অনন্য-অপরূপ সুন্দরবন!

এই বন কখনো বুড়ো হয় না। এর জাদুকরী পরিবেশ ও সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য দর্শনার্থীদের ক্লান্ত ইন্দ্রিয় এবং আত্মাকে পুষ্ট করতে ব্যর্থ হয় না কখনো। সে কখনো কাউকে হতাশ করে না। যতবার আপনি সেখানে যাবেন, বনের প্রতি কোনায় আপনার জন্য আরও আরও চমক অপেক্ষা করে থাকবে।
সুন্দরবনের কোকিলমনির কাছে খাল পার হচ্ছে একদল চিত্রা হরিণ।

এই বন কখনো বুড়ো হয় না। এর জাদুকরী পরিবেশ ও সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য দর্শনার্থীদের ক্লান্ত ইন্দ্রিয় এবং আত্মাকে পুষ্ট করতে ব্যর্থ হয় না কখনো। সে কখনো কাউকে হতাশ করে না। যতবার আপনি সেখানে যাবেন, বনের প্রতি কোনায় আপনার জন্য আরও আরও চমক অপেক্ষা করে থাকবে।

গত নভেম্বরে ষষ্ঠবারের মতো আমরা ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার ও প্রকৃতিপ্রেমীদের একটি দল ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় থাকা সুন্দরবন ভ্রমণে যাই। বরাবরের মতো মুগ্ধতা ছড়ানো বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনটির সৌন্দর্য, দারুন সব বণ্যপ্রাণী, নীরব পরিবেশ ও স্থানীয়দের জীবনধারা আমাদের আকৃষ্ট করে।

সাঁতরে পশুর নদী পার হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

গত বছরের ১০ নভেম্বর খুলনার মংলা থেকে শুরু হয় আমাদের সফর। পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকা থেকে ১১ ঘণ্টার বাসযাত্রার পর মংলা থেকে ট্যুর অপারেটরের ইঞ্জিনচালিত বোটে উঠি। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল বনের শরণখোলা রেঞ্জের কোকিলমনি এলাকা। শুরুতে ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লেগেছিল আমাদের। খানিকটা দেরিতেই আমরা উপলব্ধি করলাম যে, এখানকার আগামী কয়েকটা দিন হবে শহুরে যান্ত্রিক জীবনধারার চেয়ে আলাদা।

মাঝারি আকারের বিরল লাল মাছরাঙা। এর ইংরেজি নাম রুডি কিংফিশার।

প্রথম দিনে সূর্যোদয় দেখার অভিপ্রায় থেকে দ্রুত বিছানায় যাই আমরা। কারণ বনটি আক্ষরিক অর্থেই সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই জেগে ওঠে। আর এই বনের সৌন্দর্য ও প্রশান্তি অনুভব করতে সবগুলো ইদ্রিয়কেই সজাগ রাখতে হয়।

মেনি মাছ বা মাডস্কিপার।

সেদিন সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন বনের তীব্র অন্ধকারকে ভেদ করল, তখন আমরা এই বনের রূপান্তর দেখতে পেলাম। এরসঙ্গে সেখানকার ভয়ংকর নীরবতা হয়ে উঠল জীবনের কোরাস।

ব্যাপারটি ছিল শ্বাসরুদ্ধকর। আর আরও অনেক মুগ্ধতার শুরুমাত্র।

সুন্দরবনের খালে মাছ ধরছেন স্থানীয় জেলেরা।

পশুর নদীর তীর ধরে যাওয়ার পথে সকাল সোয়া ৭টার দিকে দূরে কিছু একটার দিকে চোখ পড়ল আমাদের। আমরা দেখতে পেলাম, একটি বড় প্রাণী নদী পার হচ্ছে। কাছাকাছি পৌঁছে আমরা বুঝতে পারি যে, সেটি ছিল একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

বিরল পাখি সুন্দরী বা গোইলো হাঁস। ইংরেজিতে এর নাম মাস্কড ফিনফুট। বর্তমানে সারাবিশ্বে এই বিপন্ন পাখি আছে মাত্র ১০০ থেকে ৩০০টি। ছবি: ড. আব্দুস এস আলীম

সুন্দরবনের রাজাকে তখন স্পষ্টতই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তাই আমরা এর নিরাপত্তার জন্য খুব কাছে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

আমাদের গাইড ও বোটের চালকও জানালেন যে, একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘের জন্য ৬০০-৭০০ মিটার প্রশস্ত নদী পাড়ি দেওয়ার বিষয়টি বেশ অস্বাভাবিক। এ অবস্থায় রাজকীয় এই প্রাণীটিকে বিরক্ত না করে যতটা পারা যায় ছবি তুলি আমরা।

ভোঁদড়। বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই প্রাণীটি।

বাঘ দর্শনের কয়েক মাস পরে এসে নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে হয়। কারণ আমাদের গ্রুপের এক সদস্য তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব ২৬ বার সুন্দরবন ভ্রমণ করেও বাঘের দেখা পাননি।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের জরিপ অনুসারে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মাত্র ১১৪টি বেঙ্গল টাইগার আছে।

গোখরা প্রজাতির সাপ মনোক্লেড কোবরা।

ভ্রমণের পরের ৩ দিনও ভাগ্য আমাদের সঙ্গে ছিল। এ সময় বনের বেশ কয়েকটি জায়গা ঘুরে এই প্রাকৃতিক আবাসস্থলে প্রচুর বন্যপ্রাণীর দর্শন পাই আমরা।

ভ্রমণকালে বনে ৭ প্রজাতির মাছরাঙা চোখে পড়ে আমাদের। এগুলোর মধ্যে মাঝারি আকারের লাল মাছরাঙা, বাদামি ডানার মাছরাঙা, কালোমাথা মাছরাঙা, সাদা গলার মাছরাঙা ও নীল কানের মাছরাঙা বেশ বিরল।

বনের বিচিত্র ধরনের পাখপাখালির রঙ আপনার মনকেও রাঙিয়ে দেবে।

লবন পানির কুমির।

এ ছাড়া বনের প্রায় সব জায়গায় চিত্রা হরিণের দেখা পেয়েছি আমরা। ভোদড়ের মাছ ধরার দৃশ্য কিংবা বোটের কাছাকাছি ইরাবতী ডলফিনের ডুব সবাইকে আপ্লুত করতে বাধ্য। মেনি (মাডস্কিপার) মাছের ক্রিয়াকলাপেও অবাক করা বিষয় আছে। কাঁকড়ার বিচিত্র রঙেও মুগ্ধ হবেন অনেকে।

চমক কিন্তু আসতেই থাকে। ১৪ নভেম্বর সফর শেষ হওয়ার আগে বেঙ্গল টাইগারের চেয়েও বিরল প্রজাতির এক প্রাণীর দেখা পাই আমরা। তা হলো বিরল ও বিপন্ন পাখি সুন্দরী বা গোইলো হাঁস। ইংরেজিতে এর নাম মাস্কড ফিনফুট।

এই নিবন্ধের লেখক আসকার ইবনে ফিরোজ। বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কারপ্রাপ্ত একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার তিনি।

২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা বর্তমানে সারাবিশ্বে এই বিপন্ন পাখি আছে মাত্র ১০০ থেকে ৩০০টি। সুন্দরবন এখনো এদের একটি প্রজননক্ষেত্র।

তবে বন উজাড়ের পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে ক্ষতি হচ্ছে সুন্দরবনের। একটি অনন্য বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে চলার পাশাপাশি প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করা এই বন রক্ষায় আমাদের দ্রুত উদ্যোগী হওয়া দরকার।

সুন্দরবন ভ্রমণে করণীয়

বিভিন্ন জায়গা থেকে সুন্দরবনে ঢোকার সুযোগ থাকলেও খুলনা ও মোংলা বেশ জনপ্রিয় এন্ট্রি পয়েন্ট। সুন্দরবন ভ্রমণে ট্যুর অপারেটরদের বেশ কয়েকটি প্যাকেজ আছে। এতে ২ রাত ও ৩ দিনের ভ্রমণের জন্য জনপ্রতি ৬ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হবে। এসব ট্যুরে সাধারণত কচিখালী বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কটকা সৈকত, হাড়বাড়িয়া, হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, ডিমের চর ও করমজলসহ কয়েকটি জায়গা ঘুরে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়।

Comments