বাকি ১৬ কোটির কী হবে?
হলিউডের খ্যাতিমান অভিনেতা নিকোলাস কেজের 'লর্ড অব ওয়ার' সিনেমার প্রথম দৃশ্যে একটি অস্ত্র কারখানা পেছনে রেখে নায়কের সংলাপ: 'পৃথিবীতে প্রতি ১২ জনের জন্য একটি আগ্নেয়াস্ত্র। প্রশ্ন হলো, বাকি ১১ জনের কী হবে?'
সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমরা একটু বাজার দর নিয়ে কথা বলি।
৪ মার্চ শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ি রাজধানীর গ্রিন রোড এলাকার একটি সরকারি ভবনের ভেতরে অবস্থিত মসজিদে। নামাজের পরে মোনাজাতে ইমাম নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালে আনতে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য কামনা করেন।
কোনো অঞ্চলে একটানা দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হলে বৃষ্টির জন্য শুধু মুসলমানরাই নন, অন্য ধর্মের মানুষও বিশেষ প্রার্থনা করে। এরকম দুর্যোগ-দুর্বিপাকে স্রষ্টার সাহায্য প্রার্থনা আদিকাল থেকেই মানুষেরা করে আসছে। কিন্তু যখন একটি সরকারি ভবনের ভেতরে নির্মিত মসজিদের ইমামও নিত্যপণ্যের দাম কমানোর জন্য স্রষ্টার সাহায্য কামনা করেন, তখন এটা বুঝতে বাকি থাকে না, পরিস্থিতি কত খারাপ!
কতটা খারাপ?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও। কেন উধাও? উৎপাদন ও সরবরাহ নেই? নাকি ইউক্রেনে রাশিয়ায় আক্রমণের ফলে সয়াবিন সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে? ব্যবসায়ীদের কথাবার্তা শুনলে সেরকমই মনে হয়।
শনিবার বিডিনিউজের একটি সংবাদ শিরোনাম: 'সংকটের মধ্যে বোতল খুলে বেশি দামে সয়াবিন তেল বিক্রি।' খবরে বলা হয়, দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে সরকারের সায় না পাওয়ার তিন দিনের মাথায় বাজারে সয়াবিন তেলের পর্যাপ্ত চাহিদায় টান পড়েছে; মিলছে না খোলা সয়াবিন তেলও। সংকটের সুযোগে বাড়ানো হয়েছে দাম। আর বাড়তি মুনাফার জন্য বোতলজাত তেল খুলে বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। রাজধানীর কিছু বড় দোকান এবং সুপার শপ ঘুরে পাঁচ লিটারের তেলের বোতল দেখা গেছে খুবই অল্প। ছোট বাজার কিংবা অলিগলির দোকানে সেটাও নেই। ক্রেতাদের বরাত দিয়ে খবরে বলা হয়, খুচরা বাজারসহ অলিগলির একাধিক দোকান ঘুরেও তেল পাওয়া যাচ্ছে না। অনেককে তেল ছাড়া অন্যান্য বাজার-সদাই নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। কোম্পানি ও ডিলাররা বাজারে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে তেলের 'কৃত্রিম সংকট' তৈরি করেছে বলে অভিযোগ খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতাদের।
যদিও ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। ২০২১ সালে ২৭ লাখ ৭১ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। সে হিসাবে তেলের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ রয়েছে। বাজিণ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও জানিয়েছেন, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ রয়েছে। চাহিদার তুলনায় বেশি মজুদ থাকার পরও দাম কেন বাড়ছে? তার মানে ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে সেখানে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কোথায়? কয়জন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
বাংলা ট্রিবিউনের খবরে বলা হচ্ছে, বৃহস্পতিবার সয়াবিন তেল মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা এবং সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করার অপরাধে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী 'মায়ের দোয়া স্টোর'কে এক লাখ টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
প্রশ্ন উঠতে পারে সয়াবিন তেল না খেলে কী হয়? একটা গল্প প্রচলিত আছে এরকম যে, ব্রিটিশ আমলে একজন ইংরেজকে বলা হলো, বাংলাদেশের মানুষের অবস্থা এমন যে, তারা তিন বেলা ভাতও খেতে পারে না। তখন ওই ইংরেজ বলেন, 'ভাত খেতে পারে না তো কী হয়েছে? পোলাউ খাবে…!'
আবার আমাদের দেশে রোজার মাসে বেগুনের দাম বেড়ে গেলে বেগুনি না খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। চালের দাম বেড়ে গেলে বলা হয়: 'বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান।' পেঁয়াজের দাম বাড়লে বলা হয়, পেঁয়াজ না খেলে কী হয় এবং পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার নানা রেসিপিও তখন সামনে আসে। যখন চিনির দাম বাড়ে, বলা হয় চিনি না খাওয়াই ভালো। শীতকালে ভরা মৌসুমেও সবজির দাম আকাশছোঁয়া হলে আশার বাণী শোনানো হয় যে, ফসলের দাম বেশি হলে প্রান্তিক কৃষকেরই লাভ। এইভাবে যেকোনো পণ্যের দাম বাড়লেই তার বিকল্প পরামর্শ দেওয়া এবং সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যতটা দাম বেড়েছে, দেশে সে তুলনায় কম। উপরন্তু, দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তিনগুণ বেড়েছে ইত্যাদি। সম্প্রতি একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বললেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো অসন্তোষ নেই। এ জাতীয় কথাবার্তা মন্ত্রীদের জনবিচ্ছিন্নতা এবং অসহায়ত্ব ঢাকারই প্রয়াস। কথা হচ্ছে, একটির দাম বাড়লে অন্যটি খাওয়া কিংবা নির্দিষ্ট সেই পণ্যটি না খাওয়ার পরামর্শও আপেক্ষিক। কারণ যখন একে একে সবকিছুর দাম বাড়ে তখন মানুষ কী খাবে? চালের দাম বাড়লে আলু খাবে। কিন্তু আলুর দাম বাড়লে কী হাওয়া খাবে? সয়াবিন তেলের দাম বাড়লে কি সরিষার তেল খাবে? সেটির দাম আরও বেশি। নাকি তেল ছাড়া রান্না হবে? সেই পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যারা পরামর্শ দেন, তারাও জানেন, পরামর্শ দেওয়ার চেয়ে নিজের জীবনে ওই পরামর্শ প্রয়োগ করা কঠিন।
শুধু মন্ত্রী বা নীতিনির্ধারকরাই নন। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে যখন সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ, তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিও লিখছেন যে, বড় বড় শপিংমলের ফ্যাশন হাউজ, দামি রেস্টুরেন্ট ও মোবাইল ফোনের দোকানে মানুষের ভিড় দেখে বোঝার উপায় নেই যে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে জনজীবনে কোনো প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া রাজধানীর মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউজ, রেঞ্জ রোভারের মতো বিলাসবহুল গাড়ির লাইন দেখেও অনেকে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আনন্দিত হন। কিন্তু প্রশ্নটা নিকোলাস কেজের মতো যে, বাকি ১১ জনের কী হবে?
অর্থাৎ ১৭ কোটি লোকের দেশে এক কোটি লোকও যদি 'অসাধারণ' হয়, তাহলে স্মার্টফোন, দামি রেস্টুরেন্ট ও বিলাসদ্রব্যের দোকানে ভিড় কমবে না। সয়াবিন তেলের লিটার ৫০০ টাকা কিংবা চালের কেজি ২০০ টাকা হলেও তাদের অসুবিধা নেই। কথা হচ্ছে বাকি ১৬ কোটিকে নিয়ে—যারা অসাধারণ নন।
মুশকিল হলো, নীতিনির্ধারকরা আবার এই এক কোটি 'অসাধারণের' ক্রয়ক্ষমতা এবং রাস্তায় দামি গাড়ির লম্বা লাইন দেখে প্রবৃদ্ধির গল্প শোনান। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। প্রশ্ন হলো, আয় বেড়েছে কার মাথাপিছু আর নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে মাথা নিচু হলো কতজনের? এক কোটি মানুষের আয়, ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাপনের বিলাসিতা দিয়ে বাকি ১৭ কোটিকে বিচার করা যৌক্তিক কি না—সে প্রশ্ন তোলাই থাকল।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
Comments