অ্যাকাডেমিয়ায় এআই ব্যবহার কতটা ইতিবাচক?

একটা সময় ছিল, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় অ্যাকাডেমিক কাজ করতে গিয়ে লাইব্রেরির সারি সারি বই, সিনিয়রদের কাছ থেকে নোটপত্র জোগাড়, এমনকি আর্কাইভেও ছুটতে হয়েছে। এরপর যখন যোগ হলো গবেষণাপত্র, তখন গবেষণার যাবতীয় বিষয় খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খাওয়ার দিনগুলো তো রয়েছেই।
সে সময় ইন্টারনেট থাকলেও প্রযুক্তির যে বিষয়টি প্রচলিত ছিল না, তা হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সংক্ষেপে এআই কিংবা আরও সহজে প্রচলিত 'চ্যাটজিপিটি', 'ডিপসিক', 'গুগল বার্ড'। এখনকার সময়ে ব্যক্তির ভ্রমণ পরিকল্পনা থেকে শুরু করে যে কোনো বিষয়ে জানার জন্য সহজেই রয়েছে এআই প্রযুক্তির এই ফ্রি ভার্শনগুলো।
শিক্ষকতা পেশায় আছি বলে এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার নজরে পড়ে শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক কাজগুলোতে। গবেষণার নানা অংশ তো আছেই, একটি সাধারণ টার্মপেপার থেকে শুরু করে যেকোনো কাজেই দেখা যায়, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর একই ধাঁচের উত্তর। এতে সহজেই বোঝা যায় এখানে এআইয়ের ব্যবহার কতখানি। বাক্যের গঠন, নানা যতিচিহ্নের ধরন দেখে তো বোঝা যায়ই, সবেচেয়ে বেশি টের পাওয়া যায়, শিক্ষার্থীদের নিজেদের চিন্তার গভীরতার অনুপস্থিতি দেখে।
এখন এ নিয়ে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন এবং সেটা এই অ্যাকাডেমিক জগতের অনেকেই। যোগাযোগ এবং সাংবাদিকতার মতো যে বিষয়গুলো আসলে হাতেকলমে শেখার, সে বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের অনেকেই শ্রেণিকক্ষে এআই ব্যবহারকে ইতিবাচকভাবে দেখে থাকেন। আবার অনেক শিক্ষকও মনে করেন, গবেষণার লিটেরেচার রিভিউ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধাপে প্রযুক্তির এই ইতিবাচকতা প্রয়োগ করা সুবিধাজনক। কারণ এটি যেমন একদিকে সময়সাপেক্ষ কাজকে কম সময়ে করে দেয়, তেমনি গুছিয়ে কাজ করতে সহায়তা করে। বিশেষ করে যাদের ভিন্ন কোনো ভাষায় গবেষণা লেখার দক্ষতা তেমন নেই, তাদের জন্য এটি খুব সহায়ক হতে পারে। তবে এআইয়ের ইতিবাচক ব্যবহার যেমন রয়েছে, তেমনি এর নেতিবাচক দিকগুলোও এড়িয়ে যাওয়াটা ক্ষতিকর।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়টি হলো, চ্যাটজিপিটি কিংবা ডিপসিকসহ এআইয়ের এই প্রযুক্তিগুলো শিক্ষার্থীদের চিন্তার প্রসারতাকে কমিয়ে দেয়। কারিকুলামে সব বিষয় বা কোর্স একইরকম নয়। সিনিয়র বছরগুলোতে অ্যানালিটিক্যাল কিংবা বিশ্লেষণধর্মী বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করতে হয়। এমনিতেই আমাদের বর্তমান সমাজে চিন্তার গভীরতা কিংবা জ্ঞানচর্চা, সংস্কৃতির উপাদানগুলো বেশ অপ্রতুল হয়ে পড়ছে। একটি লোকালয়ে শত রেস্তোরাঁ মিললেও পাঠাগার, সাহিত্যকেন্দ্রের সংখ্যা পাওয়া যাবে হাতে গোনা। যেখানে একটি দেশের স্বাধীন এবং বিশ্লেষণধর্মী চিন্তার সম্প্রসারণের অন্যতম নিয়ামক হলো সেখানকার সাহিত্যকেন্দ্র এবং পাঠাগারের সংখ্যা।
মনোবিজ্ঞানীরা প্রায়ই বলেন, বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজের সহজলভ্যতা আমাদের মাঝে এক ধরনের 'জ্ঞান আহরণ' নয় বরঞ্চ 'জ্ঞান সংগ্রহকারী' হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে কোনো একটি বিষয়ে নানা তথ্য, উপাত্ত বা ভিন্ন মতামত জেনে চিন্তা করার সেই প্রয়াসটা এখন আমাদের মধ্যে আর নেই। নিজেই খেয়াল করি, আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বই পড়ার যে ধৈর্য এবং ইচ্ছা ছিল, এখন আর সেটা নেই। সহজেই গুগলে সার্চ করার অপশনে চলে যাই। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনায় আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই দেখা দেবে সৃজনশীলতার সংকট।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেয় ঠিকই, কিন্তু এর অনেক তথ্যই ভুল। বিশেষ করে বাংলা এআইয়ের অনুপস্থিতি এর আরেকটি অন্যতম কারণ। শিক্ষার্থীরা যদি নিয়মিত এই উপায়ে তাদের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম করতে থাকেন, তাহলে তাদের মধ্যে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তার সৃজনশীলতা গড়ে ওঠার সুযোগ একটা সময় অনেক কমে যাবে। নিজেই যখন শিক্ষার্থীদের গবেষণাকাজ মূল্যায়ন করি, প্রায়ই চিন্তাহীন একই ঘরানার উত্তর পড়ে যেতে হয়, যেখানে একেকজন শিক্ষার্থীর ভিন্ন চিন্তার প্রতিফলন খুব কমই।
আসলে যুগের পরিবর্তনে নিত্য-নতুন প্রযুক্তি বাস্তবতা। এর ভালো-মন্দ আসলে নির্ভর করছে ব্যবহারকারীর ওপর। যদি শিক্ষার্থী নিজে ভাবতে শেখেন, কোনো একটি বিষয়ে চিন্তার গভীরতার পাশাপাশি প্রশ্ন করতে শেখেন সেক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বরঞ্চ ইতিবাচক। প্রযুক্তি আমাদের যত উন্নত জীবনব্যবস্থাই দিক না কেন, মানুষের চিন্তা করার প্রয়োজন সবসময়েই থাকবে। কারণ মানব চিন্তা আবেগ, মূল্যবোধ এবং অভিজ্ঞতা নির্ভর। একজন শিক্ষার্থী যখন কোনো বিষয়ে ভাবনা রাখতে শেখেন, তখন তিনি তার শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে নিজ সংস্কৃতি, শ্রেণিকক্ষে শেখা মূল্যবোধ, এমনকি নানা আবেগের মিশেলে একটি নির্দিষ্ট ধারণা দাঁড় করান,যা আসলে একটি যন্ত্রের পক্ষে সেভাবে সম্ভব নয়। আর নৈতিকতার বিষয়টিও এখানে বেশ প্রাসঙ্গিক। যদিও আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে কিংবা অ্যাকাডেমিক এই বিষয়গুলোতে এআইয়ের ব্যবহার নিয়ে সেভাবে তেমন কোনো নীতিমালা নেই।
উন্নত দেশগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বেশ এগিয়ে গেলেও কিছু ক্ষেত্রে এখনো মানব চিন্তার প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে যায়নি। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন আমার অ্যাডভাইজর বারবার বলছিলেন, আমার গবেষণা একেবারেই আমার 'ব্রেইন চাইল্ড'। এতে একান্তই আমার চিন্তার প্রতিফলন থাকতে হবে। তবে শুধু ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে একেবারে শেষে আমি চাইলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার নিতে পারব। তাও এর জন্য আমাকে রিসার্চ সেন্টারের অধীনে দুইবার প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। চ্যাটজিপিটির ব্যবহার কোথায় এবং নির্দিষ্ট করে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সবকিছুই সেখানে স্পষ্ট নীতিমালা দিয়ে বলা আছে। এর লঙ্ঘন হলেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একজন শিক্ষার্থীর ফান্ডিংসহ সবকিছুই বাতিল করার এখতিয়ার রাখে। তবে আমাদের দেশে এখনো এরকম স্পষ্ট কোনো নীতিমালা প্রচলিত নেই। যেহেতু এআইয়ের ইতিবাচক দিকও রয়েছে, তাই শ্রেণিকক্ষগুলোতে স্পষ্টভাবে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।
Comments