যুক্তরাষ্ট্রে ১২ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া সাজিদের টিপস

বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখেন অনেকেই, আর সেই স্বপ্নের গন্তব্যে শীর্ষে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এই স্বপ্ন পূরণের পথ বেশ কঠিন। সেই কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সাজিদ শাহরিয়ার। সাজিদ বেছে নিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলি।
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন সাজিদ। উচ্চতর শিক্ষার জন্য তার পছন্দের বিষয় ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং। এর জন্য তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া (বার্কলি ও আরভিন), কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি, জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন এবং ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার মতো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন।
সাজিদের মুখ থেকেই শোনা যাক তার এই সাফল্যের পেছনের গল্প।
স্বপ্নের শুরু যেভাবে
সাজিদের যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার স্বপ্নের শুরুটা বেশ মজার। তিনি বলেন, 'আমি যখন ক্লাস টু-থ্রিতে পড়ি, তখন শাহরুখ খানের 'কাল হো না হো' সিনেমাটি দেখেছিলাম। সিনেমার নায়ককে ব্রুকলিন ব্রিজের সামনে আইকনিক পোজে দাঁড়াতে দেখে আমারও ইচ্ছে হয়, একদিন আমিও ওই ব্রিজের সামনে গিয়ে দাঁড়াব। এছাড়া, পরিবারে একজন যুক্তরাষ্ট্রফেরত আত্মীয়ের পড়াশোনা নিয়ে খোটা শুনতে হতো। সেই জেদটাও মনে ছিল। আবার দেশের সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রতিও এক ধরনের অনাগ্রহ কাজ করত। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছাটা জোরালো হয়।
সাফল্যের পেছনের গল্প: সিনেমা হলো স্বপ্নসারথি
সাজিদ বরাবরই প্রথম সারির শিক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু কলেজে ভর্তি পরীক্ষার পর তার রোল নম্বর ৩৬ হয়ে গেলে তিনি উপলব্ধি করেন, জানার আরও অনেক কিছু বাকি। কলেজের পড়াশোনার চাপে ছোটবেলার শখ—গান, আবৃত্তি, আঁকাআঁকি—সব ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। পড়াশোনা বা শখ, কোনোটিই ঠিকমতো হচ্ছিল না।
তিনি বলেন, আমাদের একটি ভুল ধারণা আছে যে, অন্য সবকিছু বাদ দিলেই বুঝি পড়াশোনা ভালো হয়। আসলে তা নয়। যে পারে, সে সবই পারে।
ধীরে ধীরে তার একদল বন্ধু তৈরি হয়, যারা তার মতোই সৃজনশীল কিছু করতে আগ্রহী ছিল। প্রথমে কয়েকটি ভিডিও বানালেও পরে বুঝতে পারেন, এগুলো দিয়ে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করা কঠিন। এরপর মাথায় আসে শর্টফিল্ম বানানোর চিন্তা। তার বানানো বেশ কিছু শর্টফিল্ম বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃতও হয়। তবে সাজিদ এখানেই থেমে থাকতে চাননি। তিনি ২ ঘণ্টা ১০ মিনিটের একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু চলচ্চিত্র বানানোর জন্য প্রযোজক পাওয়া ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ। সাজিদ বলেন, প্রযোজনার জন্য যার কাছেই গিয়েছি, তিনিই বলেছেন, যারা পড়াশোনায় ভালো, তারা এসব সিনেমা বানায় না। এসব করতে হলে পড়াশোনা ছাড়তে হবে।
সাজিদ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রথম। তিনি কাউকে বোঝাতে পারেননি যে, তিনি কেবল আগ্রহের বশে এবং পড়াশোনা ঠিক রেখেই সিনেমাটি বানাতে চান। শেষ পর্যন্ত তিনি একসঙ্গে ছয়টি টিউশনি করে টাকা জমান, যন্ত্রপাতি কেনেন এবং চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সিনেমাটি নির্মাণ করেন। তার ভাষায়, 'সিনেমাটি হয়তো খুব ভালো কিছু হয়নি, কিন্তু নিজের ইচ্ছা পূরণ করতে পেরেছি, তাতেই আমি খুশি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনে এই সিনেমাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল। সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে এটিই ছিল একাই একশো।'
ভর্তি আবেদনে যা গুরুত্বপূর্ণ: সহশিক্ষা কার্যক্রম
বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সহশিক্ষা কার্যক্রম বা ইসিএ খুব জরুরি। সাজিদের মতে, ইসিএ এমন হওয়া উচিত যা আবেদনকারীর নিজস্ব গল্প তুলে ধরে এবং তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। তিনি বলেন, 'ইসিএ মানে শুধু কোনো ক্লাবে যোগ দিয়ে সভাপতি হয়ে যাওয়া নয়। এই ভুল ধারণার জন্যই আমরা অনেকে সুযোগ পাই না। আমার বানানো সিনেমাটিই আমার আবেদনের মূল শক্তি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমার ইউটিউব চ্যানেল ঘেঁটে সিনেমাটি দেখেছে এবং আমার পরিশ্রম ও একাগ্রতা যাচাই করেছে।'
যাদের কোনো ইসিএ নেই, তাদের জন্য অফার লেটার পাওয়া বেশ কঠিন। তবে পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা বেশি প্রাধান্য পায়।
আবেদন প্রক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়ার জন্য ভালো সিজিপিএ থাকা জরুরি। এটি এমন একটি দরজা, যা অন্য সম্ভাবনাগুলোর পথ খুলে দেয়। শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সিজিপিএ ৩.৭০ বা এর বেশি থাকা ভালো।
এসওপি (স্টেটমেন্ট অব পারপাস): এখানে নিজের জীবনবৃত্তান্তের তথ্যগুলো না দিয়ে একটি গল্প দিয়ে শুরু করতে হবে। কেন আপনি নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়তে চান, তা নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।
রেকমেন্ডেশন লেটার: অনেক সময় শিক্ষকেরা ব্যস্ততার কারণে এটি লিখে দিতে পারেন না। সেক্ষেত্রে তাদের অনুমতি নিয়ে একটি খসড়া তৈরি করে দেওয়া যেতে পারে, যেখানে পড়াশোনা বা গবেষণার অভিজ্ঞতাগুলো উল্লেখ থাকবে।
ইংরেজি ভাষার দক্ষতা
সাজিদের মতে, আইইএলটিএসে ভালো স্কোর থাকাই যথেষ্ট নয়। ইংরেজি একটি চর্চার বিষয়। এর জন্য প্রচুর ইংরেজি সিনেমা দেখা, খেলার ধারাবিবরণী শোনা বা ইংরেজি বই পড়া যেতে পারে। তিনি বলেন, 'আমার মতে, হ্যারি পটার সিরিজের বই বা সিনেমা দিয়ে শুরু করলে ইংরেজি শেখাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। মূল লক্ষ্য হলো ইংরেজিতে চিন্তা করার অভ্যাস তৈরি করা, যাতে কথা বলার সময় বাংলা থেকে অনুবাদ করতে না হয়।'
প্রস্তুতি কখন থেকে শুরু করবেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষ থেকেই নিজের আগ্রহের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা উচিত। চতুর্থ বর্ষে গবেষণায় আগ্রহী এমন একজন শিক্ষকের অধীনে থিসিস করাটা জরুরি। সম্ভব হলে থিসিস পেপারটি কোনো জার্নালে প্রকাশ করতে পারলে আবেদনে তা বাড়তি সুবিধা দেবে। স্নাতক শেষে পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো চাকরিতে যোগ দিলে ভালো হয়। লিংকডইন প্রোফাইল সব সময় আপডেট রাখতে হবে এবং নিজের সব একাডেমিক ও সহশিক্ষা কার্যক্রমের সনদপত্র গুছিয়ে রাখতে হবে।
ভিসা সাক্ষাৎকার
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। সাজিদের মতে, এবছর ভিসা সাক্ষাৎকারে অনেকের আবেদনই বাতিল হয়েছে। ভিসা কর্মকর্তা মূলত কয়েকটি বিষয় যাচাই করেন:
পড়াশোনার খরচ কোথা থেকে আসবে, তার সুস্পষ্ট প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। এই প্রশ্নের সাবলীল জবাব দিতে না পারলে ভিসা আবেদন বাতিল হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। এর বাইরে, শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পেলে ভিসা পাওয়া সহজ হয়। সেই সঙ্গে, পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসার পরিকল্পনা স্পষ্ট করে বলতে হবে। তা না হলে ভিসা আবেদন বাতিলের আশঙ্কা থাকে।
Comments