সার্জারি চলাকালে রোগীর আকস্মিক চেতনা ফিরলে কী ঘটে?
সার্জারি চলাকালীন আকস্মিক যদি আপনার চেতনা ফিরে আসে। চোখ খুলে দেখলেন ছুঁড়ি-কাঁচি দিয়ে চিকিৎসক আপনার শরীর ক্ষত-বিক্ষত করছেন, কিংবা আপনার গলার ভেতর একটা লম্বা নল ঢুকিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছেন। চেতনার সঙ্গে যদি অনুভূতিও ফিরে আসে? কি নির্মম সেই মুহূর্ত! নিজের চোখে নিজের শরীর কাটা-ছেঁড়া করতে দেখা আর সেই যন্ত্রণা অনুভব করা! বিভীষিকাময় এই বিষয়টা কল্পনা করাও দুরূহ কাজ।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা সার্জারি বা অস্ত্রোপচার। উনবিংশ শতকের আগে শুধু জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা মানুষকে অস্ত্রোপচারের মধ্যে দিয়ে যেতে হতো। চিকিৎসক তখন সচেতন রোগীর শরীরে অস্ত্র চালিয়ে কাটাছেঁড়া করতেন। সে কারণে অপারেশনকে তখন মৃত্যুসম কিংবা তারও অধিক যন্ত্রণাময় এক পদ্ধতি হিসেবে ভাবা হতো।
বর্তমানে প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার রোগী স্বেচ্ছায়, নির্বিঘ্নে অস্ত্রোপচার কক্ষে প্রবেশ করছেন। ২০২০ সালে মার্কিন ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে প্রকাশিত একটি জার্নাল থেকে জানা যায়, ২০১২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩১ কোটি অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হয়েছিল। বর্তমানের সংখ্যাটা আরও বেশি।
মানুষকে সুস্থ করে তুলতে জনপ্রিয় এই চিকিৎসা পদ্ধতির এমন বহুল ব্যবহার সম্ভব হয়েছে অ্যানেস্থেসিয়া আবিষ্কারের ফলে। সার্জারির আগে রোগীকে অপারেশনের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের অ্যানেস্থেসিয়া প্রদান করা হয়।
তবে, সার্জারি চলাকালীন আকস্মিক চেতনা ফিরে আসার ঘটনা বিরল নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ ধরনের ঘটনাকে বলা হয় অ্যানেস্থেসিয়া অ্যাওয়ারনেস। অর্থাৎ, সার্জারি চলাকালীন রোগীর অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে চেতনা ফিরে পাওয়া বা জেগে ওঠা।
আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব নার্স অ্যানেস্থলোজির ভাষায়, সাধারণ অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া রোগীর চেতনা ফিরে পাওয়া, তার পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো মনে রাখা, এমনকি ব্যথা বা চাপ অনুভব করা। এ ধরনের ঘটনা খুবই বিরল, তবে, অসম্ভব নয়।
অ্যানেস্থেসিয়া জার্নালের বরাত দিয়ে ২০১৪ সালের এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানায়, যুক্তরাজ্য-আয়ারল্যান্ডের প্রতি ১৯ হাজার ৬০০ রোগীর মধ্যে একজন রোগী এই বিরল ঘটনার শিকার হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১ হাজার সার্জিকাল রোগীর মধ্যে একজন এবং অনেক দেশে সংখ্যাটা আরও বেশি। অর্থাৎ, এই বিরল ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে বহু রোগীকে।
কিন্তু, অ্যানেস্থেসিয়া কাজ না করলে আসলে কি হয়? শরীরের সঙ্গে যা কিছু চলছে তা কি রোগী অনুভব করতে পারে? পরবর্তীতে এই অনুভূতি বা স্মৃতি কি মনে থাকে? সার্জারিতে কোনো জটিলতা দেখা দেয় কি? চেতনা ফিরে পাবার বিষয়টা সার্জনকে জানানো যায়? এসব বিষয় নিয়েই আজকের আলোচনা।
অ্যানেস্থেসিয়া
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উইলিয়াম মর্টন নামে এক তরুণ মার্কিন ডেন্টিস্ট অ্যানেস্থেসিয়া আবিষ্কার করেন। তিনি পরীক্ষা করে দেখেন, প্রাণীর ওপর ইথাইল ইথার প্রয়োগ করলে প্রাণীগুলো চেতনাহীন হয়ে পড়ে।
১৮৪৬ সালে ম্যাসাচুসেট জেনারেল হাসপাতালে এক তরুণ রোগীর ওপর প্রথমবার অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করে তার জিহ্বা থেকে একটা টিউমার কেটে ফেলা হয়। আশ্চর্যজনকভাবে, রোগী সেদিন কোনো নড়াচড়া বা প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
এরপর থেকেই অ্যানেস্থেসিয়া বহুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। সার্জারি হয়ে ওঠে চিকিৎসা শাস্ত্রের আশীর্বাদস্বরূপ। বর্তমানে ছোট-বড় সব ধরনের অপারেশনে বিভিন্ন ধরনের অ্যানেস্থেসিয়া ব্যবহার করা হয়। যার মধ্যে রিজিওনাল এবং লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দেহের নির্দিষ্ট অংশে প্রয়োগ করা হয়। এতে ওই অঙ্গ বা অংশটুকু অসাড় হয়ে গেলেও রোগী জেগে থাকে বা তার চেতনা থাকে।
অন্য অ্যানেস্থেসিয়ার মধ্যে আছে সিডেশন বা সাধারণ অ্যানেস্থেসিয়া। যা রুটিন কোলোনোস্কপি থেকে কোয়ার্ড্রুপল বাইপাস সার্জারির মতো অত্যন্ত জটিল ও চরম যন্ত্রণাদায়ক সার্জারি ও পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়। এটা প্রয়োগ করে রোগীকে সম্পূর্ণ অচেতন করে ফেলা হয়। তবে, এ ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রম ফল আসে। অ্যানেস্থেসিয়া অকেজো হয়ে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে রোগীর চেতনা ফিরে আসে।
চেতনা ফিরে আসলে কি হতে পারে?
এই ঘটনার শিকার অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে আংশিকভাবে চেতনা ফিরে পেতে দেখা যায়। যদিও, এ ঘটনায় সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যায়। যাদের অধিকাংশ শ্রবণশক্তি ফিরে পায়। আশেপাশের শব্দ শুনতে পায়। ডাক্তার-নার্সদের কথাবার্তা, এমনকি সার্জারির শব্দ, যন্ত্রপাতির বিপ শুনতে পায়। সার্জারি শেষ হয়েছে ভেবে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়, যখন ভুল ভেঙে যায় তখন রোগী আতঙ্কিত হতে শুরু করেন এবং উঠে বসার চেষ্টাও করতে চান।
মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো থাকে এবং দুর্বলতাসহ ওষুধের প্রভাবে কথা বলার শক্তি বা সমস্ত শরীর হয়তো নাড়াতে পারে না। কেবল হাত-পা নাড়াতে চায়। কিন্তু ডাক্তার বা নার্স সেই নড়াচড়াকে স্বাভাবিক পেশী সংকোচন ভেবে চেপে ধরে রাখতে পারেন।
যদি এটা হার্ট সার্জারির মতো ৩ থেকে ৬ ঘণ্টার দীর্ঘ কোনো অপারেশন হয় তাহলে রোগীর জন্য সেটা খুবই ভীতিকর এবং ক্ষতিকর হতে পারে। রোগী তার বুকের হাড় কেটে ফেলা কিংবা পাঁজরের খাঁচা খোলার শব্দ এমনকি যন্ত্রণাও অনুভব করতে পারেন। কিন্তু কিছু বলতে পারেন না।
দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মনে হলেও অক্সিজেন মাস্কের ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস চলমান থাকে, যন্ত্রের সাহায্যে হৃদযন্ত্র রক্ত চলাচল সচল থাকে। আদতে রোগীর শরীরের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণই থাকে না। শুধু দেখতে, শুনতে এবং অনেক সময় এই চরম মুহূর্তগুলো অনুভব করতে পারেন।
প্রভাব
সিএনএন সূত্রে জানা যায়, রোগীরা শ্বাসরোধ, পক্ষাঘাত, ব্যথা, হ্যালুসিনেশন এবং মৃত্যুর কাছাকাছি ধরনের অভিজ্ঞতাসহ বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। অধিকাংশ স্বল্পস্থায়ী, যার মধ্যে ৭৫ শতাংশ ৫ মিনিটের কম সময়ের জন্যে চেতনা ফিরে পায়।
বিবিসির তথ্যসূত্রে, অ্যানেস্থেসিয়া অ্যাওয়ারনেসের শিকার হওয়া ৩০০ রোগীর মধ্যে কিছু মানুষ সার্জারিকালীন চেতনা ফিরে পাবার স্মৃতি পরে মনে করতে পেরেছেন। যাদের মধ্যে বেশিরভাগ জানান, এই ঘটনা ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী, যা সার্জারির আগে বা শেষ হবার পরে ঘটেছে।
তবে, সিএনএন-এর প্রতিবেদন সূত্রে, সার্জারিকালীন চেতনা ফিরে পাওয়াদের অর্ধেকের বেশি দীর্ঘকালীন মানসিক বিষণ্নতা যেমন, পিটিএসডি বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভোগে। সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থাটা হচ্ছে প্যারালাইসিসের শিকার হওয়া।
এই বিষয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের অ্যানেস্থলজিস্ট প্রফেসর জয়দীপ পণ্ডিত বলেছেন, 'এমন ঘটনার সময় যে উপসর্গগুলো দেখা গেছে সেগুলোর মধ্যে, প্যারালাইসিসের লক্ষণ রোগীদের জন্য সবচেয়ে কষ্টকর, যা ব্যথার চেয়েও মর্মান্তিক। প্যারালাইসিস খুবই ভয়ঙ্কর পরিণতি। তবে খুবই কম ভুক্তভোগী এমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে থাকেন।
এটা কেন হয়?
কিছু নির্দিষ্ট কারণে অ্যানেস্থেসিয়া অ্যাওয়ারনেস-এর মতো বিরল ঘটনা ঘটতে পারে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় অপর্যাপ্ত অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ। সিজার বা হাইপোভোলেমিক রোগীদের বা ন্যূনতম কার্ডিয়াক রিজার্ভ রোগীদের ক্ষেত্রে হালকা অ্যানেস্থেসিয়া প্রদান করা হয়ে থাকে। তখন এমন ঘটনা ঘটতে পারে।
বিবিসির মতে, অস্ত্রোপচারের সময় পেশী শিথিলের ওষুধ ব্যবহার করা হলে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে সার্জারিকালীন চেতনা ফিরে পাওয়া ঘটনা ঘটে।
এ ছাড়া অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটে অ্যানেস্থেসিয়ার তীব্রতা কমে যেতে পারে।
সিজারিয়ান রোগীর ক্ষেত্রে বাচ্চাকে জাগিয়ে রাখতে বাচ্চার মা'কে কম মাত্রার অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করা হয়। এ ছাড়া, স্থূলাকার ব্যক্তির হার্টের বা ফুসফুসের সার্জারির ক্ষেত্রে অ্যানেস্থেসিয়া কম কাজ করতে পারে। একই ঘটনা ঘটতে পারে অতিরিক্ত ওষুধ সেবনকারী বা মাদকসেবীদের ক্ষেত্রেও। যাদের ক্ষেত্রে এর পরিণতি তীব্র হতে পারে।
তবে, এমন ঘটনা খুব বিরল। অ্যানেস্থেসিয়া মানবজাতির জন্যে আশীর্বাদস্বরূপ। প্রায় ২০০ বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষার্থে ব্যবহৃত এই পদ্ধতিকে অত্যন্ত নিরাপদ হিসেবেই বিবেচনা করা হয় এবং একে মানব ইতিহাসের অন্যতম সেরা আবিষ্কার হিসেবেই ধরা হয়।
তথ্যসূত্র:
বিবিসি, সিএনএন, আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব নার্স অ্যানেস্থলোজি, সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলোজি, হোয়াট ইফ।
Comments