উৎপাদন বাড়লেও কমছে চা রপ্তানি

বাংলাদেশে এক সময় দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল চা। পাটের পরেই ছিল চায়ের অবস্থান। সময়ের পরিক্রমায় সেই চিত্র বদলে গেছে। গত ১ দশকে উৎপাদন বাড়লেও কমেছে চা রপ্তানি।
Tea.jpg
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বাংলাদেশে এক সময় দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল চা। পাটের পরেই ছিল চায়ের অবস্থান। সময়ের পরিক্রমায় সেই চিত্র বদলে গেছে। গত ১ দশকে উৎপাদন বাড়লেও কমেছে চা রপ্তানি।

চা উৎপাদক ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ক্রমাগত নগরায়ণের কারণে চায়ের অভ্যন্তরীণ ভোগের পরিমাণ বেড়েছে। এ কারণে উৎপাদন বাড়লেও রপ্তানি বাড়ছে না। আরেকটি বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে স্থানীয় বাজারে বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছে।

বাংলাদেশ টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ওমর হান্নান বলেন, 'এক্সপোর্ট কমছে কারণ লোকাল কনজামশন দিন দিন বাড়ছে। সর্বশেষ ৭-৮ বছরে প্রতি বছর লোকাল কনজামশন ৬-৭ শতাংশ বেড়েছে।'

তিনি বলেন, 'প্রতি বছর যে পরিমাণ চা উৎপাদন হচ্ছে, সেটা যদি না হতো কনজামশন ফিলআপ করার জন্য চা উল্টো আমদানি করতে হতো। এক্সপোর্ট কমাটা কোনো ডিমেরিট না। এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে।'

'অকশনে যে পরিমাণ চা ওঠে মৌসুম শেষে, তা কিন্তু অবিক্রিত থাকছে না। এক্সপোর্ট তখনই বাড়বে যখন লোকাল কনজিউম শেষে অ্যাডিশনাল কোয়ানটিটি থাকবে এক্সপোর্ট করার মতো,' যোগ করেন হান্নান।

তিনি আরও বলেন, 'যদি এমন হতো কনজিউম শেষে অনেক চা রয়ে গেছে কিন্তু এক্সপোর্ট হচ্ছে না। সেটা একটা চিন্তার বিষয় হতো দাঁড়াতো। বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে ২৩টি দেশে চা রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, জাপান, ভারত ও সুইজারল্যান্ড রয়েছে।'

বাংলাদেশ চা বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকের মধ্যে দেশে ২০১২ সালে ৬২ দশমিক ৫২ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে রপ্তানি হয়েছে ১ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন কেজি। আর ২০২১ সালে এসে চা উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৬ দশমিক ৫০৬ মিলিয়ন কেজি। একই বছর রপ্তানি হয়েছে শূন্য দশমিক ৬৮ মিলিয়ন কেজি। তবে গত ১ দশকের মধ্যে ২০১৪, ২০১৭ ও ২০২০ সালে ২ দশমিক ৬৬, ২ দশমিক ৫৬ ও ২ দশমিক ১৭ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি হয়েছিল।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ১ দশকের মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরে চা রপ্তানি করে ২ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এরপর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চা রপ্তানি করে ৪ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ।

এরপর তা কমে গত অর্থবছরে এসে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে, বলছে ইপিবির তথ্য।

একটি সূত্র বলছে, আরও বেশ কিছু কারণে এখন বছরে ১ মিলিয়ন কেজি কম চা আমদানি করতে হয়।

হালদা ভ্যালির উদ্যেক্তা নাদের খান দ্য ডেইলি স্টার'র সঙ্গে আলাপকালে একই কথা বলেন।

তিনি বলেন, 'গত ১ দশকে বাংলাদেশের ইকোনমিক গ্রোথ বেশ ভালো হয়েছে। ফলে চায়ের কনজামশন বেড়ে গেছে। এ কারণে প্রতিবছর উৎপাদন বাড়লেও রপ্তানি বাড়ছে না। চাহিদা ও রুচি বোধের ভিন্নতার কারণে চা আমদানিও করতে হচ্ছে।'

বাংলাদেশে চায়ের চাষাবাদ প্রথম শুরু হয় ১৮৪০ সালে। চট্টগ্রামে কুণ্ডদের বাগান (বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব সংলগ্ন এলাকা) নামে সেই চা বাগান অবশ্য সফলতার মুখ দেখেনি। এরপর ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। ৩ বছর পর সেই বাগান থেকে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়।

চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে চা রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। দেশীয় চায়ের গুণগত মান ভালো হওয়ায় বিদেশি ক্রেতাদের কাছে চায়ের চাহিদা ছিল বেশি। তাই তখন এ দেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকাতে উপরের দিকেই ছিল চা।

বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বছরে ১৮ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হতো, এর মধ্যে রপ্তানি হতো ১৫ মিলিয়ন কেজি। এরপর ১৯৭০ সালে এসে বছরে চায়ের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩১ মিলিয়ন কেজিতে। তখনো একটা বিশাল অংশ রপ্তানি হতো।

তিনি বলেন, এখন বছরে ৯৬ মিলিয়ন কেজির ওপর চা উৎপাদন হয়। আর বছরে হোম কনজামশন ১০০ মিলিয়ন কেজির উপরে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দ্বিতীয় জাতীয় চা দিবসের অনুষ্ঠানে বলেন, মান ভালো হওয়ায় বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চায়ের চাহিদা রয়েছে। তবে প্রত্যাশা মতো চা রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকার দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে চা রপ্তানির পদক্ষেপ নিয়েছে।

চা বোর্ড বলছে, দেশে বর্তমানে সর্বাধিক ৯০টি চা-বাগান রয়েছে মৌলবীবাজার জেলায়। দেশে উৎপাদিত চায়ের ৫৫ শতাংশই আসে এই জেলা থেকে। এরপর আছে হবিগঞ্জ জেলা, যেখানে উৎপাদিত হয় ২২ শতাংশ।

Comments