এখন আর ‘সবার জন্য উন্মুক্ত নয়’ গুলিস্তানের শহীদ মতিউর পার্ক

পরিবারের সঙ্গে আনন্দদায়ক সময় কাটাতে সম্প্রতি ৩ সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর গুলিস্তানের শহীদ মতিউর পার্কে যান মহরম আলী। কিন্তু, পার্কের প্রবেশপথ পর্যন্ত গিয়ে তারা প্রথমে বিভ্রান্তিতে ও পরে হতাশ হয়ে পড়েন।

পার্কের প্রবেশপথে তাদের বাধা দেন একজন নিরাপত্তাকর্মী, যিনি মাথাপিছু ১০ টাকা করে ৪ জনের জন্য ৪০ টাকা চান। কিন্তু, তাদের কাছে একটি পাবলিক ও উন্মুক্ত পার্কে প্রবেশের জন্য টিকিট কেনার বিষয়টি একেবারেই অজানা ছিল। সাধারণত পাবলিক ও উন্মুক্ত পার্কের জন্য টিকিট কেনার নিয়ম থাকার কথা নয়।

মহরম বলছিলেন, 'আমি ভাবিনি যে তারা পার্কে প্রবেশের জন্য টাকা চাইবে। এটা ঠিক নয়। কোনো ধরনের প্রবেশমূল্য ছাড়াই পার্ক সবার জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিত।'

স্থানীয় আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের কাছ থেকেও একই মত পেয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক।

গত ৩ মাস ধরে এই পার্কে প্রবেশের জন্য সবাইকে টিকিট কাটতে হচ্ছে। কিন্তু, কেন? ধানমন্ডি লেক, রমনা পার্ক ও চন্দ্রিমা উদ্যান যখন সবার জন্য উন্মুক্ত, তখন শহীদ মতিউর পার্কের দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া কতটা যৌক্তিক?

৩ মাস আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) পার্কটি একটি ফার্মকে ইজারা দেয়, যারা এখন পার্কটির রক্ষণাবেক্ষণ করছে এবং দর্শনার্থীদের কাছ থেকে প্রবেশমূল্য জনপ্রতি ১০ টাকা করে নিচ্ছে।

ইজারাদাররা পার্কটির ভেতরে একাধিক রাইড স্থাপন করেছে এবং আরও কয়েকটি রাইড শিগগিরই স্থাপন করা হবে।

২০১৭ সালে ডিএসসিসি এলাকার ১৯টি পার্ক ও ১২টি খেলার মাঠ সংস্কারের জন্য নেওয়া 'জলসবুজের ঢাকা' প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে অনেক পার্ক খুলে দেওয়া হয়েছে।

৭০ জন স্থপতির মাধ্যমে প্রস্তুত করা এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল পার্ক ও খেলার মাঠগুলোকে সুন্দর, সবুজ ও উন্মুক্ত করে তোলা।

কিন্তু টিকিটের ব্যবস্থার সঙ্গে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ বাদ দিয়ে, একটি পার্ক কতটা উন্মুক্ত হতে পারে?

এর আগে ৯ কোটি টাকা ব্যয় করে ডিএসসিসি শহীদ মতিউর পার্ক সংস্কার করার পর ২০২০ সালে তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়।

সংস্কারকাজের অংশ হিসেবে লোহার বেড়া সরিয়ে দিয়ে জায়গাটিকে একটি খোলা চেহারা দেওয়ার জন্য ছোট করে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, 'ভাসমান মানুষের হাত থেকে রক্ষা' করতে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে প্রায় ৮০ লাখ টাকা ব্যয় করে পার্কের সীমানায় আবার বেড়া দেয় সিটি করপোরেশন।

পার্ক ও খেলার মাঠ সংস্কারের সময় সেগুলোকে সব দিক থেকে উন্মুক্ত রাখার পরিকল্পনা নিয়ে এগোলেও শহীদ মতিউর পার্কটির ক্ষেত্রে তারা এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

প্রকল্পের টিম লিডার ও সাতত্যের প্রধান স্থপতি মো. রফিক আজম জানান, তার অজান্তেই শহীদ মতিউর পার্কে প্রবেশে টিকিট ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মানুষকে যদি পার্কে প্রবেশের জন্য টিকিট কাটতে হয়, তাহলে তো সব কিছুই ব্যবসার মতো চলবে।

'আমরা চাই উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, পার্ক, পুকুর ও ঘাট সব দর্শনার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে করা হোক। এটি একটি কল্যাণভিত্তিক সমাজের আদর্শ চিত্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমরা এখন তা দেখতে পাচ্ছি না', বলেন তিনি।

shaheed-matiur-park-1.jpg

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সচিব ইকবাল হাবিব বলেন, 'কর ব্যবহার করে জনসাধারণের সুযোগ-সুবিধা ও সেবা প্রদান করার কথা ডিএসসিসির। ইজারাদার কর্তৃক পাবলিক স্পেস ব্যবহার করে "অর্থ আত্মসাৎ" করা অন্যায় ও অযৌক্তিক।'

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, 'টিকিট ব্যবস্থা চালু হলে পার্ক, উদ্যান বা পাবলিক স্পেসের প্রকৃতি পুরোপুরি বদলে যায়। জনসাধারণ ইতোমধ্যে এই ধরনের স্থানের অভাবে ভুগছেন। সুতরাং, টিকিট ব্যবস্থার মাধ্যমে জনসাধারণকে সীমাবদ্ধ করার কোনো সুযোগ নেই।'

তিনি বলেন, 'যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার অজুহাতে পার্ক বা খেলার মাঠ ইজারা দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমরা এই ধরনের উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করছি।'

কর্তৃপক্ষ যা করছে, তা আইনগত বৈধ হলেও এটি একটি অনৈতিক অনুশীলন বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'কারণ এটি মানুষকে উন্মুক্ত জায়গায় প্রবেশের অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে।'

ডিএসসিসির ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. এনামুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, 'এই সিদ্ধান্ত সিটি করপোরেশন নিয়েছে। আমার কিছু বলার নেই। তবে, বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং। কারণ, ভাসমান মানুষসহ অন্যরা পার্কটিকে ময়লা করে ফেলে। তাই, এটি যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছিল।'

মূলত উজ্জ্বল দিকে পার্কটি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। কারণ প্রাঙ্গণগুলো পরিষ্কার এবং পরিবেশটি দর্শকদের জন্য মনোরম।

যোগাযোগ করা হলে অলি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ইজারাদার মো. অলি উল্লাহ জানান, ২০২১ সালের ২৬ নভেম্বর এক বছরের জন্য পার্কটি লিজে নিয়েছেন তারা।

তারা এটি ২০ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছেন এবং ইতোমধ্যে কিছু রাইড স্থাপন করেছেন বলেও জানান তিনি। ডিএসসিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কোনো দর্শনার্থীর কাছ থেকে তারা ১০ টাকার বেশি নিতে পারবে না।

অলি উল্লাহ বলেন, 'দর্শনার্থীর সংখ্যা এখনো অনেক কম। কারণ টিকিট ব্যবস্থার কারণে অনেকেই পার্কে প্রবেশ করেন না। তবে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০০ জন দর্শনার্থী পার্কে আসেন।'

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেসব স্থানে রাইড ও খেলার সরঞ্জাম রয়েছে, সেগুলোর জন্যই সিটি করপোরেশন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কলাবাগানের মতো আরও কয়েকটি জায়গায়ও আমরা রাইড স্থাপন করেছি। যেখানেও সামনে আমরা টিকিট ব্যবস্থা চালু করব।'

'শহীদ মতিউর পার্কটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমাদের কর্মী নেই। তাই আমরা পার্কটি ইজারা দিয়েছি', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
road accidents death in Bangladesh April

Road accidents killed 583 in April: Jatri Kalyan Samity

Bangladesh Jatri Kalyan Samity (BJKS), a passenger welfare platform, said that a total of 583 people were killed and 1,202 injured in 567 road accidents across the country in the month of April, citing media reports

5h ago