সাইবার অপরাধের বিবর্তন: বরাবরই ভুক্তভোগী নারী

২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তরের সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন (পিসিএসডব্লিউ) উইং প্রায় ৪ হাজার ৯৪টি সাইবার অপরাধের অভিযোগ পেয়েছে।
প্রতীকী ছবি

২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তরের সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন (পিসিএসডব্লিউ) উইং প্রায় ৪ হাজার ৯৪টি সাইবার অপরাধের অভিযোগ পেয়েছে।

ডেটাবেস অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত এই অভিযোগের সংখ্যা ছিল অন্তত ১২ হাজার ৬৪১।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সাইবার লাইন পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের প্রায় ৭৯ শতাংশই সাইবার অপরাধের শিকার হন।

সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন উইংয়ের তত্ত্বাবধায়নে আছেন পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মীর আবু তৌহিদ। তিনি বলেন, 'পিসিএসডব্লিউ উইংয়ে এখন আমরা কেবল প্রকৃত অভিযোগ পাচ্ছি। এর আগে বেশকিছু ফলস অ্যালার্ম ছিল। এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে এই বিষয়ে সচেতনতাও তৈরি করা হচ্ছে।'

সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে বেশ কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম ও নির্ধারিত ইউনিট থাকা সত্ত্বেও সাইবার স্পেসে ব্ল্যাকমেইল ও নিপীড়নের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, যেখানে বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই নারী ও শিশু।

অভিযোগগুলো অমীমাংসিতই থেকে যায়

গত জানুয়ারিতে সুমাইয়ার (ছদ্মনাম) ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয়।

হ্যাকার তার বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক টেক্সট পাঠায়, টাকা চায়। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করে তিনি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

এমনকি তিনি পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন উইংয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু, কোনো সমাধান হয়নি।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আইন প্রয়োগকারীদের কাছ থেকে আমি ইতিবাচক কোনো সমর্থন পাইনি।'

এ ধরনের ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। সাইবার লাইনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সাইবার অপরাধের শিকার প্রায় ৮৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ নারীর অভিযোগ এখনো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।

গত ২৫ মার্চ ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১ হাজার ২৮০ জন ফেসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়।

সাইবার লাইনের সার্ভে অ্যান্ড অ্যানালাইসিস বিভাগের প্রধান শাহরিয়ার সিদ্দিক শাওন বলেন, 'সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি ডেডিকেটেড ইউনিট রয়েছে। কিন্তু, তারা প্রায়শই সমস্যাগুলো সমাধান করতে খুব বেশি সময় নেয়। নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে সাধারণত ভুক্তভোগীদেরই দোষারোপ করা হয়। ফলে ভুক্তভোগীর পরিবারও অনেক সময় তাকে সমর্থন করে না।'

এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্রুত উদ্যোগ নিশ্চিত, সাইবার ক্রাইম ইউনিটগুলোতে সহজে প্রবেশাধিকার ও পরিবারের সচেতনতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন শাহরিয়ার সিদ্দিক শাওন।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, 'সাইবার অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের সমর্থন দিতে থানায় প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকবল না থাকায় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দায়ের করতে উৎসাহ বোধ করেন না।'

'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ধরনের ঘটনা মোকাবিলায় দক্ষতা বাড়ানোর জন্য যথাযথ মনিটরিং ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে', বলেন তিনি।

তবে, এআইজি মীর আবু তৌহিদ বলেন, 'যখনই এ ধরনের অভিযোগ আসে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব সময় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করে।'

'সাইবার অপরাধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আমরা বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার, সরকার ও এনজিওর সঙ্গে যৌথভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি', বলেন এআইজি।

ভুক্তভোগীদেরকে প্রতিটি থানায় নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য থাকা বিশেষ ডেস্কে যোগাযোগের পরামর্শও দেন তিনি।

পারিবারিক চাপ?

দেশে সাইবার অপরাধের বর্তমান পরিস্থিতি নারীদের জন্য ভয়ংকর হলেও বাস্তবতা এখনো ভিন্ন।

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা বিশ্লেষণে সাইবার অপরাধের নতুন ধরন লক্ষ্য করা গেছে। বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী নারী অনলাইনে পরিবারের সদস্যদের দ্বারাই হয়রানির শিকার হয়েছেন।

গত জানুয়ারিতে ১৬ বছর বয়সী পাপিয়া (ছদ্মনাম) জানতে পারে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে কিছু আপত্তিকর ছবি এডিট করে তার চেহারা বসিয়ে পোস্ট করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর সামাজিক ট্যাবুর কারণে তার পরিবারকে প্রায় একঘরে করে দেওয়া হয়েছিল।

এরপর পাপিয়ার পরিবার স্থানীয় পুলিশ স্টেশন ও সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন উইংয়ে যোগাযোগ করে। এ ঘটনার তদন্তকালে সাইবার সাপোর্ট উইং জানতে পারে, পাপিয়ার এক চাচাত ভাই সেই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এসব ছবি পোস্ট করছিলেন।

সাইবার ও স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নুসরাত জাহান মুক্তা বলেন, 'ভুক্তভোগীদের প্রথমে পরিবারের সঙ্গে বিষয়গুলো শেয়ার করতে হবে এবং তারপর স্থানীয় পুলিশের কাছে সহায়তা চাইতে হবে।'

এ বিষয়ে কাজ করা পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।

অনেক অপরাধই থেকে যায় অপ্রকাশিত

সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন উইংয়ের ডেটাবেস অনুসারে, প্রায় ৫ হাজার ২৯৮ জন নারী ভুক্তভোগী কোনো উদ্যোগ নেননি বা শুরুতে জানালেও পরে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিস্তারিত তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দেন।

নীলার (ছদ্মনাম) সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত এক প্রবাসীর পরিচয় হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

তারা ব্যক্তিগতভাবে বিয়েও করেন। কিন্তু, পরে দেখা যায়, নীলা যা ভেবেছিলেন, বাস্তবতা তা নয়। শিগগিরই নীলা টের পেলেন তার স্বামীর অন্য একটি সম্পর্ক রয়েছে এবং নীলা তাকে ডিভোর্স দেন।

এরপর নীলার প্রাক্তন স্বামী তার নাম দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলেন এবং সেখানে নীলার ব্যক্তিগত ছবি পোস্ট করতে শুরু করেন।

তবে, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে নীলা এ ঘটনায় কোনো মামলা দায়ের করেননি, কেবল একটি জিডি করেন।

এরপর ওই ব্যক্তিকে আটক করে 'ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ করবে না' লেখা কাগজে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এআইজি মীর আবু তৌহিদ বলেন, এ ধরনের অপরাধ বন্ধে ভুক্তভোগীদের কথা বলতে হবে।

কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের রিসার্চ সেলের আহ্বায়ক মনিরা নাজমি জাহান বলেন, 'বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী নারীরা শুধু সমস্যার সমাধান চায়। কিন্তু তারা বিস্তারিত তথ্য শেয়ার করতে চায় না। এমনকি কোনো আইনি ব্যবস্থাও নিতে চায় না।'

ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র এই লেকচারার আরও বলেন, 'ভুক্তভোগীকে দোষারোপের সংস্কৃতির কারণে তারা এসব বিষয় শেয়ার করতে চায় না। কারণ, অপরাধী যে-ই হোক না কেন, দায় শুধু নারীদের ওপরেই পড়বে। এ কারণেই সাইবার স্পেসে সহজেই নারীদেরকে টার্গেট করা যায়।'

অনলাইনে কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার না করার পরামর্শ দিয়ে পরিবারকেও ভুক্তভোগীকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে বলেও উল্লেখ করেন মনিরা নাজমি জাহান।

'পরিবারের সমর্থন ছাড়া একজন নারী কখনোই দীর্ঘ সময় ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে পারে না', যোগ করেন তিনি।

Comments