গাছ যখন সিএফটির বিষয়, তখন গরম সইতেই হবে...
যেকোনো উন্নয়ন কাজ করতে গেলে প্রথম চোটেই গাছ কাটা শুরু হয়। কোন গাছটির বয়স কত; ওই জনপদের পরিবেশ ও প্রতিবেশে গাছটির গুরুত্ব কতখানি; গাছটি না কেটেই কাঙ্ক্ষিত অবকাঠামো উন্নয়ন করা যায় কি না কিংবা যে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য গাছগুলো কাটা হচ্ছে, মানুষের জন্য সেই উন্নয়ন আদৌ দরকার কি না—এসব ভাবনায় থাকে না।
প্রথম কারণ, সরকারি উন্নয়ন মানেই প্রকল্প। সেখানে অনেকগুলো পক্ষ জড়িত থাকে। অনেক টাকা-পয়সার লেনদেন থাকে। গাছও সেই প্রকল্প ও উন্নয়নের করাতে কাটা পড়ে।
পদ্মা সেতু চালুর পরে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ আরও সহজ হয়েছে। গাড়ির চাপ বেড়েছে। সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় ভিড় বেড়েছে। কিন্তু ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ও প্রশস্ত এক্সপ্রেসওয়ে থাকলেও এখান থেকে বরিশাল ও কুয়াকাটার সড়ক এখনো সিঙ্গেল লেন। অর্থাৎ মাঝখানে ডিভাইডারও নেই। কোনো যানবাহনই দ্রুত চলতে পারে না। কেউ দ্রুত যেতে চাইলে দুর্ঘটনায় পড়ে। রাস্তা এতই সরু যে দুটি গাড়ি পাস করতে চাইলে গাড়ির গতি কমাতে হয়। এরকম বাস্তবতায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার মানে নদী, খাল ও সবুজ প্রকৃতির জন্য খ্যাত বরিশাল অঞ্চলের কয়েক হাজার গাছ কাটা হবে রাস্তা প্রশস্ত করার নামে।
শতবর্ষী গাছ কাটার পরে হয়তো সরকারের তরফে বলা হবে, রাস্তার মাঝখানে ফুলের গাছ লাগানো হবে! রাজধানীর সাতমসজিদ রোডে ডিভাইডার বানানোর নামে যখন অসংখ্য বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হলো, তখনো সিটি করপোরেশনের তরফে এই একই কথা বলা হয়েছিল। অথচ একটি বড় গাছ না কেটেও যে চার লেনের রাস্তা বানানো যায় এবং পৃথিবীতে এর যে অসংখ্য উদাহরণ আছে, সেটি আমাদের 'প্রকল্পজীবীদের' মাথায় নেই অথবা থাকলেও তারা গাছ কাটাকেই সহজ তরিকা মনে করেন। কারণ তাতে বহুমুখী লাভ।
গাছ যখন নিতান্ত একটি গাছ হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন সে নিছকই অক্সিজেন ও ছায়াদানকারী একটি বস্তু—সরাসরি যার অবদানকে টাকায় হিসাব করা যায় না। অর্থাৎ তার কোনো আর্থিক মূল্য নেই। কিন্তু যখনই শতবর্ষী ওই গাছটিকে কাটা হবে, তখনই তার মূল্য হিসাব হবে সিএফটি (কিউবিক ফুট) অনুযায়ী।
গাছটি যদি সত্যিই শতবর্ষী হয়, গাছটি যদি সারি হয়, গাছটি যদি বিশালাকৃতির হয় তাহলে তার মূল্য লাখ টাকা। কিন্তু সে ওইখানে দাঁড়িয়ে থেকে শত বছর ধরে মানুষকে বিনা মূল্যে ও বিনা স্বার্থে অক্সিজেন ও ছায়া দিলেও মানুষ যেহেতু সরাসরি তার সেই অবদানকে টাকায় কনভার্ট করতে পারছে না এবং তার সেই মূল্যটা সাদা চোখে দেখছে না, অতএব ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে, রাস্তা বানাতে গিয়ে এমনকি টাকার প্রয়োজন হলেও সে নির্বিচারে ওই গাছের গোড়ায় করাত চালিয়ে দিচ্ছে।
অথচ নদী, খাল, জলাশয় ও পুকুর ভরাট করে এবং গাছ কেটে যেসব অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়, সেটি যে উন্নয়ন নয়—এই বোধটুকু দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং নীতিনির্ধারক তো বটেই, অনেক সময় সাধারণ মানুষের মধ্যেও দেখা যায় না। এই ধরনের উন্নয়ন যে কিছু মানুষের উন্নয়ন; প্রকৃতি ধ্বংস করে যেকোনো অবকাঠামো, সেটি হোক বাড়ি-ঘর, হাসপাতাল, শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, এমনকি সড়ক যোগাযোগ সহজ করার জন্য যে প্রশস্ত রাস্তা বানানো হয়, সেখানেও যদি নদী, খাল, জলাশয় ও বৃক্ষনিধন করা হয়, তাহলে দিন শেষে সেটিও যে কোনো উন্নয়ন নয়—এই উপলব্ধিটা খুব জরুরি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জনপরিসরে এই ধারণাটিই বদ্ধমূল করার চেষ্টা হয়েছে যে উন্নয়ন মানেই দৃশ্যমান অবকাঠামো। অথচ প্রকৃতিকে তার মতো রেখে, প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করার উপায় বের করাই যে আধুনিক উন্নয়ন মডেল—সেই পথে আমাদের ক্ষমতাবানরা হাঁটতে চান না। কেননা তারা প্রকল্প চান। প্রকল্প না হলে যেমন উন্নয়নকে দৃশ্যমান করা যায় না, তেমনি শত বা হাজার কোটি টাকা খরচ না হলে সেখান থেকে ভাগও পাওয়া যায় না।
উন্নয়নের নামে যখন একটি বড় গাছ কেটে ফেলা হয়, সেই গাছের ওপর নির্ভরশীল পাখিরা কোথায় যাবে—সেই ভাবনাটি বিবেচনায় রাখা দরকার। মানুষ শুধু নিজের জন্য বাঁচে। নিজের স্বার্থে অবকাঠামো গড়ে তোলে। অথচ পৃথিবীটা যে পশু-পাখি ও কীটপতঙ্গেরও; একটা চড়ুই পাখিও এই পৃথিবীর জন্য জরুরি এবং এখানে তাঁর বেঁচে থাকার যে অধিকার আছে, আত্মঘাতী উন্নয়ন সেই বোধটুকুও মানুষের মন থেকে মুছে দিয়েছে!
২২ এপ্রিল মানিকগঞ্জের সাংবাদিক সাইফুদ্দীন আহমেদ নান্নু ফেসবুকে কিছু বৃক্ষনিধনের ছবি দিয়ে লিখেছেন: 'দেশের ছোট, বড়, বৃক্ষনিধন মহাযজ্ঞের আগে খুব নিঃশব্দে বৃক্ষের মৃত্যুদণ্ডাদেশের সিদ্ধান্ত হয় বড় বড় রাজকর্মচারীদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস কক্ষে। মৃত্যুদণ্ডাদেশে সইও হয় সেই সব অফিসের চোখ ধাঁধানো টেবিলে। এদের কাছে ব্যক্তিমালিকানার জমিন ছাড়া দেশের প্রতি ইঞ্চি সরকারি জমিনে, রাস্তার পাশে কয়টা গাছ আছে, কী গাছ আছে, গাছের সাইজ কী, বয়স কত, সব হিসাব আছে। বিশ্বাস না হলে আপনি শহরে এক প্রান্তে আপনার বাড়ি লাগোয়া পতিত খাস জমিতে অথবা রাস্তার পাশে আপনার হাতেই লাগানো একটি বড়সড় গাছ কেটে দেখুন না, ২৪ ঘণ্টা পার হবার আগেই মামলা খাবেন। এদের হিসাব এমনই পাক্কা। এইসব উঁচু পদের রাজকর্মচারীরা সামান্য ছুতো পেলেই হলো। বৃক্ষ সাবার করে দেবে। যত নিধন তত কামাই। এরাই মূলত বৃক্ষখেকো রাক্ষস। এরা কুড়াল, করাত নিয়ে সামনে আসে না, কাগজ-কলমে মারে।'
মনে রাখা দরকার, একটি প্রাচীন গাছ কাটার বিনিময়ে একশটি গাছ লাগালেও ওই ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। কেননা, আজ যে গাছটি লাগানো হবে, মানুষকে ছায়া ও পর্যাপ্ত অক্সিজেন দেওয়ার উপযোগী হতে তার অন্তত ২০ বছর সময় লাগবে। সুতরাং মানুষ যে সাময়িক প্রয়োজন ও লোভে পড়ে প্রকৃতির অপার দান যে বৃক্ষরাজি উজাড় করে দিচ্ছে—তার পরিণতি সে টের পায় এপ্রিল-মে-জুন মাসে। তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষেরা তোলপাড় শুরু করে দেয়। আহা উহু করে। গরমে হাঁসফাঁস করে। স্বল্প আয়ের মানুষেরা ধারদেনা করে এসি কেনে। অথচ সেই এসি যে ঘরের গরম বাতাস বাইরে ছেড়ে দিয়ে প্রকৃতি আরও বেশি উত্তপ্ত করে; সেই এসির বিস্ফোরণে যে শত শত মানুষ প্রাণ হারায়—সেটিও মানুষ ভুলে যায়। কেননা গরম শেষে শীত এলে তারা গরমের কষ্ট ভুলে যায়। তারা নতুন ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
Comments