স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মকে ১৯৭১-এর চেতনায় উজ্জীবিত করতে হবে

বর্বরতম গণহত্যার ধ্বংসাবশেষ থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হওয়ায়, কাউকে যেন দেশের মাটিতে তার ধর্মের কারণে বঞ্চনার শিকার হতে না হয়—এটি ছিল প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার গণতন্ত্র ও সাম্যের প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি আরও একটি সংকল্প। 

বর্বরতম গণহত্যার ধ্বংসাবশেষ থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হওয়ায়, কাউকে যেন দেশের মাটিতে তার ধর্মের কারণে বঞ্চনার শিকার হতে না হয়— এটি ছিল প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার গণতন্ত্র ও সাম্যের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের পাশাপাশি আরও একটি সংকল্প।

হাজারও মুক্তিযোদ্ধার মতো পরিষ্কারভাবে মনে আছে, পাকিস্তান কখনো সংখ্যালঘু তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায়নি। নাগরিক হিসাবে তাদের সম্মান করেনি। পাকিস্তান রাষ্ট্রে তারা নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছে। মুক্তিবাহিনীতে আমাদের সঙ্গে অসংখ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী সতীর্থ ছিলেন। তাদের ত্যাগ, দেশপ্রেম, মুক্তি সংগ্রাম ও বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা আমাদের কারও চেয়ে কোনো দিক দিয়ে কম ছিল না। পাকিস্তান তাদের সঙ্গে যে আচরণ করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা তার অবসান ঘটাব, আমাদের সংকল্পও তো এমনই ছিল।

সম্ভবত আমরা সেই অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হয়েছি। দেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে, মাত্র অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে ১৩টি জেলায় সাম্প্রদায়িকতার কুৎসিত রূপের উত্থান খুবই দুঃখের এবং লজ্জার। এই ঘটনাগুলো এটাই প্রকাশ করছে যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম, বিশেষ করে তরুণদের হৃদয় ও মননে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি। 

বাংলাদেশ গঠনের সময় ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং এটি আমাদের মুক্তি সংগ্রামের গভীরে প্রোথিত একটি বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা ওপর একটি বড় আকারের আক্রমণ আসে। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে সংবিধানে বিভিন্ন ধরনের সংশোধনী এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে এরকম সাংবিধানিক ধারাগুলোকে ধীরে ধীরে গুরুত্বহীন করে দেওয়া হয়। 

গণজাগরণের মাধ্যমে সামরিক ও আধা-সামরিক স্বৈরতন্ত্রের হটিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত লেগে যায়। কিন্তু ইতোমধ্যে আমাদের সংবিধানের অনেক বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেছে। 

আমরা একটি শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলাম। যেটি দেশের ইতিহাসে ছিল একটি গৌরবময় মুহূর্ত। তবে, এটাও বলা উচিৎ, জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং তার উত্তরসূরি জেনারেল এরশাদ যে সংশোধনীগুলো এনেছিলেন, সেগুলো আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা সত্ত্বেও পরবর্তী নির্বাচিত সরকারগুলো সংবিধানের এই দিকগুলোতে নজর দেয়নি। জাতি গঠনের অন্যতম প্রাথমিক ভিত্তি থেকে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে সরে যাওয়ার এই দুঃখজনক গল্প একটা বিষয়কেই প্রকাশ করছে, যেটা হচ্ছে 'প্রগতিশীলতার পথে কয়েক ধাপ আগানো এবং মধ্যযুগীয় অন্ধকারের দিকে বেশ কয়েক পা পেছন হটা।' অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল যেন একটি পা সামনে আগাচ্ছে এবং অন্যটি পেছনের দিকে, আর এই দোটানার মধ্যে থেকে ক্রমশ সারা শরীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। 

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, রক্তাক্ত সংঘাতের পরিবর্তে গণআন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘটনা প্রকৃতপক্ষে আমাদের জন্য বাংলাদেশকে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদলে ফিরিয়ে আনার দ্বিতীয় সুযোগের মতো ছিল। তবে, তা হয়নি। কারণ রাষ্ট্রপতি এরশাদের পতনের পরই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান দুই মিত্র আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে তিক্ততা ও শত্রুতা তৈরি হয়। বিষয়টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইউরোপ থেকে ফ্যাসিবাদ বিদায় নেওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার ভিন্ন পথ অবলম্বনের সঙ্গে তুলনীয়। হিটলারকে পরাজিত করা মিত্ররা একে অপরের সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয় এবং সে যুগের সবচেয়ে কুচক্রী এবং স্বৈরাচারী সরকারগুলোর সঙ্গে তারা মিত্রতা তৈরি করে শুধু একটি শর্তে, যা হলো 'তোমার শত্রু আমারও শত্রু।' আমাদের ক্ষেত্রে, পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনে দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে ক্ষমতা ধরে রাখা অথবা আবারও বেশি জেতার প্রতিযোগিতা চলতে থাকে, যেটি ক্রমশ সব ধরনের আদর্শ, নীতি, নৈতিকতাহীন হয়ে পড়ে। ভবিষ্যৎ পরিণতিকে অবজ্ঞা করে তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির রাজনীতিই হয়ে দাঁড়ায় আমাদের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের সব কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রক। ফলে, উভয় দল এমন সব শক্তির সহায়তা পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে, যারা বাংলাদেশের জন্মের বিরোধী ছিল এবং যারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক মতবাদের প্রচার করে থাকে। 

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তথাকথিত 'ইসলামিক ভোট' পাওয়ার প্রতিযোগিতার কারণে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মাঝের বিভাজনরেখাগুলো ম্লান হয়ে যায়। নীতিহীন ক্ষমতার লড়াইয়ের সূত্রপাত হয় এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হয়। যে পথ তৈরি হয়েছিল আরও আগে, সামরিক শাসনামলে। ফলে, ধর্মনিরপেক্ষতা মুখ থুবড়ে পরে, কারণ এই ধারণাটি বিএনপি আদর্শগত দিক দিয়ে মেনে নেয়নি এবং আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন জানালেও বাস্তবে ভিন্ন পথে হেঁটেছে। অর্থাৎ এক দরজা দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল এবং অন্য দরজা দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে স্বাগতম জানানো হয়েছিল। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির মৈত্রী এবং আওয়ামী লীগের হেফাজত-ই-ইসলামের সঙ্গে বোঝাপড়া ও তাদেরকে ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিষয়টিকে সবচেয়ে পরিষ্কার ও সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করেছে। 

আজকের মৌলবাদ ও অসহিষ্ণুতার উত্থানের পেছনে অগণতান্ত্রিক ও ভিন্নমত দমনের রাজনীতিই সরাসরি দায়ী, যে রাজনীতি ক্ষমতাসীন দলের বিরোধিতাকারী সব ব্যক্তি ও সংগঠনকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। এই প্রবণতা ধারাবাহিকভাবে সরকারকে তার সব মিত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করছে এবং ক্রমশ আমলাতন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও পেশী শক্তির ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। উল্লেখ্য, এদের কারও গণতান্ত্রিক আদর্শ কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তার প্রতি সামান্যতম অঙ্গীকার নেই এবং তা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের সব জায়গার ক্ষেত্রেই সত্য। ফলে, আমরা গণতন্ত্রের সংস্কৃতি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি এবং আমাদের শব্দকোষে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণামূলক বাক্য এবং বিকল্প চিন্তাধারা অনুপ্রবেশ করেছে। 

আণুবীক্ষণিক প্রাণ হাইড্রার যেমন একটি মাথা কাটলে আরও একাধিক মাথা গজায়, ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটেছে। তবে, এটি আমাদের কোনো সাম্প্রতিক ব্যর্থতার ফলাফলই নয়। এই ব্যর্থতাগুলো বহু বছর ধরেই ধারণ করছি এবং জেনেশুনেই এতদিন আমরা এগুলোকে পাশ কাটিয়ে এসেছি। কারণ আমরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুত শক্তিগুলোর মুখোমুখি হতে ভয় পেয়েছি। অথবা এমনও হতে পারে যে, ক্ষমতা ও বিত্তের রাজনীতি আমাদের এতটাই অন্ধ করে দিয়েছে যে, আমরা এই বিষয়টিকে গুরুত্বই দিচ্ছি না। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল এটুকু বোঝেনি যে, তারা যে গাছের ওপর বসে আছে, সে গাছটিই তারা কাটছে। 

আজকের দিনের সবচেয়ে বড় সংকট, বাংলাদেশের সব গৌরবময় অর্জন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করে ১৯৭১ সালকে নতুনভাবে উপলদ্ধি করতে হবে। আমরা মুক্তির সংগ্রামকে 'মুক্তিযুদ্ধ' অথবা 'স্বাধীনতা যুদ্ধ' বলতে বেশি পছন্দ করি। এর পেছনে অবশ্যই একটি কারণ আছে। (বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ইতিহাসখ্যাত ভাষণের কথা মনে করুন, যেখানে তিনি বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।' তিনি 'মুক্তি' ও 'স্বাধীনতা' শব্দ দুটি একত্রে ব্যবহার করেছিলেন)। 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা এ ব্যাপারটিতে জোর দিতে চাই। যে ১৯৭১ আমাদের জন্য শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও আরও অনেক বেশি কিছু ছিল। আমরা আমাদের সমাজের একটি মৌলিক সংস্কারের জন্য সংগ্রাম করেছি, যা একাধারে সব ধরনের পশ্চাদপদতা, ঘৃণা, অক্ষমতা ও সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে মুক্তি দেবে এবং অন্যদিকে সব ধরনের দারিদ্র্য ও বৈষম্য থেকে মুক্তি দেবে। যদি আমরা 'মুক্তিযুদ্ধের' ধারণার সঙ্গে 'সোনার বাংলার' ধারণাকে সম্পৃক্ত করতে পারি, তাহলেই ১৯৭১-এর প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারব। 

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সলিমুল্লাহ খান ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের পেছনে অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে যথাক্রমে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও তরুণদের কর্মসংস্থানের অভাব, কার্যকর সুশীল সমাজের অনুপস্থিতি এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও সাংস্কৃতিক শূন্যতাকে চিহ্নিত করেছেন। উল্লিখিত প্রতিটি বিষয়ই প্রাসঙ্গিক এবং আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিৎ এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব সহকারে এবং জরুরিভিত্তিতে বিবেচনায় নেওয়া।  

আমরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে পেরেছি, কিন্তু এই উন্নয়ন এসেছে অনেক বড় মূল্যের বিনিময়ে। আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়েছি এবং ধনী-গরীবের ব্যবধানকে অনেক বেশি বাড়তে দিয়েছি। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যতই অর্থবহ হোক না কেন, এতে দেশের নাগরিকদের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়েনি বরং বৃহত্তর পর্যায়ে নিজেদের মধ্যে অসংগতি বেড়েছে। যার কিছুটা আমরা টের পাই ভিন্ন ধর্মের মানুষের ওপর আক্রমণের ঘটনায়। এই বিষয়টি কারও দৃষ্টি এড়ানো উচিৎ নয় যে, যারা হিন্দু মন্দির ও মণ্ডপে আক্রমণ চালাচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। 

অপরদিকে, সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়ে গর্ব করে বলার মতো তেমন কিছু নেই। ইংরেজিতে সিভিল সোসাইটি শব্দটিকে বাংলায় 'সুশীল সমাজ' বলা হয়। কিছুসংখ্যক পক্ষপাতদুষ্ট বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় 'সুশীল' শব্দটি উপহাস, প্রহসন ও প্রায় ঘৃণার কাছাকাছি একটি শব্দে পরিণত হয়েছে। ব্যাপারটা এরকম দাঁড়িয়েছে কাউকে 'সুশীল সমাজের' সদস্য হিসেবে আখ্যায়িত করা মানে তাকে অপমান করার সমতুল্য।  

সামাজিক বিচ্ছিন্নতার বিষয়টিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য। আমরা সম্ভবত সামাজিক সমস্যাগুলোকে নিজেদের কাঁধে নিয়ে সেগুলো সমাধানের উদ্যোগ নিতে আর ইচ্ছুক নই। তবে, এক্ষেত্রে দুটি ঘটনাকে আলাদা রাখতে হবে, যেখানে জনগণের অবাধ অংশগ্রহণকে সহিংসতার সঙ্গে দমন করা হয়েছে। একটি হচ্ছে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং অন্যটি হচ্ছে কোটা আন্দোলন। এক্ষেত্রে পরিষ্কার বার্তা হচ্ছে, সামাজিক সমস্যার প্রতিবাদে জনগণের অংশগ্রহণ সহ্য করা হবে না। ফলে, অন্য আরও অনেক কিছুর পাশাপাশি অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম যে নাগরিক বিচ্ছিন্নতার কথা বলেছেন, সেটাও তৈরি হয়েছে। 

সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের অভাবের বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে এবং বিস্তৃত পরিসরে চিন্তা করতে হবে এবং বুঝতে হবে এখানে কী ঘটেছে। পাকিস্তানের আধিপত্য ও তাদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অন্যতম অস্ত্র ছিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, গ্রাম পর্যায়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রায় উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি। এক্ষেত্রে আমরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত অনুষ্ঠানের কথা বলছি না, বরং যে অনুষ্ঠানগুলো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আয়োজিত হতো, সেসব সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের অনুপস্থিতি আমাদের তরুণ সমাজকে তাদের ঐতিহ্য, নিজস্বতা ও গর্বের বিষয়গুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করছে এবং ফলে তৈরি হওয়া শূন্যস্থান পূর্ণ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অশুভ শক্তির প্রভাব দিয়ে। 

আমরা আজ যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি, তা মোকাবিলা করতে হলে জনমানুষের ভেতরে আরও সংহতি প্রয়োজন, বিশেষ করে রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন, তরুণ, সুশীল সমাজ, এনজিও, গণমাধ্যম এবং সকল বিশ্বাস ও মতাদর্শের মানুষের মধ্যে। সারা দেশ জুড়ে একটি গণসচেতনতামূলক প্রচার চালানো দরকার। যেখানে বিস্তৃত পরিসরে জানানো হবে, কেন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল এবং কী কারণে লাখ লাখ মানুষ ১৯৭১ সালে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।  

আমরা যদি গত কয়েকদিনের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে না পারি এবং আমরা যদি বলতে থাকি এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং এর পেছনে দায়ী অল্প কয়েকজন মানুষ। যাদের আগামী নির্বাচনের দিকে নজর রাখা কিছু দল দিকভ্রান্ত করেছে, তাহলে আমরা প্রকৃতপক্ষে আমাদের আগের সব ভুলের দায়ভার নিতে অস্বীকার করছি। একইসঙ্গে আমরা সমালোচকদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার কাজটি অব্যাহত রাখছি এবং নিশ্চিতভাবে আমরা আসন্ন বিপদের মোকাবিলা করতে পারবো না। যেটি বিশাল আকার ও হিংস্রতা নিয়ে দ্রুতগতিতে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। 

 

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

1h ago