এ কোন ধরনের মানসিকতা?

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত মঙ্গলবার জানিয়েছেন, র‍্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে তিনি ভারতের সহায়তা চেয়েছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালনকারী র‍্যাবের বিরুদ্ধে গত ডিসেম্বরে আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তদবির করতে আমরা ভারতের সহায়তা চেয়েছি। তিনি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্কের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। র‌্যাবের কার্যক্রম নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত মঙ্গলবার জানিয়েছেন, র‍্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে তিনি ভারতের সহায়তা চেয়েছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালনকারী র‍্যাবের বিরুদ্ধে গত ডিসেম্বরে আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তদবির করতে আমরা ভারতের সহায়তা চেয়েছি। তিনি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্কের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। র‌্যাবের কার্যক্রম নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উচ্চতা ও আন্তরিকতাকে স্বাগত জানাই এবং আমাদের প্রতিবেশীর সঙ্গে বিভিন্ন দিক দিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়গুলোর প্রশংসা করি। একই সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের আগমনকেও স্বাগতম জানাই। এসব ঘটনা নিঃসন্দেহে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের সমর্থন ও সহযোগিতার নির্দেশক।

তবে আমরা এই বিষয়টিকে অত্যন্ত অবমাননাকর বলে মনে করি, কারণ র‍্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য অন্য একটি দেশের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। জাতীয় স্বার্থ জড়িত আছে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের বন্ধুর কাছে সহায়তা চাওয়া শুধু ভালো নয় বরং প্রত্যাশিত একটি কাজ। তবে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব ব্যবহার করে র‍্যাবের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের চেষ্টা করা আমাদের জন্য অমর্যাদার বিষয়। বিশেষ করে এই নিষেধাজ্ঞাটি যখন শুধু ৭ জন সাবেক ও বর্তমান র‍্যাব কর্মকর্তার ভিসা বাতিল ও আর্থিক লেনদেন বিষয়ে। এ ধরনের কাজের জন্য আমাদের প্রতিবেশী দেশের সহায়তা চাওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকা উচিৎ নয়। বস্তুত, আমরা মনে করি এটা আমাদের 'ভালো প্রতিবেশীসুলভ' সম্পর্কের অপব্যবহার।

এ অবমাননাকর গল্পের এখানেই শেষ নয়। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উচ্ছ্বসিত হয়ে জানিয়েছেন, তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকদের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং তারা এই বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের পক্ষে তদবির করতে রাজি হয়েছেন। 'ভারতের ৪৫ লাখ হিন্দু সেখানে খুবই প্রভাবশালী এবং তারা প্রসঙ্গটি মার্কিন প্রশাসনের কাছে উত্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।' (এখানে কেন তাকে কারও ধর্মীয় পরিচয়ের কথা উল্লেখ করতে হলো, তা আমার বোধগম্য নয়। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয়-আমেরিকানদের একটি বড় অংশ শিখ। কেন তিনি ভারতের প্রবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মুসলমানদের উপস্থিতির বিষয়টিকে অবজ্ঞা করলেন?) অর্থাৎ, তিনি রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে সরাসরি তদবির করেছেন। আমরা তার এই উদ্যোগকে পদমর্যাদার খর্ব হিসেবে বিবেচনা করি এবং এতে এই মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে— যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা এতটাই দুর্বল যে, অন্যদের সাহায্য ছাড়া নিজেরা কিছুই করতে পারি না।

আমরা স্বীকার করি, যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয়দের অবস্থান আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তারপরও, তার কী উচিৎ ছিল না প্রথমে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে সহযোগিতা চাওয়া? সেটাই কী বেশি সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ হতো না? আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের মানুষের কাছে তদবির না করে বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে, সে দেশটি যত বন্ধুত্বপূর্ণই হোক না কেন, এ ঘটনা আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের ক্ষমতা ও মর্যাদা বেড়েছে এবং একইসঙ্গে বেড়েছে তদবির ও প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে এবং অন্যান্য ভূমিকায় তিনি নিজেও সে দেশে অনেক বছর থেকেছেন। সুতরাং অন্য যে কারো চেয়ে তার এ বিষয়টি আরও ভালো করে জানা থাকার কথা।

সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে, আমরা মেনে নিতে রাজি নই যে, এই বিধিনিষেধের বিষয়টি তদবিরের মাধ্যমে সমাধানের গণ্ডি পেরিয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো, কীভাবে আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কাজ করে, আমাদের নিজস্ব আইনের প্রতি তারা কতটুকু শ্রদ্ধাশীল, একজন নাগরিকের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলোর প্রতি তারা কতটুকু শ্রদ্ধাশীল। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সঙ্গে এবং সার্বিকভাবে দেশের নাগরিকদের সঙ্গে তাদের আচরণের নীতিমালা কেমন। এখানে সংশ্লিষ্ট সংস্থার পরিচালনা প্রক্রিয়া ও সাধারণ কর্মকাণ্ড বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোনো এক বিচিত্র কারণে আমরা এ ব্যাপারটা ধরতেই পারছি না।

মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ র‍্যাবের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ম্যাগনেটস্কি আইনের আওতায় আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপ করে। এই বিধিনিষেধের ফলে র‍্যাব সদস্যরা 'যুক্তরাষ্ট্রে কোনো সম্পত্তির মালিক হতে পারবেন না এবং যুক্তরাষ্ট্রে থাকা কোনো ব্যক্তির সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করতে পারবেন না'। তবে শুধু ৭ জন সাবেক ও বর্তমান র‍্যাব সদস্যের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকারের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।

অর্থাৎ আমরা ভারতের সঙ্গে আমাদের মূল্যবান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ৭ কর্মকর্তার মার্কিন ভিসা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার এবং র‍্যাব সদস্যদের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে সহায়তা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করছি। এ কাজের জন্য আমরা একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ভারতীয় অভিবাসীদের কাছেও আবেদন জানিয়েছি, যেন আমাদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তদবির করে। আজ র‍্যাব, আগামীকাল যদি পুলিশ ও বিজিবির কার্যক্রমের ওপর একই ধরনের প্রশ্ন আসে, তাহলে কী সে বিষয়গুলোর সমাধান না করে আমরা ভিন্ন একটি দেশের কাছে সাহায্যের জন্য ছুটবো? এভাবেই কি আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির চর্চা করি?

আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভ্যন্তরীণ শাসন পদ্ধতির বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা রয়েছে। হয়তো আছে, তবে সেগুলো কী কাজ করছে? পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু বন্ধ হয়নি। গুমের বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী? কিছুদিন গুম থাকার পর যারা ফিরে আসেন, কেন তারা তাদের 'অন্তর্ধানের' সময়কালে কোথায় ছিলেন, তাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হয়েছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, কারা তাদের অবরুদ্ধ রেখেছিলেন, সেসব বিষয়ে কখনোই কিছু বলেন না? তারা সবাই কী শুধু ওই সময়টুকুর স্মৃতিভ্রংশে ভুগেছেন? নাকি সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তারা মনে করতে চান না? নাকি এখানে অন্য কোনো প্রভাব রয়েছে?

আমাদের জন্য আরও বড় একটি বিপদ অপেক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত লেইহি আইনের আওতায়। যেসব সংস্থার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে, বিশেষ করে যে সংস্থাগুলো পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র বিভাগকে প্রশাসনিক সহযোগিতা দেয়; এই আইনের আওতায় তাদেরকে কোনো ধরনের সহায়তা দেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারে গত ১৬ জানুয়ারি জায়মা ইসলামের একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আইনটি এ মুহূর্তে আমাদের সম্মতির অপেক্ষায় রয়েছে। আমরা যদি সেটি মেনে নিতে রাজি হই, তাহলে নিরাপত্তা সংস্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা প্রতিটি ডলারের বিপরীতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যদি এই আইনে সম্মতি না দেই, তাহলে সহায়তার পরিমাণ কমে শূন্যের কোঠায় পৌঁছে যাবে এবং সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে কিছু প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও।

আমরা কেন এরকম একটি ভয়-ভীতিকর অবস্থায় থাকবো?— যেখানে একটি বিদেশি শক্তি যাচাই বাছাই করে আমাদের কিছু সংস্থার কার্যক্রমে গুরুতর ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজে বের করবে। আমরা কেন অন্যদের চাপিয়ে দেওয়া অবমানাকর আইন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ভ্রান্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সংস্কারে মনোনিবেশ না করে অন্যের দ্বারে দ্বারে সাহায্যের আশায় ঘুরছি। যেটা করার জন্য ব্যাপক দাবিও রয়েছে এবং কাজটি করতে পারলে জনগণের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, আমরা মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে হাঁটবো, তখন তার এই আবেগের সঙ্গে আমরাও একাত্ম হই। এতে আমাদের হৃদয় গর্বে ভরে ওঠে। যখন অন্য কোনো দেশ আমাদের বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরোপ করে, তখন আমাদের এই গর্বের ওপর আঘাত আসে। যখন আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিবেদনে এমন কিছু তথ্য উঠে আসে— যা প্রকাশ করতে আমরা নিজেরা ভয় পাই; তখন আমাদের সেই গর্বের ভাব চুপসে যায়। আমরা লজ্জায় মাথা নত করে ফেলি; যখন আমরা এমন কিছু সত্যের বিষয়ে জানতে পারি— যেগুলো ক্ষমতাসীনরা দ্ব্যর্থহীনভাবে অস্বীকার করে এবং এর জন্য অন্যদের দায়ী করে।

অন্যদের কাছে তদবির বা অনুনয় করে ইতিবাচক সুপারিশ বা প্রশংসা আদায় এ ধরনের 'অসত্যের' জগৎ থেকে ‍মুক্তি লাভের উপায় নয়। এখান থেকে বের হয়ে আসার উপায় হচ্ছে, প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ সংস্কার, যার ওপর আমরা ভরসা রাখতে পারি। আমরা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। এখন আমাদের নৈতিকতার দিক দিয়ে শক্তিশালী হতে হবে। আসুন এ বিষয়টিকে আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার আয়োজনের অংশ করে নিই।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments