সন্তানের খুনি হয়ে ওঠার দায় কি পিতা এড়াতে পারেন?

ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার আশুলিয়ায় হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আশরাফুল আহসান জিতুর বাবাকে গ্রেপ্তারের সমালোচনা করছেন অনেকে। বলছেন, সন্তানের অপরাধের দায় পিতাকে বহন করতে হবে কেন?
আসলেই কি সন্তানের অপরাধের দায় পিতার ওপরে বর্তায় না? তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, একজন কিশোর, একজন তরুণ কোন প্রক্রিয়ায়, কাদের ছত্রছায়ায় অপরাধী হয়ে ওঠে এবং কিশোর গ্যাং গড়ে তুলে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে? রাজনৈতিক প্রশ্রয় ছাড়া কি কারো পক্ষে অপরাধ করে পার পাওয়া সম্ভব?
শিক্ষক উৎপল কুমার হত্যা মামলার এজাহারে আসামি জিতুর যে বয়স উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি নিয়েও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। কেননা ওই শিক্ষার্থীর জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্ডে দেওয়া তথ্য বলছে, তার জন্ম ২০০৩ সালের ১৭ জানুয়ারি। সেই হিসেবে এখন তার বয়স ১৯ বছর। স্কুলে ভর্তির আগে তিনি উত্তরার তানজিমুল উম্মা আলিম মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিলেন। (প্রথম আলো ৩০ জুন ২০২২)
প্রশ্ন হলো, মামলার এজাহারে বয়স ১৬ বছর লেখা হলো কেন? বয়স কি মামলার বাদী উল্লেখ করেছেন, নাকি এখানে পুলিশকে প্রভাবিত করা হয়েছে? কারণ ১৮ বছরের কম বয়স হলে তার জামিন পাওয়া সহজ এবং অপরাধীকে কিশোর হিসেবে বিবেচনা করে লঘু শাস্তি দেওয়া কিংবা কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানোর বিধান রয়েছে। সুতরাং তার বয়স কমিয়ে লেখার পেছনে কী কারণ আছে, সেটিরও নির্মোহ অনুসন্ধান প্রয়োজন।
আবার আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে গণ্য করা হলেও বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় এত বছর পর্যন্ত শিশু হিসেবে গণ্য করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত কি না—সেই প্রশ্নও আছে। সেইসঙ্গে পিতৃতুল্য শিক্ষকের মাথায় স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করার মতো কৌশল ও বোধ-বুদ্ধি যার আছে, তাকে শিশু হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ আছে কি না—সেটিও ভাবা দরকার।
প্রশ্ন হলো, সন্তান বখে যাওয়ার দায় কার? সন্তানকে মোটরসাইকেল কিনে দিয়ে মাস্তানি করার সুযোগ দিয়েছেন কে? সন্তান যে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে, সেই কথা বাবা খেয়াল করেননি কেন? তার কাছে যখন সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তিনি কি সেগুলো আমলে নিয়ে সন্তানকে শাসন করেছেন? সন্তান যে ভেতরে ভেতরে খুনি হয়ে উঠছে, সেটা বাবা কি খেয়াল করেননি? খুনি হওয়ার শিক্ষাটা সে কোথায় পেলো? সেখানে পরিবারের কোনো দায় নেই? বাবা-মা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছেন?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, শিক্ষক উৎপল কুমারকে হত্যার পরে অভিযুক্ত জিতুকে পুলিশে না দিয়ে পালাতে সহায়তা করেছেন তার বাবা। এই তথ্য যদি সত্যি হয়, তাহলে অপরাধীকে পালাতে সহায়তা করার অপরাধে তার বাবাও অপরাধী। অতএব তাকে আটক এবং এরপরে গ্রেপ্তার দেখানো বেআইনি নয়। তাছাড়া তদন্তের স্বার্থে পুলিশ চাইলে যেকোনো মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে যে কাউকে আটক করতে পারে এবং এরপর তাকে গ্রেপ্তার দেখাতে পারে। আইন তাদের সেই ক্ষমতা দিয়েছে।
সুতরাং শিক্ষক উৎপল কুমারকে পিটিয়ে হত্যাকারী শিক্ষার্থীর বাবাকে গ্রেপ্তার আপাতদৃষ্টিতে বেআইনি বা অনৈতিক মনে হলেও তাকে যে যুক্তিতে বা কারণে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, সেটা সমর্থনযোগ্য। কারণ সন্তানের বখে যাওয়ার দায় বাবা-মা এড়াতে পারেন না। তার কী শাস্তি হবে, সেটা আইন বলবে। কিন্তু অভিভাবকদের সতর্ক করতে এই গ্রেপ্তারটি প্রয়োজন ছিল।
সাভারের একজন শিক্ষক ফেসবুকে লিখেছেন, আমি কখনো কখনো আমার শিক্ষার্থীদের অভিভাবককে কলেজে ডাকি। কোনো অভিযোগ জানালে অনেক অভিভাবক বলেন, 'স্যার কী করবো বলেন, ছেলে তো আমার কোনো কথাই শোনে না।' এই যদি অভিভাবকের দশা হয়, তাহলে অভিভাবকদের নিজেদের কাছেই নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে যে সন্তান কেন তার কথা শোনে না। পক্ষান্তরে সন্তান যে অভিভাবকের কথা শোনে না, তার দায় কি শিক্ষকও এড়াতে পারেন? কারণ গুরুজনে করো নতি—বা এ রকম নীতিকথা তো তাকে স্কুলেই শেখানোর কথা। সেই শেখানোর প্রক্রিয়ায় কোনো ভেজাল আছে কি না? শিক্ষক তার দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করছেন কি না বা করতে পারছেন কি না—সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
জিতুর ফেসবুক আইডির প্রোফাইলে নামের সঙ্গে 'দাদা' লেখা। স্থানীয় কিশোরেরা তাকে 'দাদা' বলে ডাকে। ১৯ বছরের একজন তরুণ যখন অন্যদের কাছে 'দাদা' হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন, তার মানে ঘটনাটি একদিনে ঘটেনি। একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি 'দাদা' হয়ে উঠেছেন এবং তার এই 'দাদা' হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াই তাকে খুনি বানিয়েছে।
তিনি যে 'দাদা' হয়ে উঠলেন, সেটা তার বাবা-মা বা পরিবারের অন্য সদস্যরা কি খেয়াল করেননি? নাকি তারা বিষয়টা এনজয় করেছেন? নাকি তাদের সন্তানকে এলাকার মানুষ সমীহ করে, সে ভবিষ্যতে বড় রাজনীতিবিদ হবে, এমপি-মন্ত্রী হবে ইত্যাদি ভেবে পুলকিত হয়েছেন? এ কারণে কি তারা জিতুর নানাবিধ অপরাধের খবর পেলেও চেপে গেছেন? স্থানীয়দের বরাতে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, জিতুর পরিবার এলাকায় বেশ প্রভাবশালী। তার স্বজনেরা ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছেন। আগেও একাধিকবার তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ উঠলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
সাভারের এই ঘটনার আগে নড়াইলে যে শিক্ষককে প্রকাশ্যে জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানো হলো, সেখানেও পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। প্রশাসনের সামনে একজন শিক্ষককে জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানোর সাহস কারা পায়? রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছাড়া কারো পক্ষে এটা সম্ভব?
সুতরাং সাভারে যে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করা হলো, সেখানেও রাজনৈতিক প্রভাব আছে কি না—তা খতিয়ে দেখা দরকার। যে তরুণ তার শিক্ষককে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছেন, তার ও তার পরিবারের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে খোঁজ নিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা না থাকলে একজন ১৯ বছরের তরুণ তার শিক্ষককে স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত সাহস পান না। রাজনৈতিক ক্ষমতাই কেবল এই বয়সী একজন তরুণকে এতটা বেপরোয়া করে তুলতে পারে।
সুতরাং যেসব কারণে এবং যে প্রক্রিয়ায় একজন সাধারণ কিশোর বা তরুণ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যান এবং কিশোর গ্যাং তৈরি হয়, নির্মোহ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, সেখানে মূল ভূমিকা পালন করে এই রাজনীতি। এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক বড় ভাইরা তাদের ছোট ভাইদের দিয়ে নানান ফরমাশ খাটান এবং তাদেরকে ধীরে ধীরে ক্ষমতার বলয়ে নিয়ে আসেন। সেই ক্ষমতা চর্চার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে মোটরসাইকেল—যা কিশোরদের কিনে দিতে বাধ্য হন তাদের অভিভাবকরাই।
অর্থাৎ রাজনৈতিক বড় ভাইদের ইচ্ছের প্রতিফলর ঘটনাতে গিয়ে সাধারণ পরিবারের সন্তানরা তাদের বাবা-মাকে চাপ দিয়ে মোটরসাইকেল কেনে, সেটা নিয়ে তাফালিং করে, এক সময় গিয়ে কিশোর গ্যাং গড়ে তোলে। যারা ছোটখাট অপরাধ দিয়ে হাতেখড়ি দেয় এবং একটা পর্যায়ে গিয়ে খুনের মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে।
অতএব শিক্ষককে হত্যাকারী তরুণ ও তার বাবাকে গ্রেপ্তারই যথেষ্ট নয়, বরং যাদের ছত্রছায়ায় এই তরুণ খুনি হয়ে উঠলেন, তাদের সবাইকে ধরা দরকার। যদি তিনি সত্যিই কোনো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠে থাকেন, তাহলে তার বা তাদের রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক না কেন, তাদের ধরা উচিত দেশের বৃহত্তর স্বার্থে।
এখন প্রশ্ন হলো, যারা ধরবেন বা ধরতে বলবেন, সেই নীতিনির্ধারকরা আসলে চান কি না যে, এইসব অপরাধ বন্ধ হোক। কারণ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে তাদেরকেও অপরাধী লালন-পালন করতে হয়। নানা পদ্ধতিতে অপরাধী গড়ে তুলতে হয়। তারই একটি ধাপ হচ্ছে কিশোর অপরাধ বা কিশোর গ্যাং।
সুতরাং, এইসব গ্যাং কালচার ও অপরাধ বন্ধ হবে কি না—সেটি নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপরে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে শিশু-কিশোরদের অপরাধে জড়িত হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করা যাবে না। শুধু বাবা-মা সতর্ক থাকলেও সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক পরিবেশের কারণেও অনেক সময় শিশু-কিশোর-তরুণরা অপরাধে ঝুঁকে পড়ে। সুতরাং, সন্তানের গতিবিধির ওপর নজর রাখার বিষয়ে বাবা-মায়ের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি সামগ্রিক বিচারে রাষ্ট্রও এইসব ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments