মুদ্রাপাচার: সমীক্ষা শুরুই করেনি ৩ সরকারি সংস্থা

মুদ্রাপাচার প্রতিরোধে সরকারের নেওয়া প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে বেরিয়ে যাওয়া অর্থের পরিমাণ নিরূপণ, কীভাবে এবং কোথায় কোথায় এসব অর্থ পাচার হয়—এসব বিষয় জানতে একটি সমীক্ষা চালানোর কথা ছিল। প্রায় ১ বছর হতে চললো এর জন্য নির্ধারিত সময়সীমাও পার হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজটি শুরু করতে পারেনি দায়িত্বপ্রাপ্ত ৩টি সরকারি সংস্থা।
money_laundering.jpg
ছবি: সংগৃহীত

মুদ্রাপাচার প্রতিরোধে সরকারের নেওয়া প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে বেরিয়ে যাওয়া অর্থের পরিমাণ নিরূপণ, কীভাবে এবং কোথায় কোথায় এসব অর্থ পাচার হয়—এসব বিষয় জানতে একটি সমীক্ষা চালানোর কথা ছিল। প্রায় ১ বছর হতে চললো এর জন্য নির্ধারিত সময়সীমাও পার হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজটি শুরু করতে পারেনি দায়িত্বপ্রাপ্ত ৩টি সরকারি সংস্থা।

মুদ্রাপাচার প্রতিরোধের পাশাপাশি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের পথ বন্ধ করতে জাতীয় কৌশলের অংশ হিসেবে নেওয়া এই কাজটি শেষ হওয়ার কথা ছিল গত বছরের ডিসেম্বর মাসে।

কিন্তু এই কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন পর্যন্ত তদন্তই শুরু করতে পারেনি।

গত বৃহস্পতিবার গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, মুদ্রাপাচারের কারণে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের। এই পরিস্থিতিতে সরকারি ৩ সংস্থার নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টি সামনে এসেছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক সংগঠনটি বলছে, অবৈধ আর্থিক প্রবাহের (আইএফএফ) এই ব্যাপারটি প্রধানত কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের দ্বারা আমদানি ও রপ্তানিকৃত পণ্যের ভুল চালান ও সীমান্তে অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। 'ট্রেড রিলেটেড ইললিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ইন ১৩৪ ডেভেলপিং কান্ট্রিস ২০০৯-১৮' শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এ কারণে এই ১ দশকে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক ও কর আদায়ে গড়ে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ ক্ষতির শিকার হয়েছে।

গত সেপ্টেম্বরে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধানের পদ থেকে অবসরে যান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান। তিনি জানান, সমীক্ষাটি করার জন্য একটি বহুপক্ষীয় ঋণদাতা সংস্থার আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সংস্থাটি পরে পিছিয়ে আসার কারণে কাজটি সময়মতো শুরু করা যায়নি।

তিনি বলেন, 'সমীক্ষাটি কোনো স্বনামধন্য বৈশ্বিক সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে করতে হবে। যাতে আমরা একই ধরনের কাজ করেছে এমন দেশগুলো থেকে অভিজ্ঞতা নিতে পারি।'

তার ভাষ্য, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে এই সমীক্ষা করতে হবে।
এনবিআরের একজন কর্মকর্তা জানান, এ বিষয়ে প্রাথমিকভাবে একটি পারসেপশন স্টাডি করা হয়েছিল। তিনি বলেন, 'কিন্তু এখন পর্যন্ত বিস্তারিত কিছু করা হয়নি।'

পরবর্তীতে এই কাজে সহায়তার জন্য নির্বাচিত করা হয় বাংলাদেশ ইনস্টিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টকে (বিআইবিএম)। বিআইবিএমের অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবিব জানান, ৩ থেকে ৪ মাস আগে সংস্থাটি এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা পায়। তিনি বলেন, 'দেশের অবৈধ আর্থিক প্রবাহের বৈশিষ্ট্যগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে সমীক্ষার কাজ পরিচালনার জন্য গবেষণা পদ্ধতি প্রণয়ন করা কঠিন। দেশভেদে এর ধরন ভিন্ন হওয়ায় অন্য দেশের পদ্ধতি অনুসরন করার সুযোগ নেই।'

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয় (ইউএনওসিডি) মাদক চোরাচালানকে কেন্দ্র করে পাচার হওয়ার অর্থের পরিমাণ নিরুপন করতে বাংলাদেশসহ ৬টি দেশের ওপর একটি সমীক্ষা শুরু করেছে। বিআইবিএমসহ বিভিন্ন সংস্থা এই কাজে অংশ নিয়েছে, যা আগামী বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা।

আহসান হাবিব এই গবেষক দলের একজন সদস্য। তার অভিমত হলো, এই কাজটি বাংলাদেশের জন্য একটি গবেষণা পদ্ধতি তৈরিতে সহায়ক হতে পারে। তিনি বলেন, 'এটি দেশের মুদ্রাপাচার সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে সঠিকভাবে বের করে আনতে সহায়তা করবে।'

সরকারের 'ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যান্ড কমব্যাটিং ফিন্যান্সিং অব টেররিজম' বাণিজ্যভিত্তিক মুদ্রা পাচার প্রতিরোধের জন্য আমদানিকৃত পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক মূল্য ও রপ্তানিযোগ্য পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি ব্যাংকে তথ্য ভাণ্ডার স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিল।

এ জন্য ব্যাংকগুলোকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ সংক্রান্ত তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করার কথা বলা হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ব্যাংক এখনো কাজটি করতে পারেনি।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের ভাষ্য, এই ধরনের একটি তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা কঠিন। তিনি বলেন, 'কিন্তু আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। বিদেশি একটি কোম্পানির কাছ থেকে একটি সফটওয়্যার কেনা হয়েছে। আগামী বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে তথ্য ভাণ্ডারটি চালু হবে।'

সফটওয়্যারটি তাৎক্ষণিকতার ভিত্তিতে (রিয়েল টাইম) পণ্য ও সেবার দাম দেখাবে।

মাহবুবুর রহমান বলেন, 'শুল্ক বিভাগের দেশে আমদানি করা ও রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রকাশ করা উচিত। এটি ব্যাংকগুলোকে মূল্য যাচাই করতে সহযোগিতা করবে।'

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান মনে করেন, বাণিজ্যভিত্তিক মুদ্রা পাচার দমনের জন্য দেশকে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে।

তিনি বলেন, 'মুদ্রা পাচার প্রতিরোধে সরকারি সংস্থাগুলোর সময়মতো সমীক্ষাটি শেষ করা উচিত ছিল।'

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments