যা দেখলাম শ্রীলঙ্কায়

শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ

শ্রীলঙ্কার গল্পটা এক দীর্ঘ রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন এই দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া এবং রাজনৈতিকভাবে ভয়ঙ্কর টালমাটাল অবস্থায় ছিল। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তা থেকে ফিরে আসার যে দারুণ পর্যায়ে শ্রীলঙ্কা নিজেকে নিয়ে গেছে, তা প্রশংসনীয়।

এ দেশের পাহাড়ে-পর্বতে, সমুদ্রসৈকত আর শহরের অলিগলিতে সম্প্রতি ঘুরে বেড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার একটি কথাই তখন বারবার মনে হয়েছে, যদি দেশটি এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে না পারত? কী হতো তাহলে? এ থেকে আমাদের কি কিছু শেখার আছে? প্রকৃতি ও সংস্কৃতিতে ভরপুর এই দ্বীপরাষ্ট্রের মানুষগুলো যেন কখনো হেরে যেতে জানে না। সেইসঙ্গে আতিথেয়তা, গর্ব আর নিজেদেরকে ধরে রাখার প্রবণতা তো রয়েছেই।

শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ

শ্রীলঙ্কায় যেতে চাইলে চটজলদি ই-ভিসা করিয়ে ফেলুন। সময়, পরিশ্রম দুইই বাঁচবে। একদিনের মধ্যে স্টিকার ভিসাও করানো যায়, তবে এজেন্টের মাধ্যমে খরচটা একটু বেশি হবে।

ঢাকা থেকে গভীর রাতের বিমানে করে যাত্রা শুরু হয়েছিল, রাত ২টা ১৫ মিনিটে। সময়টা এমনভাবেই বাছা হয়েছিল যাতে পাক্কা দুই দিনের ভ্রমণ হয়। ফেরার সময় ছিল রাত ৯টা ৩০ মিনিট, যাতে পুরো দুইদিনের একটি মুহূর্তও বাদ না যায়। এখানে একটি বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো, শ্রীলঙ্কার বেশিরভাগ হোটেলেই সকাল ১১টা থেকে ২-৩টার মধ্যে চেক ইন করা যায়। আর যদি কম অতিথি থাকেন, তাহলে এ সময়ের আগেও চেক ইন সম্ভব।

ট্রাভেল এজেন্টদের ফেরে না পড়ে আমি সবসময় নিজের ট্রিপগুলো নিজেই সাজাই। এবারে আমি যাত্রাপথ শুরু করেছিলাম ক্যান্ডির পথে কলোম্বোর প্রকৃতি দর্শন, এরপরে নুয়ারা এলিয়াতে দুই রাত থাকা এবং তারপরে এলা, মিরিসা এবং শেষমেশ গওলে ঢুঁ মারা– এই ক্রমান্বয়ে।

থাকার জায়গার ক্ষেত্রে বলব, মূল রাস্তাঘাটের আশেপাশে থাকলেই ভালো, যা ম্যাপে দেখা যায়।

বান্দারনাইকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভোর ৫টায় নামার পর এক বাক্স দিলমাহ চা উপহার নিয়ে আমার এক বন্ধু নিতে এলো। মনটা তখনই আতিথেয়তার সুবাসে ভরে গেল।

শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ

ইমিগ্রেশন শেষ করে, টাকাকে রুপিতে বদলে নিয়ে প্রায় ১৪০০ লঙ্কান রুপিতে কিনে নিলাম ডায়ালগ সিম কার্ড। স্থানীয় নেটওয়ার্কের জন্য এই সিম সবচেয়ে ভালো। এতে ছিল ২০ জিবি ডাটা আর লোকাল কল মিনিট। বোর্ডিংয়ের আগে আমার সঙ্গে এক বহুদিন আগের স্কুলবন্ধুরও দেখা হয়ে গেল। 

আমাদের ড্রাইভার ও গাইড নিরোশ চারমিন্দা বিমানবন্দরে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। গোছগাছ করে, বন্ধুটিকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম ক্যান্ডির উদ্দেশে। মাঝপথে এদিক-ওদিক থেমেছিও অনেকবার। উদ্দেশ্য ছিল চারপাশটা ভালো করে দেখা।

নাশতা খেতে গিয়ে পরিচিত হলাম কোট্টু নামের এক খাবারের সঙ্গে। টুকরো রুটি, নুডুলস আর সবজি দিয়ে তৈরি খাবারটি দেখলাম খুবই জনপ্রিয়। চামিন্দা আমাদেরকে দুই ধরনের ডাব খাওয়াতে চাইল— লাল-কমলা কিং কোকোনাট আর একেবারে কচি সবুজ ইয়াং কোকোনাট। ভীষণ সতেজ লাগল খেয়ে। 

ক্যান্ডিতে ঢোকার আগে এলিফ্যান্ট অরফানেজ ও এলিফ্যান্ট ফাউন্ডেশনে ঘুরতে যাওয়া যেত। কিন্তু সময় যেহেতু একেবারেই কম, তাই আমরা সুশান্ত স্পাইস গার্ডেনে যাওয়ার বিষয়েই মনস্থির করলাম। এতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। আশপাশের পাহাড়ি রাস্তায় ওষধি গাছের পসরা বসেছিল। অ্যালোভেরা, দারুচিনি, গটু কোলা ইত্যাদি বিভিন্ন ভেষজ গাছপালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল।

ক্যান্ডির আবহটা ছিল একেবারে ঔপনিবেশিক ঘরানার। প্যাগোডা, মসজিদ, মন্দির– সবই এক সারিতে খুব শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রয়েছে। আমরা ছিলাম ক্যান্ডি সুপ্রিম হোটেলে, এর আশপাশটা দারুণ ছিল– পাশেই হ্রদের মনোরম দৃশ্য। দুপুরে খেলাম ইন্ডিয়ান সামারে, বেশ উঁচু দরের একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁ। বেশ সুস্বাদু খাবারদাবার। রাস্তার অপর পাশেই একটি ছোট সয় আইসক্রিম স্ট্যান্ড ছিল, যার স্বাদ মন কেড়ে নিয়েছে আলাদাভাবে।

এরপর আমরা গেলাম রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনে। ওখানকার বিস্তৃতি মনকে শান্ত করে তোলে। সারা দিন ঘুরে বেড়ালেও শেষ হবে না। এরপর কিছু হালকা খাবার নিয়ে হোটেলে ফিরে গেলাম আর প্রস্তুতি নিতে থাকলাম পরদিন নুয়ারা এলিয়াতে ঘুরতে যাওয়ার।

ক্যান্ডি লেকে সকালবেলা হেঁটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা অদ্ভুত সুন্দর ছিল। ক্যানাডিয়ানা ক্যাফেতে চটপট একটা কফি খেয়ে নেওয়ায় সকালটা আরো বেশি জাঁকিয়ে বসল যেন। ফেরার পথে সরকার অনুমোদিত একটি রত্ন-গয়নার দোকানে প্রায় দুই ঘণ্টা কাটালাম। মূল্যবান পাথর কিছু দেখলাম, কিছু কিনলাম। আমাদের অবশ্য দুটো রত্নখনিতে যাবার সৌভাগ্যও হয়েছিল।

যত উঁচুতে চড়ছিলাম, বাতাস ততই ভারি হয়ে উঠছিল। পাল্টে যাচ্ছিল আশপাশের দৃশ্যগুলো। কুয়াশায় ঘেরা পাহাড়গুলোতে চা চাষ হয়, আছে বুদ্ধ মন্দির আর পুরোনো মসজিদের নকশা – দুয়ে মিলে এক মিশ্র সংস্কৃতির পরশ দেয়। রাম্বোড়া ফলসে বিরতি নিয়ে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিলাম রাম্বোড়া ওয়াটার ভিলায়। ঝরনার পাশে দারুণ একটি রিট্রিট।

চামিন্দা আমাদেরকে একেবারে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে চালিয়ে নিচ্ছিলেন। তার মতো দক্ষ সঙ্গী থাকায় বহুদিনের ঘোরাফেরা যেন মাত্র কয়েক ঘণ্টায় করে ফেলা গেল।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৮৫৩ মিটার উঁচুতে থাকা নুয়ারা এলিয়াকে অনেকেই লিটল লন্ডন নামে ডাকেন। আর তার কারণও আছে। শীতল বাতাস, ঔপনিবেশিক ঘরানার ভবন, ফুলের বাগান আর একেবারে সিনেমার মতো সরে সরে যাওয়া কুয়াশার দল।

আমরা থেকেছিলাম কুইনসল্যান্ড হোটেলে। একেবারে দাগহীন একটি ব্যক্তিগত জায়গা, সামনেই সুপারস্টোর। হাতে সময় থাকলে আমি নিশ্চয়ই এক সপ্তাহ থাকতাম। রাতে শেয়ালের ডাকাডাকি, গাছের মধ্য দিয়ে বাতাসের সরসরানি আর খোলা ছাদে বসে নাশতা করার স্মৃতি এ জীবনে ভোলা যাবে না।

ওখানকার পোস্ট অফিসটি প্রায় কয়েক শতক পুরোনো তো হবেই। কিন্তু এখনো দিব্যি কাজ চলছে। এ থেকেই বোঝা যায়, শ্রীলঙ্কার নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখার– যে গর্ব ও সংরক্ষণের প্রবণতা রয়েছে, তা কতটা গভীর। টি টেস্টিং, তাজা স্ট্রবেরি আইসক্রিম এবং গ্রেগরি লেকের পাশ দিয়ে হাঁটার রাস্তায় সে জায়গার উপভোগ্যতা আরো বেড়ে যায়।

এরপর আমরা এলার দারুণ দৃশ্যে গাঁথা পথ দিয়ে এগিয়ে সীতা মন্দিরে গেলাম। বিশ্বাস করা হয়, এখানেই লঙ্কার রাজা রাবণ সীতাকে বন্দী করে রেখেছিলেন। উপকথা হোক কিংবা ইতিহাস, এর আশপাশের পরিবেশে সত্যিই আজও কিংবদন্তির গন্ধ ভাসে।

স্থাপত্যের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হচ্ছে দ্য নাইন আর্চ ব্রিজ। ওখানটায় গেলে অন্তত তিন ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে যাবেন। আর যদি স্যুভেনির কেনার ইচ্ছা থাকে, তবে এলায় সবচেয়ে ভালো দামে মিলবে। রাবণ ফলসে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, কেন রাবণ লুকানোর জন্য বেছে বেছে এই সুন্দর জায়গাটাই বেছে নিয়েছিলেন। এখানে বসলে মনের প্রশান্তি আর ধ্যানের মনোযোগ– দুটোই বৃদ্ধি পায়।

মিরিসায় আমরা রান্দিয়া হোটেলে থেকেছিলাম। কোকোনাট ট্রি হিল ও প্যারট রক থেকে একেবারে হাঁটাপথ। ওখানে বসে সূর্যাস্ত দেখে তো আমার নিজেকেই দুনিয়ার বাদশা মনে হয়েছিল।

বালুকাবেলায় প্রাতঃভ্রমণের পর পেটের খিদে মাথাচাড়া দিত, আর তখনই হোটেলের চমৎকার নাশতায় ভুরিভোজ হতো। লেখার মধ্যে যদিও মনে হচ্ছে, ঘটনাগুলো খুব তাড়াতাড়ি করে ঘটে গেছে— মুহূর্তগুলো কিন্তু সেভাবে কাটেনি। খুব আরাম করে, সতেজ হাওয়ায়, প্রাণের সংস্পর্শে এগিয়ে গেছে সময়।

আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল গওল। ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের এক গুপ্ত কুঠুরি। ২০০৪ সালের সুনামিতে বহু ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পরও গওল দুর্গের তেমন কিছুই হয়নি। এর পুরোনো প্রাচীর ছুঁয়ে হাঁটতে গিয়ে মনে হলো, টাইম ট্রাভেল করছি না তো! রাম্পার্ট স্ট্রিটের ডাচ ক্যাফের মতো দোকানগুলোতে ধোঁয়া ওঠা কফিকাপের সঙ্গে মুফতে ইতিহাসের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।

গওল থেকে হিক্কাদুয়ার পথে গাড়িতে করে যাবার পথে মনে হলো, এ যেন সত্যিকারের মেরিন ড্রাইভ। দেশে আমরা যেটিকে মেরিন ড্রাইভ বলি, তা এর ধারেকাছেও নেই। গাড়ি চলার রাস্তা যেন সত্যিই সাগরের সঙ্গে জড়াজড়ি করে আছে। এরই মধ্যে আমি বারবার ভাবনায় হারাচ্ছিলাম — আর ভাবছিলাম, শ্রীলঙ্কা এত সুন্দর কেন! আমি তো আগে কখনো কারো কাছে শুনিনি, এর সীমাহীন এই সৌন্দর্যের কথা! 

ফেরার পথে থামলা সুনামি মেমোরিয়াল বুদ্ধতে। এই মূর্তির উচ্চতার সমান এক ঢেউ আসায় ২০০৪ সালে ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। অদ্ভুত চুপচাপ এক মুহূর্ত ছিল এখানে। আমরা একটি চন্দ্রকান্তমণির খনি এবং দারুচিনির খামারেও গিয়েছিলাম। দুটোই আকারে ছোটখাটো, কিন্তু ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ।

কলোম্বো শহরে ঢুকে মনে হলো, ঢাকার কোনো শান্ত রূপের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। যতই বিমান বন্দরের কাছে এগোচ্ছিলাম, ততই স্কাইলাইন জুড়ে রং বদলানো লোটাস টাওয়ার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল। কলোম্বোর ট্রাফিক বেশ ভালোই ভোগায়, তাই বিকাল ৫টার পর বেরোলে অন্তত দুই ঘণ্টা আগে বিমান বন্দরের উদ্দেশে বেরোনোর চেষ্টা করবেন।

এত কথার পরও এটুকুই বলা যায় যে, শ্রীলঙ্কার মাধুর্য শব্দে বয়ান করা একটু মুশকিল। এ দেশ সম্পর্কে জানতে হলে, অনুভব করতে হলে সেখানে যেতে হবে। এবং অবশ্যই আগেভাগে ভালোমতো প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে ভ্রমণ আরো বিশেষ হয়ে ওঠে।

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

 

Comments

The Daily Star  | English
Exporters to get Tk 108.5 for a dollar from Aug 1

Taka gains against dollar after years

Taka gains ground as dollar influx rises, strengthening currency after years

1h ago