শৈশব রাঙানো রূপকথার কুশীলব

ছবি: সংগৃহীত

গল্প শোনা আর বলা- প্রজন্মের পর প্রজন্মে ছড়িয়ে যাওয়া এই চর্চাটি একসময় গ্রামবাংলার প্রতিটি অলস দুপুর বা পড়া ফাঁকি দেওয়া সন্ধের চর্চা ছিল। উঠোন বা দাওয়ায় বসে শিশু-কিশোরদের কাছে গল্পের ঝুলি খুলে বসতেন দাদু-দিদিমা-ঠাকুরমারা। এসব গল্পে কল্পনাই প্রাধান্য পেত বেশি, যৌক্তিক দুনিয়ার সঙ্গে তার মিল থাকতো না তত। সাহিত্যের একেবারে ঘরোয়া রূপে সেই গল্পগুলো ছিল অন্যতম বিনোদনের অঙ্গ। 

ক্রমেই ডিজিটাল জগতের বিস্তৃতির সঙ্গে অন্য অনেক চর্চার মতো প্রায় হারিয়ে গিয়েছে সেসব গল্পের ক্ষণ। তবু পেছন ফিরে তাকালে যে রূপকথার গল্পের খনি পাওয়া যায়, তাকে অস্বীকার করে বাংলা সাহিত্য এগোতে পারে না। এই লেখাটিতে রূপকথার এমন কিছু চরিত্রকে রাখা হয়েছে, যাদের ঘিরেই বোনা হয় বাংলা রূপকথার নকশিকাঁথা। প্রায় সব রূপকথার গল্পের কাঠামোতে নজর দিলেই দেখা যাবে এদের।

ছবি: সংগৃহীত

ভালো রানি, খারাপ রানি

যতই কল্পনার মিশেল থাকুক, রূপকথার চরিত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য কিন্তু দিনশেষে আমাদের চেনাজানা গণ্ডিতেই ঘুরপাক খায়। হ্যাঁ বা না, সত্য বা মিথ্যে এমন আরও বহু ভালো-মন্দের সাদাকালো রঙে এই দুটো চরিত্রও আঁকা হয়। অন্যসব ইতি-নেতির মতো এদের নামও একসঙ্গে নেওয়া হয়। একই রাজার দুই রানি হিসেবে থাকেন এরা। একজন হন শাসন-শোষণের প্রতিভূ, তো আরেকজন নিপীড়িতের প্রতিনিধি। সুয়োরানি-দুয়োরানি বা লক্ষ্মীরানি-রাক্ষসী রানি; সবাই এই ছাঁচেই পড়ে। 

'শীত-বসন্ত' গল্পে রানিদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়, 'সুয়োরানী যে, নুনটুকু ঊন হইতেই নখের আগায় আঁচড় কাটিয়া, ঘর-কন্নায় ভাগ বাঁটিয়া সতীনকে একপাশ করিয়া দেয়। দুঃখে দুয়োরানির দিন কাটে।' মূলত সুখ আর দুঃখ থেকেই চরিত্র দুটোর নামকরণ করা হয়েছে। অন্যভাবে বললে, ট্র্যাজিক নায়িকা হিসেবে দেখানো হয় দুয়োরানিকে, আর খলনায়িকার রূপ নেন সুয়োরানি। সেই জের ধরে সুয়োরানিকে একসময় কঠোর শাস্তি পেতে হয়, দুয়োরানি পান পুরস্কার। গল্পের শেষে 'দুঃখিনী দুয়োরানির দুঃখ ঘুচিল' বাক্যের মাধ্যমে এমন একটা নীতিবাক্য স্থাপনের চেষ্টা চলে যে দিনশেষে ভালোরই জয় হয়। 

'নীলকমল আর লালকমল' গল্পেও থাকেন এমন দুই রানি। একজন রাক্ষসী, যিনি রানির রূপ নিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ডকারখানা করে বেড়ান, তার 'ঘোমটার আড়ে জিভ লকলক, আনাচে-কানাচে উঁকি'! আরেকজন লক্ষ্মীরানি, যাকে মোটামুটি আদর্শ রূপে দেখা যায়। তিনি অন্য রানির অত্যাচারে সর্বদাই কাহিল হয়ে থাকেন। 

ছবি: সংগৃহীত

অবুঝ রাজা

রূপকথার রাজারা বেশ ভোলাভালা ধরনের হন। ক্ষমতায় তাদের ওপর কেউ না থাকলেও বুদ্ধিতে তেমন পাকা মনে হয় না তাদের। বেশিরভাগ সময়ই খারাপ রানির পাঁয়তারা রাজা নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন ভালো রানি আর রাজপুত্রদের, তারপর আবার আত্মগ্লানিতেও ভোগেন। রাজার ভুল ভাঙাতে আর চোখ খুলে দিতে বহু অভিযান ও ঘটনাবহুলতার প্রয়োজন পড়ে। গল্পের একদম শেষটায় গিয়ে অনেকটা বাংলা সিনেমার পুলিশের 'আইন হাতে তুলে নেবেন না' সংলাপের মতোই যেন রাজার ভূমিকা। নিজের ভুল শুধরাতে গিয়ে শেষ দৃশ্যে দরিয়াদিল রাজা তখন শাস্তি আর পুরস্কারের কাজটি সারেন এবং 'অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে দিন কাটাইতে লাগিল' ধরনের সমাপ্তি ঘটে।

ছবি: সংগৃহীত

ভাগ্যভ্রষ্ট বীর রাজপুত্র

প্রায় সব রূপকথার গল্পেই বোধহয় মূল চরিত্র বা নায়কের ভার নিয়ে থাকে রাজপুত্রেরা। এমনকি তাদের জন্মের জের ধরেও ঘটে যায় অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা। শীত-বসন্তই হোক, লালকমল-নীলকমলই হোক বা ডালিমকুমার; সব রাজপুত্রের জন্ম নিয়ে বেশ একটা হৈ হৈ রব পড়ে যায়। একটু বড় হবার পরই ভাগ্যপরিক্রমায় রাজপুত্ররা হয় নিজ রাজ্য থেকে দূরে ছিটকে পড়ে, আর নয়তো কোনো নতুন অভিযান এসে তাদের হাতছানি দেয়। সেসব অভিযানে তাদের সঙ্গে দেখা হয় নতুন নতুন চরিত্রের, জানা যায় নতুন সব রহস্য। এসব গল্পে রাজপুত্রের দুঃসাহসিক অভিযানগুলোই সবচে বেশি আকর্ষণ করে গল্প শ্রোতা বা পড়ুয়াদের। 

অবলা রাজকন্যা

ইংরেজি পরিভাষা 'ড্যামসেল ইন ডিস্ট্রেস'-এর বিপরীতে আমাদের রূপকথায় আছেন অবলা রাজকন্যারা। ব্যতিক্রম খুব একটা নেই, থাকলেও তা নগণ্য। এই রাজকন্যাদের মূলত উপস্থাপন করা হয় রাজপুত্রের অভিযানশেষে পাওয়া পুরস্কার হিসেবে। কলাবতী রাজকন্যাকে তাই যখন প্রশ্ন করা হয়, 'রাজকন্যা, তুমি কার?'- সে জবাবে বলে, 'আগে ছিলাম বাপের-মায়ের, তার পরে ছিলাম আমার; এখন তোমার।' একইভাবে 'সোনার কাঠি রুপার কাঠি' গল্পে ঘুমন্তপুরীতে থাকা ঘুমন্ত রাজকন্যার ঘুম ভাঙিয়ে তাকে রাক্ষসের হাত থেকে বাঁচাতে যায় এক রাজপুত্র। এই রাজকন্যাদের নিজস্ব তেমন কোনো অভিযান থাকে না, রাজপুত্রের অভিযানে তাদের একটা পরোক্ষ ভূমিকা থাকে। অনেক সময় সেসব অভিযানের মূল উদ্দেশ্যই হয়ে ওঠে রাজকন্যাকে দুষ্টুলোকের হাত থেকে বাঁচানো। 

ছবি: সংগৃহীত

রূপতরাসী রাক্ষসী

'হাউমাউখাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ' মন্ত্রে দীক্ষিত ডাকিনী বা রাক্ষসীর মূল কাজই থাকে রাজকন্যা-রাজপুত্রদের বন্দি করে রাখা আর বিভিন্ন কলাকৌশল করে সবাইকে ঝামেলায় ফেলা। গল্পের মূল খলচরিত্র বলা চলে একে। রাজপুত্রের অভিযানের বড় অংশ থাকে এই রাক্ষসীর প্রাণভোমরা খুঁজে বের করা এবং হত্যা করা। গল্পের বেশিরভাগ সমস্যা সেখানেই শেষ হয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ-এর দিকে যাত্রা করে। 

উপকারী বেঙ্গমা-বেঙ্গমী

এই পক্ষীজুটিটি হচ্ছে অনেকটা রূপকথার কথক বা সূত্রধর। মূল গল্পে তাদের তেমন আসা-যাওয়া থাকে না ঠিকই, তবু গল্পের হাল ধরতে তাদের জুড়ি নেই। তারা দুজন এক বিশাল অশ্বত্থগাছে বাসা বেঁধে থাকে, নিজেদের মতো সংসার করে। ঘটনার পরিক্রমায় তাদের সঙ্গে দেখা হয় গল্পের রাজপুত্রদের, দেখা হয় অন্য সব চরিত্রদের। একবার অবশ্য লালকমল আর নীলকমলের উপকারের প্রতিদান দিতেই তারা সাহায্যের হাত বাড়ায়। সাধারণত বেঙ্গমীর কৌতূহলী সব প্রশ্নের উত্তরে বেঙ্গমা খুলে দেয় বহু রহস্যের জট, যা থেকে অনেকসময় গল্পের মোড় পালটে যায়। দিকভ্রান্ত পথিকদের পথ বাতলে দেওয়াটাও তারা নিজেদের কাজ ভেবেই নিয়েছে। বিপদে পড়া রাজপুত্রদের ঠিক সময়ে ঠিক কথাটি বলে দিয়েই এক নিমেষে উড়ে যায় বেঙ্গমা আর বেঙ্গমী। শুভাকাঙ্ক্ষী উপদেষ্টা বললেও ভুল হবে না এদের। 

এই কাঠামোগত চরিত্রগুলো ছাড়াও আরেকটি চরিত্র উপরি পাওনা হিসেবে যোগ করে দেওয়া হলো পাঠকদের জন্য। 

চাঁদের বুড়ি

এক সন্ধ্যায় ভরা জোছনায় আকাশের দিকে তাকিয়ে যদি সব উপকথা-রূপকথা সত্যি বলে মনে হয়, তবে মনে পড়ে শৈশবে গল্প শোনা সেই চাঁদের বুড়িকেও। নিঃসঙ্গ বুড়ি তার চরকা কেটেই চলে। সে বুড়ির বয়সের হিসেব দিয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তার 'শিশু ভোলানাথ' বইটিতে– 

'এক যে ছিল চাঁদের কোণায়
চরকা-কাটা বুড়ি
পুরাণে তার বয়স লেখে
সাতশো হাজার কুড়ি।'

এতদিনে নিশ্চয় বুড়ির বয়স আরও বেড়েছে। তবু রূপকথার কথা মেনে চললে ভাবা যায়, পূর্ণিমা-অমাবস্যার পাক্ষিক হিসাব পেরিয়ে এখনো নিজমনে চরকায় সুতো কাটছে বুড়িমা। যদিও বিজ্ঞানের কথা শুনতে গেলে মানতে হয় লুনার মারিয়ার বিষয়টি। গানে গানে চাঁদের কলঙ্করেখাই হোক আর রূপকথার গল্পে চরকাকাটা বুড়িই হোক, কল্পনাশক্তির জেরে মানুষ মূলত চাঁদের ৩১ ভাগে ভরে থাকা লুনার মারিয়াকে দেখি। ল্যাটিন এই শব্দটির অর্থ হচ্ছে, 'চন্দ্র সমুদ্র'। এ নামের পেছনেও আছে সতেরো শতাব্দীর জ্যোতির্বিদদের অবদান। সেই সময় চাঁদের দাগ দেখে তারা ভেবেছিলেন, চাঁদে আছে এক অদ্ভুত সমুদ্র। 
 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh FY25 national budget analysis

FY25: A year of fewer jobs, falling investment

When Finance Adviser Salehuddin Ahmed presents the national budget for the fiscal year (FY) 2025–26 tomorrow, he will have some encouraging numbers to share..Exports and remittances are climbing, foreign exchange reserves have steadied, and the exchange rate has shown signs of stability. I

14h ago