নির্বাচন কি আগের মতোই, নাকি উত্তরণ

আমাদের পরবর্তী নির্বাচন দুই বছরের আগে হচ্ছে না; অর্থাৎ ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ। অনেক দেশেই এত আগে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয় না। তবে, আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অনেক আলোচনা হবে—সেগুলোর বেশিরভাগই হবে একমুখী, যেহেতু আমরা একসঙ্গে বসে একে অপরের অবস্থান বিবেচনা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মতো কোনো সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি।

আমাদের পরবর্তী নির্বাচন দুই বছরের আগে হচ্ছে না; অর্থাৎ ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ। অনেক দেশেই এত আগে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয় না। তবে, আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অনেক আলোচনা হবে—সেগুলোর বেশিরভাগই হবে একমুখী, যেহেতু আমরা একসঙ্গে বসে একে অপরের অবস্থান বিবেচনা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মতো কোনো সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি।

এমন কিছু সংলাপ হবে, যেখানে কেউ কারও কথা শুনবে না এবং এক পক্ষ অন্য পক্ষকে আক্রমণ করবে এবং নীতিহীন, ঘৃণ্য ও হীন বলে অভিযুক্ত করবে। আমরা খুব কম সময়ই প্রতিপক্ষের কথা শুনব বা শোনার বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করব। এভাবেই মূল্যবান সময় অতিবাহিত হবে, কোনো কিছুর সমাধান হবে না এবং অসহিষ্ণুতা বাড়তে থাকবে। ফলে, নির্বাচন আরও বেশি মাত্রায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।  

পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে আবারও বিতর্কের সূচনা হয়েছে। বর্তমান ইসির মেয়াদ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে শেষ হতে যাচ্ছে। সবাই একটি নিরপেক্ষ ইসি চায়, যা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বশর্ত। সরকার বারবার আমাদেরকে আশ্বস্ত করছে যে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হবে। এরকম হতে হলে আমাদের ইসি গঠনের জন্য একটি জবাবদিহিতামূলক, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রক্রিয়া প্রয়োজন। এই বিষয়েই আজ বিতর্ক হচ্ছে—কীভাবে এমন একটি ইসি গঠন করা যায়, যেটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে? কী সেই জাদুকরী প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একদল মুক্তমনা, সাহসী ও নির্ভীক মানুষ ব্যক্তি, যাদের রয়েছে মানুষের কাছে অগাধ বিশ্বাসযোগ্যতা—সেই ওয়েস্টার্ন সিনেমার বীর যোদ্ধার মতো 'ম্যাগনিফিসেন্ট ফাইভ' বা সেরা পাঁচ জনকে খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা আমাদেরকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারবেন?  

এই অতি গুরুত্বপূর্ণ কমিশন গঠনের জন্য সংবিধানে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেওয়া আছে। যদিও ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময়ও এই আইন অনুসরণ করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে আমাদের ভাগ্য সামরিক একনায়কতন্ত্রের হাতে চলে যায়। এসব একনায়ক কিংবা আংশিক একনায়কদের শাসনামলে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে কথা বলার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে আমাদের প্রকৃত সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৯১ সালে জেনারেল এরশাদের পতনের পর। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ৬টি নির্বাচন হয়েছে কিন্তু ১৯৭২ সালে দেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত নির্বাচন কমিশন গঠনের আইনের বাস্তবায়ন সোনার হরিণের মতো আমাদের নাগালের বাইরেই থেকে গেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের সরকার একাধিকবার ক্ষমতায় এসেও এই আইন বাস্তবায়নে কেন অনীহা দেখিয়েছে বর্তমান ও সাবেক নির্বাচন কমিশন কীভাবে কাজ করেছে, তা দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। 

জেনারেল এরশাদের পতনের পর সব রাজনৈতিক শক্তি একমত পোষণ করে—কোনো একনায়ক বা দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না এবং এ কারণে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের অধীনে একটি 'অন্তর্বর্তীকালীন' সরকার গঠন করা হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচন বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে তাল মেলাতে পারলেও এর ফলাফল পরাজিত দল মেনে নেয়নি এবং 'সূক্ষ্ম কারচুপির' অভিযোগ করে। 

১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ এই উপসংহারে পৌঁছায়—খালেদা জিয়া সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সুতরাং, তারা একটি 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের' দাবি জানায় এবং শেষ পর্যন্ত এই দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়। নতুন ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একমাত্র দায়িত্ব থাকে নির্বাচিত দলের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর নতুন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এই ব্যবস্থায় ৪টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যার মধ্যে সবশেষটি ছিল ২০০৮ সালে, একটি সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বিতর্কিত এই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে।  

আওয়ামী লীগ ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তীব্র আন্দোলন করে, কিন্তু তারা ২০১১ সালে এই প্রক্রিয়া বাতিল করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কোনো ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে জেতেনি, এই তথ্য থেকে সম্ভবত তারা শিক্ষা নিয়েছে। এর আগে দাঁতে দাঁত চেপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রতিবাদ করলেও এখন বিএনপি সেই একই ব্যবস্থাকে আবারও চালু করতে চাইছে এবং তারা বিশ্বাসও করে না যে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। 

এক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, আবর্তন সম্পূর্ণ হয়েছে। দলের অধীনে নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরীক্ষামূলক ব্যবহার এরপর আবারও দলের অধীনে নির্বাচন। দ্বিতীয় বিকল্পটি বিলুপ্ত হওয়ায় সবার নজর স্বভাবতই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের ওপর পড়েছে, যার বিশ্বাসযোগ্যতা আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর একই ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রতিবেশী দেশগুলোতে আমাদের মতো ইসি গঠন নিয়ে বিবাদ হয় না। ভারতে বিভিন্ন পর্যায়ে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বেশ কয়েক মাস ধরে চলে। একবারের জন্যেও ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। এমন কী বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যকার ভয়াবহ দ্বন্দ্ব এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মমতা ব্যানার্জির মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিবাদ থাকার পরও তাদের ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি। বাংলাদেশের জন্মের ৫০ বছর পরে এবং ৩০ বছর ধরে গণতন্ত্র উপভোগ করার পরেও আমরা কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি, তার অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে এটিও একটি। 

চলমান বিতর্কের বিষয় হচ্ছে, কীভাবে জনমানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, বিদায়ী নির্বাচন কমিশন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায়, তারা তাদের দায়িত্ব পুরোপুরি আইনি ও করণিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন। এক্ষেত্রে তারা একটি বিষয় অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন, তা হলো—আইনের আক্ষরিক অর্থ এবং তার আদর্শিক সত্ত্বার মধ্যকার আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এটি 'অন্ধের হাতি দেখার' সঙ্গে তুলনীয় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে; মূল সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে আনুষঙ্গিক বিষয়ের প্রতি বেশি সময় দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা একটি মর্মান্তিক ঘটনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখানোর প্রবণতায় ডাক্তারের 'রোগী মৃত্যুবরণ করলেও অপারেশন সফল হয়েছে' প্রবাদের কথা মনে করতে পারি। আমাদের নির্বাচনগুলো 'সফল' হলেও, কার্যত গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে অথবা সেটি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে। করোনাকালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে তাকে হাই-ফ্লো অক্সিজেন যন্ত্রের মাধ্যমে মুমূর্ষু অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। 

একটিমাত্র তথ্য ভোটারদের হতাশার চিত্রকে সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে পারে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা ভোটে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের নিজ নিজ আসনে তারাই ছিলেন একমাত্র প্রার্থী। ৩০০ সদস্যের সংসদে এই 'বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত' সদস্যরা (এমপি) সিংহভাগ আসন দখল করেছিলেন। তাদের হাতে নতুন সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট আসন ছিল এবং তারা সকলেই 'নির্বাচিত' হয়েছিলেন বিনা ভোটে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনের জন্য সর্বমোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ৯ দশমিক ১৯ কোটি। যে ১৪৭টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়েছিল, সেখানে ভোটারের সংখ্যা ছিল ৪ দশমিক ৩১ কোটি। অর্থাৎ, মোট ৪ দশমিক ৮৮ কোটি ভোটার ১৫৩টি আসনে ভোট দিতেই পারেননি, কারণ সেখানে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়নি। এই বিষয়টি কি ইসিকে একটুও বিচলিত করেনি, যে দেশের ৫৩ শতাংশ ভোটার নির্বাচনে ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ পাননি? 

উপরের প্রক্রিয়াটি সব দিক দিয়ে আইন মেনে হয়েছে। কিন্তু এটি কি নৈতিক? এর মাধ্যমে কি আমাদের গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে? নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি কী আমাদের বিশ্বাস বেড়েছে? 'জনমানুষের মতামতের গুরুত্ব রয়েছে', এই বিশ্বাস কী অটুট থেকেছে? ইসির একমাত্র ভূমিকা কি নির্বাচনের লজিস্টিক নিশ্চিত করা, আর সেটি নৈতিক হচ্ছে কী না সে বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরব থাকা? বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের গায়ে ইসির স্বীকৃতি থাকতে পারে, কিন্তু তারা কি ভোটারদের সমর্থন থেকে আসা 'বৈধতার' স্বীকৃতি পেয়েছেন? এই বিষয়গুলো কী ইসি সদস্যদের মনে একবারও আসেনি? নির্বাচন যে শুধু লজিস্টিক নিশ্চিত করার বিষয় না। এটি যে নৈতিকতা ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার অনুশীলন, সে বিষয়টি সম্ভবত তাদের চিন্তাধারায় কখনোই স্থান পায়নি। 

'যারা ভোট দেন, তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। যারা ভোট গণনা করেন, তারাই সকল সিদ্ধান্ত নেন'; এই পর্যবেক্ষণ, যা অনেক বছর আগের, আমাদের দেশসহ অসংখ্য দেশের বর্তমান নির্বাচনী বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়। গত কয়েক বছরে, নির্বাচনের ভোট গণনার প্রক্রিয়াটি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অভ্যন্তরে ক্ষমতাসীন দলের জন্য একটি বিশেষ সুবিধা তৈরি করা আছে, যা কোনোভাবে সরানো সম্ভব না। কীভাবে ভোটাররা ভোট দিয়েছে, সেটার পরিবর্তে কীভাবে ভোট গণনা করা হয়েছে, সেটাই এখন ভোটদানের ফলাফল নির্ণয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যা আমাদের নির্বাচনগুলোকে কিছু সুনির্দিষ্ট সংস্থা, যেমন পুলিশ, আমলাতন্ত্র ইত্যাদির বিশ্বস্ততা প্রমাণের অনুশীলনে রূপান্তরিত করেছে। 

এ পর্যন্ত সরকারের অবস্থান হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে 'কখনোই ফিরে যাওয়া যাবে না' এবং আগের 'সার্চ কমিটি' প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন ইসি গঠিত হবে। আমরা যদি সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে বর্তমান ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়ার কথা মনে করি, সেসময় রাষ্ট্রপতি সকল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন, যেখানে আপিল বিভাগের একজন বিচারক, হাইকোর্টের বিচারক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ছিলেন। এ ধরনের কমিটি গঠনে আপনি কোনো ত্রুটি খুঁজে পাবেন না। তাদের ১০ জন প্রার্থী নির্বাচন করার জন্য ১০ কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদের জন্য ২ জন এবং বাকি ৮ জনকে ৪টি ইসি সদস্যপদের জন্য নির্বাচন করতে বলা হয়। সার্চ কমিটি বিভিন্ন মহলের মানুষের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে এবং তাদের সুপারিশ করা প্রার্থীর তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেয়। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন ও এর প্রধানের নাম ঘোষণা করেন। 

এ পর্যন্ত সবই ঠিক আছে। তবে, আমাদের সংবিধানের ৪৮(৩) ধারায় বলা হয়েছে, 'এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্টপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।' অর্থাৎ, ৪৮(৩) ধারা অনুযায়ী, নতুন ইসি গঠনের সময় প্রতিটি ধাপে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। সার্চ কমিটি গঠনের সময়, সার্চ কমিটির সুপারিশ গ্রহণের সময় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, নতুন ইসি গঠন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার সময় সংবিধান অনুযায়ী, আমাদের রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। প্রতিটি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করার ব্যাপারটি ভিন্ন, তবে নতুন ইসি গঠনের ক্ষেত্রে তার পরামর্শ গ্রহণ করা ইসির নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতার প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু জটিল কিন্তু অগ্রাহ্য করা যায় না এরকম প্রশ্নের উদ্রেক করে। কারণ এই ইসির আওতায় পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নিজে এবং তার দলও অংশগ্রহণ করবে। গত দুটি ইসির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে বলা যায়, এই প্রশ্নগুলো এখন প্রত্যেক ভোটারের মনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবে না, নির্বাচন হচ্ছে দেশ গড়ার গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন। যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো উপকরণ থেকে থাকে, তাহলে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় নির্বাচন হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী উপকরণ। আমরা ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নীত হয়ে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হব। এ কারণে, এই উন্নীতকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০২৩ সালে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানকে লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা দরকার। আমরা উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে যত উপরে উঠব, আমাদেরকে গণতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়েও ততটুকু উপরে উঠতে হবে এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান না করে সেটা সম্ভব নয়। 

আমরা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, যদি নির্বাচনকে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ হতে দেওয়া হয়, তাহলে সেটি প্রকৃতপক্ষে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করতে পারে, যেটি ভোটারদের নিজের হাতে, তাদের পছন্দ অনুসারে, আশা ও প্রত্যাশার উজ্জ্বল কালিতে লেখা।  

 

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

 

Comments

The Daily Star  | English
books on Bangladesh Liberation War

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

14h ago