গোয়া: ভারতের বুকেই যেন ছোট্ট এক পর্তুগাল

পৃথিবীর ৩ ভাগ জল আর ১ ভাগ স্থল। সেই ১ ভাগে দাঁড়িয়েই আমার কি উল্লাস। কখনো হাওয়াই জাহাজ থেকে সবুজে নীল জল দেখা, তো কখনো তীর থেকে জলের আছড়ে পড়ায় লুটোপুটি খাওয়া।
বেশিরভাগ মানুষ গোয়া বেড়াতে আসে সমুদ্র সৈকত দেখতে, শপিং করতে। ছবি: ফাতিমা জাহান

পৃথিবীর ৩ ভাগ জল আর ১ ভাগ স্থল। সেই ১ ভাগে দাঁড়িয়েই আমার কি উল্লাস। কখনো হাওয়াই জাহাজ থেকে সবুজে নীল জল দেখা, তো কখনো তীর থেকে জলের আছড়ে পড়ায় লুটোপুটি খাওয়া।

করোনা মহামারির ক্ষত ধীরে ধীরে সেরে উঠছে। একটু একটু করে উঠে দাঁড়াতে চাইছে সবাই।

১৫১০ সালে পর্তুগীজরা দখল করে গোয়া রাজ্য। তখন থেকেই পর্তুগীজ সংস্কৃতি ধারণ করে ভারতের বুকেই এক ছোট্ট পর্তুগাল হয়ে রয়ে গেছে গোয়া। ছবি: ফাতিমা জাহান

সেই ফাঁকেই ঘুরে এলাম ভারতের গোয়া রাজ্য থেকে। অন্যান্য জায়গার চেয়ে এই জায়গাটা আমার কাছে একটু বেশিই আপন। কারণ, আমার একা ঘুরে বেড়ানোর গল্প শুরু হয়েছিল গোয়া থেকেই। তখন ব্যাঙ্গালোর থেকে সবে দ্বাদশ শ্রেণী পাশ করেছি। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি। করার মতো কিছু নেই, আর সেই সঙ্গে বাড়ি ফিরতেও অভিভাবকদের মানা। একদিন মনে হলো অন্যান্যদের মতো আমিও তো পাশের রাজ্যে বেড়াতে যেতেই পারি। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ট্রেনের টিকেট কেটে ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে পৌঁছে গেলাম গোয়ার ভাস্কো দা গামা রেলস্টেশনে। হোটেলের রুমে ব্যাগ রেখে বেরিয়ে পড়লাম।

অচেনা শহর, আবার প্রথমবার একা কোথাও যাওয়া। কিন্তু তার পরেও কোনো ভয় কাজ করেনি মনে। সবগুলো সমুদ্র সৈকত ঘুরে, পুরনো গির্জা, মনুমেন্ট দেখে, সাদা ঢেউয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছিল যেন এখানে আমি আগেও এসেছি।

সবচেয়ে ভালো লেগেছিল রোববার রাতে ছেলে-মেয়েদের পার্টি ড্রেস পরে অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া। পোশাকগুলো একদম পর্তুগিজ সিনেমায় দেখা নায়ক-নায়িকাদের মতো। রোববার অনেক বিয়েও হয়। এদের চমকই আলাদা। পুরো গির্জা সাজানো হয় আলো দিয়ে। রঙ বেরঙের পার্টি গাউন পরা মেয়েরা কমপ্লিট স্যুট পরা ছেলেদের সঙ্গে তালে তালে নাচছে। যেন গোয়ায় পর্তুগিজরা এখনও বাস করে!

এবার গোয়ায় গিয়ে সেইসব স্মৃতি বারবার মনে পরছিল। এরপর অনেকবার গোয়ায় গেলেও প্রথমবারের সেই আমেজ ভুলি কি করে।

গির্জার রাজ্য গোয়া। ছবি: ফাতিমা জাহান

এবার গোয়ায় গিয়েছিলাম উড়োজাহাজে। সেখানকার ছোট্ট এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরে ছুটলাম বাগা বীচের দিকে। সেখানেই আমার অস্থায়ী ডেরা। বিমানবন্দর থেকে সেই ৪৫ কিলোমিটারের পথ আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমার চোখে সাগর ধরা দেয় নীলা, পান্নার খনি হয়ে। পর্তুগীজ ধাঁচের পুরনো একতলা বা দোতলা বাড়ি দেখলে মনে হয়, আগের জন্মে ঠিক এমন একটা বাড়িতেই জন্মেছিলাম। যে বাড়ির সামনে ছোট্ট বাগান, বাগানে উঁকি দিচ্ছে প্রিয় গোলাপি দোপাটি আর মোরগফুল। বাড়ির ট্যালি করা চৌকো ছাদ, সামনের টানা বারান্দা আর মরচে পড়া লোহার শিকের গেইট, দেয়ালের অস্তমিত চুনকাম, বাড়ির আঙিনার কোনায় তেছড়া আলো পড়ে সিমেন্ট দিয়ে বানানো চকচকে ছোট আসনটি যেন আমায় চেনে।

কখনো সাগরের আঙুল ছুঁয়ে, কখনো সবুজ পাহাড়ের একদম হৃদয় ঘেঁষে, কখনো জঙ্গলের অজানা গল্পের পাশ কাটিয়ে ট্যাক্সি ছুটে চলে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে পৌঁছে যাই হোটেলে। সেটা সাগর পাড়েই। হোটেলের সব জানালা দিয়েই বয়ে যাচ্ছে সাগরের হাওয়া। সে হাওয়া হোটেলে বসে ছুঁয়ে দেখার অর্থ হচ্ছে সাগরের ইশারা উপেক্ষা করে নিজেকে কারাগারে বন্দি রাখা।

গোয়ার প্রায় সব দর্শনীয় স্থান আমি আগে কয়েকবার দেখেছি। লক্ষ্য করে দেখলাম আমার হোটেলের পেছনে বেশ কিছু স্থানীয় মানুষ বসবাস করেন। ভাবলাম এবার মহল্লায় ঘুরব। সকাল থেকে তাই সরু মেঠো পথে হাঁটছি। সমুদ্র সৈকতের সোনালী বালির সঙ্গে মিলিয়ে এখানকার মাটিও লাল। আশেপাশে একতলা বাড়ি, ট্যালি দেওয়া চৌকো ঘর, আমাদের দেশের ৪ চালা টিনের ঘরের মতো। বাড়ির সামনে পরিচ্ছন্ন আঙিনা, আঙিনায় বাসিন্দার কোমল যত্নে ফুটেছে ফুল। বেশ একটা মফস্বলের শান্তি শান্তি ভাব। গাড়ি-ঘোড়ার আওয়াজ নেই, মানুষের হট্টগোল নেই, শুধু ভেসে আসে সাগরের ডাক আর নোনা ঢেউয়ের হাওয়া।

বাড়িগুলোর দেয়ালে গা লাগিয়ে সারি সারি নারকেল গাছ দুলে দুলে ডাকছে আর সদর দরজার কাছাকাছি জায়গায় একটা বেদি করে সিমেন্টের সাদা ক্রস বসানো। যিশুখ্রিস্টকে সম্মান প্রদর্শনের এই প্রতীক প্রায় সব গোয়ানিজ খ্রিস্টান বাড়িতেই দেখা যায়। ক্রসের মাথায় একটা ফুল আর পায়ের কাছে একটা ফুল রাখা। আহা ভক্তি!

বাড়ির দেয়ালে সিমেন্টের সোজাসাপ্টা প্লাস্টারের বদলে নকশা করা। সেগুলো নান্দনিকতা ছোট ছোট রঙিন আনন্দ হয়ে ছেয়ে আছে প্রায় সব বাড়িতে। অনেক বাড়ির ছাদে ট্যালির ওপর সিমেন্টের ছোট পুতুল বা পশুপাখি বসানো। এর সবই পর্তুগিজদের রেখে যাওয়া ছাপ।

আমি আজ যেহেতু সরু অলিগলি দিয়ে হাঁটব, তাই মূল সড়কে না গিয়ে ভেতরের গাছপালায় ঘেরা মেঠোপথে হাঁটছি। দেখতে পেলাম, বেশ কয়েকটা বাংলো বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে। মন চাইছে এখানেই থেকে যাই। সবুজ, সাগর, মেঘ নিশ্চয়ই আমায় খুব বেশি বিরক্ত করবে না।

পথের বাঁকে ছোট একতলা সপ্তদশ শতাব্দীর গির্জা। এই মফস্বলে এখনো নগরীর সুযোগ-সুবিধা প্রবেশ করতে পারেনি, অনেকখানিই আগের মতোই আছে।

আমি হাঁটছি কালাংগুট বীচের দিকে। উদ্দেশ্যহীন হাঁটা। এরকম উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকলে একদিন আমি ঠিক সব সাগরতট হেঁটে দেখে ফেলব। সরু পথে অতি ক্ষুদ্র ২-১টা একটা দোকান। বিস্কুট, চিপস, কোল্ড ড্রিংকস পাওয়া যায়। দোকান এত ছোট যে দেখাই যায় না প্রায়। আর তার পাশ জুড়ে শুধুই গাছপালা।

১৫১০ সালে পর্তুগীজরা দখল করে গোয়া রাজ্য। তখন থেকেই পর্তুগীজ সংস্কৃতি ধারণ করে ভারতের বুকেই এক ছোট্ট পর্তুগাল হয়ে রয়ে গেছে গোয়া। তবে, এখানকার মানুষ পর্তুগীজ ভাষায় কথা বলে না। তাদের ভাষা কোঙ্কনি। ভাষায় না হলেও বেশির ভাগ মানুষের পোশাকে বিদেশি ছাপ স্পষ্ট। গোয়া রাজ্যে পর্তুগীজ কেউ আর বসবাস করেন না। তবে এই ছোট রাজ্যের বাতাসে, আলোয়, ঘরের দেয়ালে, বৈঠকখানায় পর্তুগীজ ছোঁয়া রেখে গেছেন তারা।

এখানকার খাবার আমার খুব প্রিয়। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই কালাংগুট বীচে। বীচের ধারে ফাকা একটা রেস্তোরাঁ দেখে বসে পড়লাম। ছোট কিন্তু ছিমছাম এক সাধারণ রেস্তোরাঁ। কত ধরনের সামুদ্রিক মাছ যে আছে! আপাতত বাংড়া আর চিংড়ি মাছ খেলাম। এদের মাছ রান্নার পদ্ধতি আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কম তেল-মশলায় খুবই স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে রান্না হয়। এর সঙ্গে দেয় তেঁতুল বা লেবু পাতা। রঙ হয় টকটকে লাল বা কমলা, পাতলা ঝোলে ঝাল একেবারেই হালকা। মাছ ভাজে বিভিন্ন মসলা দিয়ে।

খাওয়া শেষে ফিরলাম ডেরায়। এই রিসোর্টের নিজস্ব বীচটা ফাঁকা থাকে সারাদিন। এখন এই রোদ পড়ে আসা বেলায় দেখি কয়েকজন স্থানীয় কিশোর ভলিবল খেলছে৷ আমার কি কিশোরবেলা ফুরিয়ে গেছে! যায়নি। তাই এই চৌকস খেলোয়াড়দের সঙ্গে আনাড়ি হয়েও যোগ দেই।

(চলবে)

Comments

The Daily Star  | English
Inner ring road development in Bangladesh

RHD to expand 2 major roads around Dhaka

The Roads and Highways Department (RHD) is going to expand two major roads around Dhaka as part of developing the long-awaited inner ring road, aiming to reduce traffic congestion in the capital.

14h ago