English
election before ramadan 2026 in Bangladesh

Election could be in February, Yunus indicates

He said it will be possible if preparations completed, sufficient progress made in reforms and judicial matters

7h ago