উত্তরাঞ্চলে তীব্র দাবদাহ

ভরা মৌসুমে খরা, দুশ্চিন্তায় কৃষক

দিনাজপুরসহ উত্তরের জেলাগুলোতে বইছে তীব্র দাবদাহ। ভরা বর্ষা মৌসুমে চলছে খরা। এসময় জেলাগুলোর ফসলি জমি পানিতে ভরপুর থাকার কথা থাকলেও বৃষ্টি না হওয়ায় জমি ফেটে চৌচির। ফলে, আমন আবাদ দিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষিনির্ভর এই জেলার কৃষকরা।
ছবিটি সম্প্রতি দিনাজপুর জেলার বিরলের কালিয়াগঞ্জ গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: কংকন কর্মকার

দিনাজপুরসহ উত্তরের জেলাগুলোতে বইছে তীব্র দাবদাহ। ভরা বর্ষা মৌসুমে চলছে খরা। এসময় জেলাগুলোর ফসলি জমি পানিতে ভরপুর থাকার কথা থাকলেও বৃষ্টি না হওয়ায় জমি ফেটে চৌচির। ফলে, আমন আবাদ দিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষিনির্ভর এই জেলার কৃষকরা।

এদিকে মৃদু তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকায় দাবদাহে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত কয়েকদিন ধরে দিনাজপুরে তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে।

তীব্র খরায় ফসলের খেত ফেটে চৌচির। ছবি: কংকন কর্মকার

৬ ঋতুর এই বাংলাদেশে আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস বর্ষাকাল। বর্ষাকালে ফসলি জমি থাকে পানিতে টইটম্বুর। আর জমির এই পানিকে কাজে লাগিয়ে আমন চাষ করেন কৃষক। কিন্তু, এবার তার চিত্র উল্টো। শুক্রবার আষাঢ় মাস শেষ হতে চললেও দিনাজপুরসহ এই অঞ্চলে বৃষ্টির অভাবে জমিতে কোনও পানি নেই। জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার আবাদি জমি ফেটে চৌচির। কোথাও কোথাও জমিতে চৈত্র মাসের মতো ধুলা উড়ছে। আমন চারার বয়স পেরিয়ে যেতে শুরু করলেও পানির অভাবে রোপণ করতে পারছেন না কৃষকরা।

জমিতে পানি না থাকায় বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করে এ পর্যন্ত দিনাজপুর জেলায় মোট লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬ শতাংশ জমিতে আমন রোপণ করতে পেরেছেন কৃষকরা।

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার হাসিলা গ্রামের আবেদ হোসেন জানান, আমন চারার বয়স পেরিয়ে গেলেও জমিতে পানি না থাকায় আমন রোপণ করতে পারছেন না তিনি। পরে বাধ্য হয়েই জমিতে সেচ দিয়ে আমন রোপণ শুরু করেছেন। এতে তাকে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মঞ্জুরুল হক জানান, দিনাজপুর জেলায় চলতি মৌসুমে ২ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য ১৩ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আমন রোপণ করা হয়েছে মাত্র ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ।

তিনি আরও জানান, বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। যদি এর মধ্যে বৃষ্টি না হয়, তাহলে সম্পূরক সেচ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

তবে কৃষকরা বলছেন, বৃষ্টি না হলে সেচের কারণে তাদের ধান উৎপাদন খরচ বাড়বে।

স্যালো মেশিনে ধানের খেতে সেচ দিচ্ছেন একজন কৃষক। ছবি: কংকন কর্মকার

দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন জানান, দিনাজপুরে সর্বশেষ গত ৩ জুলাই বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ১ মিলিমিটার। এরপর থেকে আর বৃষ্টির দেখা নেই। আগামী ১৮ জুলাইয়ের দিকে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। দিনাজপুরে গত বুধবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিনাজপুরে এটিই এই মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। আর বৃহস্পতিবার দিনাজপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৭ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আজ শুক্রবার ছিল ৩৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

রংপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে তীব্র দাবদাহে আবাদি জমি শুকিয়ে যাওয়ায় কৃষক গভীর নলকূপ দিয়ে সেচ দিয়ে জমি আবাদ করছেন। গত কয়েকদিন রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও মিঠাপুর এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। স্মরণকালের এমন গরমে মানুষসহ হাঁসফাঁস করছে পশু-পাখিও। বাড়ছে হিট স্ট্রোক, জ্বর, সর্দি, কাশি ও ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা আক্রান্ত হচ্ছেন।

এ অবস্থায় চিকিৎসকরা দাবদাহে প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছেন বিপাকে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালসহ জেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২ সপ্তাহে প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দিসহ মৌসুমি রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া, প্রতিদিনই কম-বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তীব্র গরমের কারণে নিম্ন আয়ের দিনমজুর, শ্রমিক, খেতমজুররা হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছে চিকিৎসকরা। শুধু তিন দিনেই রমেক হাসপাতালে ২৫ জনের বেশি রোগী হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন।

নগরীর স্টেশন রোডের দাবানল মোড়ে কথা হয় রিকশাচালক আশরাফ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'গরমে ঘরে থাকাও দায়। ফ্যানের বাতাসও গরম। শরীর থাকি খালি ঘাম ঝরছে। রোইদোত বাইরোত গাড়ি নিয়্যা ব্যারেয়া মোর অবস্থা তো খারাপ। কিন্তু, হামার মতো রিকশা এ্যলার কোনো উপায় নাই। গাড়ি না চালাইলে খামো কী?'

পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে আমন খেত ছবি: কংকন কর্মকার

নগরীর শাপলা চত্বরে ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে আসা মারুফা আক্তার বলেন, '২ দিন ধরে বাড়িতে বাচ্চাসহ ৪ জন অসুস্থ। প্রচণ্ড রোদ ও গরমে জ্বর-ব্যথায় সবাই কাবু।'

রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে রংপুর অঞ্চলে অস্বাভাবিক আবহাওয়া বিরাজ করছে। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ ও গরম বাতাসে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আজ শুক্রবার রংপুরে তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রির ওপরে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকলে ৩টা পর্যন্ত রংপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন বুধবার (১৩ জুলাই) রংপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়।

এ তাপমাত্রা বৃদ্ধি আরও ২-৩ দিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানান তিনি।

Comments