বাংলাদেশে নাটকের পথিকৃৎ আবদুল্লাহ আল-মামুন

আবদুল্লাহ আল-মামুন। ছবি: সংগৃহীত

আবদুল্লাহ আলম-মামুন বাংলাদেশের খ্যাতিমান নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, চলচ্চিত্রকার ও অভিনেতা।

দেশে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরুর সময় থেকেই তিনি নাটকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

বাংলাদেশে টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে কালজয়ী নাটক হিসেবে খ্যাতি পাওয়া ধারাবাহিক ‘সংশপ্তক’র পরিচালক তিনি।

‘সারেং বউ’র মতো সাড়া জাগোনো সিনেমার পরিচালকও তিনি।

রাজ্জাক, শাবানা ও ফারুককে নিয়ে তিনি পরিচালনা করেছিলেন ‘সখী তুমি কার’ সিনেমা। আফজাল হোসেন, দিতি ও কবরী–বুলবুল আহমেদকে নিয়ে পরিচালনা করেছিলেন ‘দুই জীবন’ সিনেমাটি।

ঢাকার মঞ্চে তার অবদান অকাশচুম্বী। তিনি অসংখ্য নাটক লিখে গেছেন মঞ্চের জন্যে, দীর্ঘদিন অভিনয়ও করেছেন মঞ্চে।

ঢাকার নামি মঞ্চ নাটকের দল ‘থিয়েটার’র অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন আবদুল্লাহ আল-মামুন। তার লেখা মঞ্চ নাটক ‘সুবচন নির্বাসনে’ সারা দেশে মঞ্চায়িত হয়েছে।

মঞ্চে তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ‘মেরাজ ফকিরের মা’, ‘কোকিলারা’, ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘মেহেরজান আরেকবার’, ‘এখনো ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই’, ইত্যাদি।

এ দেশে প্রতিদিনের ধারাবাহিক নাটকের সূচনা তার হাত ধরে।

অভিনয় শিল্পের প্রতিটি শাখায় তার বিচরণ ছিল। অনেক শিল্পী তার হাত ধরে উঠে এসেছেন।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন একুশে পদক। নাট্যকার হিসেবে তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার।

আজ ১৩ জুলাই আবদুল্লাহ আল-মামুন এর জন্মদিন।

তাকে নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের কাছে স্মৃতিচারণ করেছেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার ও মামুনুর রশীদ।

রামেন্দু মজুমদার: যতদিন বাংলাদেশের নাটক থাকবে ততদিন আবদুল্লাহ আল-মামুন থাকবেন

আবদুল্লাহ আল-মামুন টেলিভিশন ও মঞ্চের জন্য নাটক লিখতেন। ডিরেকশন দিতেন। সিনেমা পরিচালনা করতেন। তাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মামুন, আপনি  কোন পরিচয়ে পরিচিতি হতে চান? জবাবে মামুন বলেছিলেন, নাট্যকার।

প্রচুর নাটক লিখেছেন একজীবনে মামুন। খুব দ্রুত নাটক লেখার ক্ষমতা ছিল তার। মনে পড়ে, একবার আমাকে বলেছিলেন একরাতে একটি নাটক লিখেছিলেন। এটা সবার পক্ষে সম্ভব না। মেধার সঙ্গে তার ছিল পরিশ্রম করার মানসিকতা।

মঞ্চে তার অবদান বিশাল। মঞ্চের জন্য একটার পর একটা নাটক লিখে গেছেন। সেসব নাটক আলোচিত হয়েছে। প্রশংসা পেয়েছে। দর্শকরা আগ্রহ ভরে তার নাটকগুলো দেখেছেন।

টেলিভিশন নাটকের উত্থান আবদুল্লাহ আল-মামুনের হাত ধরে। এ দেশের টেলিভিশন নাটককে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। টেলিভিশন নাটককে একটি বড় গাছে রূপান্তরিত করেছেন। তার হাত ধরে টেলিভিশন নাটক দর্শকদের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

এ দেশে প্রথম প্রতিদিনের ধারাবাহিকের শুরু তার হাত ধরে। কত বড় স্বপ্ন থেকে এই কাজটি করা যেতে পারে তা স্বপ্নবাজ না হলে সম্ভব হতো না। এখানেও মামুন সফল হয়েছিলেন।

সিনেমার প্রতিও তার ছিল অনেক প্রেম। সেজন্য মাঝে মাঝে সিনেমা পরিচালনা করতেন। ‘সারেং বউ’ পরিচালনা করে তিনি বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে অংশ হয়ে আছেন। এটি মামুনকে অমর করে রেখেছে।

তার কাজগুলো তাকে বাঁচিয়ে রাখবে বহুকাল। তার পরিচালিত ‘সংশপ্তক’ দেখে বিস্মিত হই। তখন তো প্রযুক্তির এত উন্নয়ন ছিল না। তারপরও তিনি ‘সংশপ্তক’ কী চমৎকারভাবে নির্মাণ করেছেন। এখানেই মামুনের সাফল্য।

বাংলাদেশের নাটক যতদিন থাকবে আবদুল্লাহ আল-মামুন ততদিন থাকবেন। তার সৃষ্টির মৃত্যু নেই।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আজ মামুনের জন্মদিন, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছি না। করোনা মহামারি না থাকলে অবশ্যই গ্রুপের পক্ষ থেকে বড় আয়োজন করা হতো। আজ নীরবেই তাকে স্মরণ করব আমরা। নীরবেই পালন করব তার জন্মদিন।

ফেরদৌসী মজুমদার: তার শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়, কেননা আবদুল্লাহ আল-মামুন একজনই

আমি আবদুল্লাহ আল-মামুনের হাতে গড়া শিল্পী। তিনি না থাকলে হয়ত আমার মঞ্চে কাজ করা হতো না। তিনি মঞ্চের জন্যে যে উৎসাহ দিতেন তা একজন শিল্পীর জন্য খুবই দরকার।

‘মেরাজ ফকিরের মা’ মঞ্চ নাটকটিতে আমি মাতবরের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। ওই কাজটি করতে পারব বলে মনে হচ্ছিল না। তিনি বলেছিলেন, আপনাকে পারতেই হবে। এটা তো সবাই বলতে পারেন না। এভাবে বললে শিল্পীর উৎসাহ অনেকখানি বেড়ে যায়।

মঞ্চের জন্য তিনি লিখলেন ‘কোকিলারা’। এটি বাংলাদেশের মঞ্চে প্রথম একক অভিনয়ের নাটক। ‘কোকিলারা’র সময়সীমা সোয়া দুই ঘণ্টা। একজন শিল্পী এই দীর্ঘ সময় টানা মঞ্চে থাকবেন, এতো কঠিন বিষয়। অনেক চ্যালেঞ্জিং।

তাছাড়া ‘কোকিলারা’ নাটকটিতে ১৭ থেকে ১৮টি চরিত্র। সব একা একা করতে হয়।

নাটকটি লেখার পর আবদুল্লাহ আল-মামুন আমাকে বললেন, ‘এটা আপনাকেই করতে হবে।’

আমি বললাম, ‘কিভাবে সম্ভব?’ তিনি বললেন, ‘সম্ভব।’ আমি বললাম, ‘পারব না।’ তিনি বললেন, ‘পারতেই হবে।’

সংলাপ মুখস্থ করার জন্য আমি সময় চাইলাম। আমাকে তিনি এক মাস সময় দিতে চাইলেন। আমি বললাম, ‘এক মাসে হবে না।’

তিনি দুই মাস সময় দিতে চাইলেন। আমি তাতেও রাজি হলাম না।

শেষে বললেন, ‘যতদিন লাগুক সংলাপ মুখস্থ করেন। তবুও আপনাকেই কাজটি করতে হবে।’

শেষে ‘কোকিলারা’ নাটকটির সংলাপ মুখস্থ করি। আসলে আমি নাট্যকারের সংলাপের প্রতি এতটাই বিশ্বস্ত যে, সংলাপ মুখস্থ না করে কোনো নাটক করি না।

তারপর ‘কোকিলারা’য় অভিনয় করলাম। অনেক প্রশংসা পেয়েছি। কিন্তু, আবদুল্লাহ আল-মামুন প্রশংসা খুব কম করতেন। একদিন তিনিও কাজটির প্রশংসা করলেন।

এই মানুষটি আমাকে ভেবে কিংবা আমাকে ধরে নাটক লিখতেন। সংলাপের ওপর তার বিশাল দখল ছিল। সহজ ভাষায় লিখতেন। তার লেখা নাটক এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রদর্শিত হয়েছে। সবখানেই তার নাটক প্রশংসিত হয়েছে।

‘কোকিলারা’ ছাড়া তার আরেকটি কাজের কথা বলতেই হয়। সেটি হচ্ছে ‘সংশপ্তক’। যেখানে হুরমতি চরিত্রে অভিনয় করে আমি অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছি।

‘সংশপ্তক’-এ অভিনয় করার আগে সুবর্ণা মুস্তাফা, হুমায়ুন ফরীদি ও আমি মহড়ায় অংশ নিতাম। আরও অনেকেই নিতেন। মহড়ার সময় সব সংলাপ মুখস্থ করে নিয়েছি। আমি মনে করি, নাট্যকারের সংলাপ মুখস্থ করা প্রতিটি শিল্পীর নৈতিক দায়িত্ব।

মহড়ার সময়ে দেখতাম তিনি কতটা কাজ ভালোবাসা একজন মানুষ। কাজই ছিল তার সব। ‘সংশপ্তক’ এ ধরে ধরে সব শিল্পীকে তিনি অভিনয় করিয়েছিলেন।

তার আরও অনেক কাজ আমি করেছি।

তিনি চলে গেলেন। নাট্যকার ও পরিচালক অনেকেই আসছেন। কিন্তু, আবদুল্লাহ আল-মামুন এর শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। কেননা, আবদুল্লাহ আল-মামুন একজনই।

মামুনুর রশীদ: টেলিভিশন নাটককে আধুনিক করার ক্ষেত্রে আবদু্ল্লাহ আল-মামুনের ভূমিকা অনেক

১৯৬০ ও ৭০ এর দশকে আবদুল্লাহ আল-মামুন একটি আলোচিত নাম। নাট্যকার ও টেলিভিশন প্রযোজক হিসেবে সেই সময়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি। টেলিভিশনে ওই সময়ে অনেক উন্নতমানের নাটক রচনা ও প্রযোজনা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আবদুল্লাহ আল-মামুন।

১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে এ দেশে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়। তখন টেলিভিশন নাটকের চিত্রনাট্য কেমন হবে তা নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় ছিলেন। অনেকে ভাবছিলেন, সেটা কি সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো হবে?

যাই হোক, শেষে আবদুল্লাহ আল-মামুন মধ্যপন্থা অবলম্বন করে চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। পরে সেভাবেই তার পথচলা অব্যাহত ছিল।

আবদুল্লাহ আল-মামুন ছিলেন দুঃসাহসী মানুষ। কারণ— বড় বড় কাজ করতে তিনি ভয় পেতেন না। যেমন: শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৬৯ সালে তিনি শুরু করেন টেলিভিশনের জন্য নাটকের কাজ।

১৯৬৯ সালে নাট্যরূপ দেওয়ার জন্য আমিও ‘সংশপ্তক’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।

সেসময়ে ‘সংশপ্তক’-এর অভিনয়ে ছিলেন কবরী, রোজী সামাদ, এটিএম শামসুজ্জামান, বুলবুল আহমেদ প্রমুখ।

আমি নাট্যকার হিসেবে তখন শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতাম। কিছু নাট্যরূপ দিতাম এবং তা দেখিয়ে নিয়ে আসতাম শহীদুল্লাহ কায়সারকে।

যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কাজটি আর এগোয়নি।

আবার ১৯৮৫ সালে আবদুল্লাহ আল-মামুন ‘সংশপ্তক’ নাটকটি শুরু করেন। সফলতাও পান। অনেক জেদি মানুষ ছিলেন তিনি। এজন্যই অনেক পরে এসেও ‘সংশপ্তক’ নতুন করে করতে পেরেছিলেন, যা তাকে অমর করে রাখবে।

টেলিভিশনেও খুব সফল মানুষ ছিলেন আবদুল্লাহ আল-মামুন।

সিনেমায় ‘সারেং বউ’ তার কালজয়ী সৃষ্টি। মঞ্চে তার অবদান ব্যাপক।

বাংলাদেশের নাটককে জনপ্রিয় করার জন্য তার ভূমিকা অনেক। নাটকে রুচিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।

সেসময়ে তিনি না এলে নাটকে অতটা আধুনিকতা আসত না। এখানেই তিনি অনন্য।

Comments

The Daily Star  | English

Tax authority to split. Will it bring the desired outcome?

Touted as a historic overhaul, the move has ignited debate over whether it will drive meaningful reform or merely deepen the layers of bureaucracy, given the NBR's persistent failure to meet its targets.

14h ago