সিলেট-সুনামগঞ্জ কি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন?

যুদ্ধেও মানুষ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। ঝুঁকি নিয়ে এক স্থান থেকে সন্তর্পণে অন্যত্র নিরাপদে চলে যায়। কিন্তু সিলেট, সুনামগঞ্জের বর্তমান প্রলয়ংকারী বন্যা-পরিস্থিতি যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ নেই। জরুরি সেবা নেই। ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ দুই দিন ধরে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন। লাখ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন, বিপন্ন। গ্রাম-গঞ্জে কোথাও এক খণ্ড শুকনা জায়গা নেই। কেউ মারা গেলে ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া কবর দেওয়ার উপায় নেই। শবদাহ করার কোনো সুযোগ নেই।
টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বন্যায় তলিয়ে গেছে সিলেট বিভাগের বেশিরভাগ এলাকা। সুনামগঞ্জের মল্লিকপুর ঘাট থেকে ছবিটি শনিবার বিকেলে তোলা। ছবি: রাজিব খান

যুদ্ধেও মানুষ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। ঝুঁকি নিয়ে এক স্থান থেকে সন্তর্পণে অন্যত্র নিরাপদে চলে যায়। কিন্তু সিলেট, সুনামগঞ্জের বর্তমান প্রলয়ংকারী বন্যা-পরিস্থিতি যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ নেই। জরুরি সেবা নেই। ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ দুই দিন ধরে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন। লাখ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন, বিপন্ন। গ্রাম-গঞ্জে কোথাও এক খণ্ড শুকনা জায়গা নেই। কেউ মারা গেলে ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া কবর দেওয়ার উপায় নেই। শবদাহ করার কোনো সুযোগ নেই।

প্রবল পাহাড়ি ঢল আর অবিরাম বৃষ্টিপাতে আজ শনিবার সকাল থেকে সিলেট শহরের সাবস্টেশন প্লাবিত হওয়ার সিলেট শহরেও বিদ্যুৎ নেই। শহরের যেসব জায়গা কোনোদিন প্লাবিত হবার কথা কেউ কল্পনাও করেনি সেসব এলাকায় বাসা-বাড়িতে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে।

১২২ বছরের ইতিহাসে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। গত ৩ দিনে ২৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। একদিনে সর্বোচ্চ ৯৭২ মিলিমিটার। অথচ এই বৃষ্টি ও ভয়াল বন্যা নিয়ে আমাদের আবহাওয়া বিভাগের কোনো পূর্বাভাস ও তৎপরতা নেই। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি নেই। মনে হচ্ছে স্যাটেলাইট যুগে নয়, আমরা আদিম যুগে বাস করছি।

সুনামগঞ্জ জেলা দুই দিন ধরে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কেউ জানে না সেখানে কী ঘটছে। মানুষ, পশু, পাখি কেমন আছে। সবার বাড়ি-ঘর প্লাবিত হওয়ায় খাবার-দাবার রান্না করার কোনো সুযোগ নেই। টিউবওয়েল সব ডুবে আছে। বিশুদ্ধ পানি নেই। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছে তাদের অবস্থা আরও করুণ। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষ ও পশু গাদাগাদি করে মানবেতর অবস্থায় আছে। ঘুমানো দূরে থাক, বসার অবস্থা নেই। খাবার-দাবার নেই। বিশুদ্ধ পানি নেই। পয়নিষ্কাশন বা স্যানিটেশন বলতে কিছু নেই। রীতিমতো মানবিক বিপর্যয় চলছে। অনেক এলাকায় লোকজন বেঁচে আছে, নাকি বানের জলে ভেসে গেছে সে খবরও জানা যাচ্ছে না।

যেসব এলাকার অবস্থা খুব করুণ সেখানে কোনো উদ্ধার বা ত্রাণ তৎপরতার কোনো খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ উচিত ছিল সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তায় স্পিড বোট, ট্রলার, নৌকা, হেলিকপ্টার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য যেসব নাম্বার দেওয়া হয়েছে এসব একটা নাম্বারেও কল রিচ করে না। আর যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন মানুষ ফোনই-বা দেবে কি করে? ওই এলাকায় তো নেটওয়ার্কই নেই!

সারাদেশ প্লাবিত হয়নি। কেবল দুটি জেলা। সরকারের উচিত ছিল সর্বাত্মকভাবে উদ্ধার, সাহায্য ও ত্রাণ তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়া। কিন্তু এই উদাসীনতা ও কালক্ষেপণ ক্ষমাহীন। আমরা যারা একটু দূরে নিরাপদে আছি তারাই শুধু চিৎকার করে চলেছি। গণমাধ্যমেও ফলাও করে এই ভয়ানক পরিস্থিতি তুলে ধরা হচ্ছে না। স্থানীয় সাংবাদিকরাও খবর পাঠাতে পারছেন না। কিন্তু সরকারের সক্ষমতা তো অনেক। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের এত অর্জন কী আজ প্রশ্নের মুখোমুখি নয়? সিলেট-সুনামগঞ্জ কি বাংলাদেশের বাইরে? ইতিহাসে এক সময় আসামের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এখনও কি রাষ্ট্র তাই মনে করছে? তা না হলে এই বিমাতাসুলভ আচরণ কেন? এই বিস্ময়কর নীরবতা কেন? বানের জলে মানুষের লাশের মিছিল দেখলে তবে কি বিবেক জাগবে?

লেখক: কবি ও গবেষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments