পৃথিবীতে কোনো অক্সিজেন না থাকলে যা হবে

ছবি: সংগৃহীত

অক্সিজেন ছাড়া মানুষের পক্ষে কয়েক মিনিটের বেশি বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। পৃথিবীটা মানুষের বাসযোগ্য হবার পেছনে অন্যতম কারণ এই অক্সিজেন। তবে, সারাক্ষণ অক্সিজেনের সমুদ্রে ডুবে থাকার কারণে আমরা ভুলে থাকি এর গুরুত্ব।

করোনা মহামারিতে কৃত্রিম অক্সিজেনের অভাবে বহু মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। বিশ্বব্যাপী অক্সিজেন সংকট দেখা দিলে বিভিন্ন দেশ তাদের তরুণদের বাঁচাতে বয়স্কদের অক্সিজেন ছাড়া মৃত্যুর কোলে ছেড়ে দেওয়ার মতো নির্মম কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। অক্সিজেনের অভাবে প্রাণ হারিয়ে এবং অক্সিজেনের কল্যাণে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে বেঁচে ফিরে এর মর্মার্থ কিছুটা হলেও মানুষ তখন উপলব্ধি করেছে।

ছবি: সংগৃহীত

সাউদার্ন ডেনমার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-রসায়নবিদ ডোনাল্ড ই. ক্যানফিল্ডের মতে, এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর মধ্যে এমন বায়বীয় অক্সিজেন শুধু পৃথিবীতেই পাওয়া যায়।

সহজলভ্যতার জন্যে অক্সিজেনের অনুপস্থিতির বিষয়টা উপলব্ধি করা যায় না। কয়েক ঘণ্টার জন্য আচমকা পৃথিবীর সব অক্সিজেন অদৃশ্য হয়ে গেলে, তখন কি শ্বাস ধরে রাখা যাবে? মানুষের পক্ষে কতক্ষণ শ্বাস না নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব? বায়ুমণ্ডলের কী হবে? পৃথিবীতে কতদিন অক্সিজেন থাকবে? অক্সিজেনহীন পৃথিবী টিকে থাকবে কি?

অক্সিজেন ছাড়া মানুষ কতক্ষণ বাঁচবে?

এসব কথা পড়তে পড়তে কয়েক দফা শ্বাস নেওয়া হয়ে গেছে। মানুষ যা শ্বাস নেয় তা হচ্ছে অক্সিজেন। প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি মানুষ অক্সিজেন নিচ্ছে। এই অক্সিজেন মানব শরীরের সমস্ত ক্রিয়া কার্যকর রাখতে খুবই প্রয়োজনীয়। এর অভাবে মানুষের শরীরের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে। মস্তিষ্কে প্রচণ্ড চাপ অনুভূত হয়। ঠিক যেমন মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণকারীরা অনুভব করেন।

অক্সিজেন ছাড়া মানুষের শরীর শুধু কয়েক মিনিট ঠিক থাকতে পারে। এরচেয়ে বেশি সময়ের অক্সিজেন শূন্যতায় মানবদেহের জৈবিক প্রক্রিয়াগুলো বন্ধ হয়ে যাবে, যা এর কোষগুলোকে শক্তি প্রদান করে থাকে। মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে শক্তি দেয় এমন বৈদ্যুতিক সংকেতগুলো কমে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।

ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথ ইউনিভার্সিটির এক্সট্রিম এনভায়রনমেন্ট ল্যাবরেটরির প্রধান মাইক টিপটন বলেন, 'অক্সিজেন শূন্যতার অর্থ হচ্ছে বেঁচে থাকার একদম শেষ সীমা। মানুষের শরীরে অক্সিজেনের বড় কোনো ভাণ্ডার নেই। মাত্র কয়েক লিটার সংরক্ষিত থাকতে পারে, এর বেশি না। তবে, তা মানুষ কীভাবে এই অক্সিজেন ব্যবহার করবে তা সম্পূর্ণরূপে মানবদেহের বিপাকীয় হারের ওপর নির্ভর করে।'

বিবিসির তথ্যসূত্রে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ গড়ে প্রতি মিনিটে এক লিটারের এক-চতুর্থাংশ বা এক-পঞ্চমাংশ অক্সিজেন গ্রহণ করে। তবে, কঠোর ব্যায়ামের সময় প্রতি মিনিটে এই অক্সিজেন গ্রহণের মাত্রা ৪ লিটার পর্যন্ত হতে পারে।

কিছু মানুষ আছে ব্যতিক্রম, যারা স্বাভাবিক মাত্রাকে অতিক্রম করে দীর্ঘ সময় ধরে তাদের শ্বাস ধরে রাখতে পারে, অর্থাৎ অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড-এর তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের মার্চ মাসে ক্রোয়েশীয় নাগরিক বুদিমির সোবাত তৎকালীন বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে ২৪ মিনিট ৩৭ দশমকি ৩৬ সেকেন্ড ধরে অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে থাকার রেকর্ড গড়েছে। 

যদিও এটা ছিল পানির নিচে। পানিতে মানুষ তুলনামূলক বেশিক্ষণ দম আটকে থাকতে পারে। কিন্তু, টানা এক ঘণ্টার জন্য যদি অক্সিজেন শূন্যতা দেখা দেয় তাহলে কোনো মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব।

ছবি: সংগৃহীত

অক্সিজেনের অভাবে কী হতে পারে?

সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে একটানা ৫-৬ মিনিটের মতো দম আটকে বা অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে। তবে, সবার পক্ষে এত দীর্ঘ সময় থাকা সম্ভব নাও হতে পারে। একজন ৮০ কেজি ওজনের মানুষ দিনে গড়ে ৫২ কেজি অক্সিজেন গ্রহণ করে। অক্সিজেনহীন অবস্থায় ৫ থেকে ৬ মিনিট পর মানুষের মস্তিষ্ক ইলেকট্রনিক সিগন্যাল পাবে না। ফলে, সারা শরীরে সিগন্যাল পাঠাতে পারবে না। 

অক্সিজেনের অভাবে ফুসফুস ও হৃদপিণ্ড অকার্যকর হতে শুরু করবে। শরীরের বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ঠিকভাবে কাজ করবে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে মস্তিষ্কে। এক ঘণ্টার মধ্যে মানবদেহের ৬৫ শতাংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। যদিও এর অনেক আগেই মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পেরে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে।

শুধু মানুষ নয়, এমন দীর্ঘ সময় অক্সিজেন না থাকলে সমস্ত পৃথিবীর চেহারা বদলে যাবে। বায়ুমণ্ডলের প্রায় ২১ শতাংশ হচ্ছে অক্সিজেন। পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব মেলার অন্যতম কারণ এই পদার্থ। তাই এই অক্সিজেনকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আজ গাছপালা, প্রাণী, জল এবং মানুষ অক্সিজেন ছাড়া যেখানে আছে সেখানে থাকা সম্ভব হতো না।

মানুষের পাশাপাশি অন্য প্রাণীর অস্তিত্বও সংকটে পড়ে যাবে। কেন না পৃথিবীর সব প্রাণী প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অক্সিজেনের ওপর নির্ভরশীল। অক্সিজেন ছাড়া কেবল ভাইরাস এবং এককোষী জীবাণু দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে। 

তবে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফির তথ্যসূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা ভূমধ্যসাগরে এমন এক জটিল প্রাণী আবিষ্কার করেছে যা অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে। সাম্প্রতিক এই গবেষণায় অভিযানে বিজ্ঞানীরা ৩টি নতুন প্রজাতির বহুকোষী প্রাণীর অস্তিত্ব পায়, যা ভূমধ্যসাগরের গভীরের অক্সিজেনবিহীন স্থানে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করে। 

তবে, তাদের ধারণা, এসব প্রাণী হয়তো উপরের অক্সিজেনে-ট অঞ্চল থেকে নিচে ডুবে গিয়েছে। এই নতুন প্রাণীগুলো মাইক্রোস্কোপিক-প্রত্যেকটি আকার এক মিলিমিটারেরও কম এবং তারা ছোট জেলিফিশের মতো। এরা ভূমধ্যসাগরীয় সমুদ্রতলের অত্যন্ত নোনতা পললগুলোতে ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই স্থানকে পৃথিবীর সবচেয়ে চরম পরিবেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বলা হয়।

ছবি: সংগৃহীত

অক্সিজেনহীনতার অন্যান্য প্রভাব

পৃথিবীর অধিকাংশ স্থাপত্য কনক্রিটে নির্মিত। অক্সিজেন চলে গেলে বিশ্বের আইকনিক স্থাপত্যগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। কনক্রিট এর ক্ষেত্রে অক্সিজেন একটি বিশেষ বাঁধাই এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। এটা ছাড়া, কংক্রিট শুধু ধুলোতে পরিণত হবে। ধসে পড়বে মানব সভ্যতার ঐতিহ্যের ধারক সব স্থাপত্য, আবাসস্থলসহ কনক্রিটের তৈরি সব কাঠামো। 

এ ছাড়া, যেকোনো অপরিশোধিত ধাতু একে অন্যের সঙ্গে মিশে যাবে। ধাতুগুলোতে অক্সিডেশনের একটি স্তর রয়েছে যা তাদের সংযুক্ত হতে বাধা দেয়। সেই স্তরটি ছাড়া, ধাতুগুলো অবিলম্বে একে অপরের সঙ্গে আবদ্ধ হবে। ভূমিতে অবস্থিত ধাতুর অবস্থা এমন হলেও শীর্ষে থাকা ধাতুর পরিণতি আরও ভয়াবহ হবে। 

অক্সিজেন ছাড়া গাছপালাও মরে যাবে। সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি থেকে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণকে সুরক্ষা দিতে বায়ুমণ্ডলে যে ওজন স্তর রয়েছে তা অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে তৈরি। অক্সিজেন ছাড়া ওজন স্তরের সুরক্ষা ভেঙে যাবে। পৃথিবীর আবহাওয়া অত্যন্ত গরম হয়ে উঠবে। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে প্রাণীকূলকে রক্ষা করার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না।

অক্সিজেন ছাড়া আগুন জ্বলবে না। খাদ্য-সংকটে পড়বে মানুষ। ওজন স্তর ভেঙে গেলে সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত পদার্থগুলো পৃথিবীতে আঘাত হানবে। কার্বন-ডাই অক্সাইড মিলবে না। গাছপালার সালোকসংশ্লেষণ হবে না। ফলে গাছ খাদ্য উৎপাদন করতে না পেরে শুকিয়ে মরে যাবে। 

এর পাশাপাশি পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে যাবে। বৈদ্যুতিক বাহন ছাড়া সব অচল হয়ে যাবে। আকাশ থেকে বিমান পড়ে যাবে, লাখ লাখ গাড়ি, জাহাজ অকেজো হয়ে যাবে। অক্সিজেনের অভাবে আকাশ অন্ধকার হয়ে যাবে। সমস্ত পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসবে।
 
পৃথিবীতে অক্সিজেন কি চিরন্তন?

পৃথিবী অমর নয়, এর একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমা রয়েছে। পৃথিবীর সব শক্তির উৎস সূর্য। ধীরে ধীরে সূর্য হাইড্রোজেনশূন্য হয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে সূর্যের পারমাণবিক ক্রিয়া, ক্রমশ এই দানবীয় গ্রহটি একটা লাল দানবে পরিণত হবে। অবশ্য এর অনেক আগেই পৃথিবী থেকে অক্সিজেন নির্মূল ও এর প্রভাবে প্রাণের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা যায়, অক্সিজেন সমৃদ্ধ এই পৃথিবী আর সর্বোচ্চ এক বিলিয়ন বছর টিকে থাকবে। সূর্যের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ভবিষ্যতে আরও বেশি উজ্জ্বল হবে আর পৃথিবী অধিক সৌরশক্তি লাভ করবে। 

এই বর্ধিত শক্তি পৃথিবীপৃষ্ঠকে প্রভাবিত করবে, বেসাল্ট এবং গ্রানাইটের মতো সিলিকেট শিলাগুলোর আবহাওয়াকে ত্বরান্বিত করবে। কার্বন ডাই অক্সাইডের অভাবে গাছ অক্সিজেন ও খাদ্য উৎপাদন করতে পারবে না। ধীরে ধীরে মানুষসহ সব প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

তথ্যসূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড, ন্যাচার, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ও হোয়াট ইফ

 

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

3h ago