দেশে দেশে নববর্ষের সর্বজনীন আবেদন

মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে চালু হয় বাংলা বর্ষপঞ্জি। তখন হিজরি সন অনুযায়ী কৃষকের কাছ থেকে বার্ষিক খাজনা সংগ্রহ করা হতো। হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা ফসল উৎপাদনের সঙ্গে মিলত না। ফলে অনেক কৃষকদের অসময়ে খাজনা দিতে গিয়ে বিপদে পড়তে হতো। এই অসুবিধার কথা বুঝতে পেরে সম্রাট আকবর প্রচলিত ক্যালেন্ডার সংস্কার করেন। আকবরের নির্দেশে, রাজজ্যোতিষী ফতেহউল্লাহ শিরাজী ফসল কাটার মৌসুমের সঙ্গে চন্দ্র মাসের সামঞ্জস্য রেখে নতুন ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ছবি: প্রবীর দাশ

মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে চালু হয় বাংলা বর্ষপঞ্জি। তখন হিজরি সন অনুযায়ী কৃষকের কাছ থেকে বার্ষিক খাজনা সংগ্রহ করা হতো। হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা ফসল উৎপাদনের সঙ্গে মিলত না। ফলে অনেক কৃষকদের অসময়ে খাজনা দিতে গিয়ে বিপদে পড়তে হতো। এই অসুবিধার কথা বুঝতে পেরে সম্রাট আকবর প্রচলিত ক্যালেন্ডার সংস্কার করেন। আকবরের নির্দেশে, রাজজ্যোতিষী ফতেহউল্লাহ শিরাজী ফসল কাটার মৌসুমের সঙ্গে চন্দ্র মাসের সামঞ্জস্য রেখে নতুন ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেন।

বাংলা একাডেমি বেশ কিছু সংশোধন আনার পর ১৯৬৬ সাল থেকে বঙ্গাব্দের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের অনুযায়ী প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল পালিত হয়ে আসছে।

পান্তা ইলিশ, বৈশাখী মেলা আর মঙ্গল শোভাযাত্রার বাইরেও যে এই উৎসব যে আরও অনেক বিস্তৃত, তা আমরা অনেকেই তেমন একটা জানি না। এই যেমন: দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক অঞ্চলে, এমনকি আমাদের দেশেও অনেক সম্প্রদায় ফসল তোলার এই মৌসুমে উৎসব আনন্দে উদযাপন করে।

প্রতি বছর বৈশাখের এই সময়টাতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীরাও তিন দিনব্যাপী বৈসাবি উৎসব করে। ত্রিপুরাদের বৈসু; মারমাদের সাংগ্রাই, ম্রোদের সাঙ্করান, কায়াংদের সাঙ্করান, খুমিদের সাঙ্করাই; এবং চাকমাদের বিজু এবং তঞ্চঙ্গ্যাদের বিসু- এমন বেশ কয়েকটি স্বতন্ত্র উৎসবের নামের সংক্ষিপ্ত রূপ হলো এই বৈসাবি।

ভিন্ন ভিন্ন নৃগোষ্ঠীর বৈসাবি উদযাপনে কিছু ভিন্নতাও আছে। চাকমারা নববর্ষের আশীর্বাদ পেতে উৎসবের প্রথম দিন ভোরবেলা নদী ও হ্রদে ফুল দিয়ে 'ফুলবিজু' উদযাপন করে। আর চৈত্রের শেষ দিনে 'মুলবিজু'তে পাজনের সুগন্ধে ভরে ওঠে পাহাড়গুলো। পাজন হলো ২০টিরও বেশি সবজি দিয়ে রান্না করা একটি সুস্বাদু খাবার। উৎসবের শেষ দিন অর্থাৎ নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে বলা হয় 'গজ্যা পজ্যা দিন'; এই দিনে নতুন বছরে সবার জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রার্থনা করা হয়।

ত্রিপুরা সম্প্রদায় বৈসুকে কয়েকটি ভাগে পালন করে: হরিবৈসু, যা অনেকটা ফুলবিজুর মতোই; বিসিমা; এবং বিসিকাতাল বা নতুন বছর। মারমা সম্প্রদায়ও তিন দিনে এই অনুষ্ঠান উদযাপন করে, যার শুরু হয় বৈশাখের প্রথম দিনে সাংগ্রাই উদযাপনের মাধ্যমে। এরপরের দুইদিন হলো সাংগ্রাই আইকা এবং সাংগ্রাই আতাদা। পুরোনো সব পাপ মুছে ফেলতে এবং নতুন উদ্দীপনায় বছর শুরু করতে মারমা জনগোষ্ঠীর সবাই পানিখেলায় মেতে ওঠে। উৎসবের আরেক অনুষঙ্গ হিসেবে থাকে ঐতিহ্যবাহী পিঠা সাংগ্রাইমু।

উদযাপনে বৈচিত্র্য থাকলেও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোর মাঝে একটি মিল খুব প্রকট, আর তা হলো ঘটা করে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো।

ঘটনাক্রমে, ভারতে শিখ সম্প্রদায় প্রতি ৩৬ বছর পরপর এই ১৩ ও ১৪ এপ্রিল তারিখেই ফসল কাটার ঐতিহ্যবাহী উৎসব 'বৈশাখী' উদযাপন করে। দিনটি পড়ে শিখ সম্প্রদায়ের অনুসরণ করা নানকশাহী ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় মাস বৈশাখে। তবে কৃষকেরা 'নতুন বছর' শুরু করেন এই ফসল কাটার মাধ্যমেই। এই উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো 'আওয়াত পাউনি', যেখানে ঢোলের তালে তালে কৃষকেরা ফসল সংগ্রহ করেন। দিনটির ধর্মীয় তাৎপর্যও আছে। এই দিনটি ১৬৯৯ সালে শিখদের তৎকালীন ধর্মগুরু গোবিন্দ সিং কর্তৃক খালসা পন্থ গঠনের স্মৃতি হয়ে আছে। নগর কীর্তন নামে দীর্ঘ শোভাযাত্রাও বের হয়। বাংলাদেশে যেমন নববর্ষ উদযাপনে লাল আর সাদা রঙ অপরিহার্য তেমনি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দারা এই দিনে হলুদ ও কমলা পরিধান করে। উদযাপনের মধ্যে রয়েছে প্রার্থনা, ব্যাপ্টিজম, ভাংড়া, গিদ্ধা-সহ আরও নানা কিছু।

দক্ষিণ ভারতের কেরালা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পালিত হয় মালালায়াম নববর্ষ বিসু। প্রধান রীতি হলো বিসুক্কানি (যার আক্ষরিক অর্থ বিসু-তে প্রথম যা দেখা যায়), যা সাজানো হয় কননা ফুল, পান, প্রদীপ, চাল, লেবু, শসা, কাঁঠাল, টাকা এবং ভগবান বিষ্ণুর মূর্তি দিয়ে। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা খুব ভোরে উঠে ঘর সাজিয়ে তোলেন। আর পরিবারের সদস্যরা উৎসবের ভোরে জেগে উঠে এই 'শুভ দৃষ্টি'র আলো দেখতে পায়। এই সম্প্রদায়ের একটি দৃঢ় বিশ্বাস যে এই দিনে শুভ কিছু দেখা মানে বাকি বছরটাও ভালো যাওয়া। বিসু উপলক্ষে আয়োজিত ভোজ 'সাধ্য'তে পান পাতায় নানা রকম খাবার পরিবেশন করা হয়।

তামিল ভাষায় 'পুথান্ডু ভাজথুক্কল' কথাটির অর্থ হলো 'শুভ নববর্ষ'। নববর্ষের সকাল শুরু হয় 'কান্নি'র মাধ্যমে, যা বিসুক্কানির মতোই একটি প্রথা, এবং এর ভোজে সবজির প্রাধান্য থাকে। আরও দক্ষিণে শ্রীলঙ্কাতে সিংহলি নববর্ষ 'আলুথ আভ্রুদু'ও নানা দিক দিয়ে পুথান্ডুর মতোই একটি উৎসব।

ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য আসামে বছরের ফসলের তিনটি মৌসুমকে উপলক্ষ্য করে প্রতি বছর তিনবার 'বিহু' উদযাপিত হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় বিহু হলো সপ্তাহব্যাপী চলা রোঙ্গালি বা বোহাগ বিহু; কাকতালীয়ভাবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বড় উৎসবের মতো এটিও বছরের এই সময়েই অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় অসমীয়া জনগোষ্ঠী বিহুগীত গায়, লোকনৃত্য পরিবেশন করে এবং পিঠা ও লাড়ু খায়। একইভাবে, বিহারের বাসিন্দারা প্রতি বছর দুবার করে বৈশাখ উদযাপন করে; প্রথমটি এপ্রিলে এবং তারপর নভেম্বরে।

বৈচিত্র্যময় উৎসবের দেশ নেপালে, অসংখ্য উৎসবের মাঝে অন্যতম হলো নববর্ষ। নেপালের নববর্ষ অর্থাৎ বিক্রম সম্বত ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটি সাধারণত এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে পড়ে। নববর্ষ উপলক্ষে ভক্তপুরে বিস্কেত যাত্রা (বা বিস্কেতের উৎসব) অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবে মহাভারতের যুদ্ধকে স্মরণ করা হয়। এই দিনটিতে পাহাড়ের কোলের ছোট্ট শহর ভক্তপুরে নিচু অংশের বাসিন্দা বনাম উঁচু অংশের বাসিন্দাদের মধ্যে দড়ি টানাটানির খেলা হয়। স্থানীয়দের বিশ্বাস, বিজয়ী অংশের উপর নতুন বছরে আশীর্বাদ বর্ষিত হবে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়টা নববর্ষ এবং জল উৎসবের মৌসুম। থাইল্যান্ডে 'সোংক্রান' উদযাপিত হয়, আর লাওসে এই উৎসবটির নাম 'বাউন পাই মাই'। অন্যদিকে মিয়ানমারে একে বলে 'থিংইয়ান' আর কম্বোডিয়ায় 'চোল চাম থমে' নামে পরিচিত।

থাই নববর্ষের সূচনা হয় তিনদিন ব্যাপী সোংক্রান উদযাপনের মাধ্যমে এবং এ সময় দেশটিতে তিন দিনের জাতীয় ছুটি (১৩ থেকে ১৫ এপ্রিল) থাকে। দিন তিনটি হলো- সংক্রান (উৎসবের দিন), ওয়ান নাও (শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের দিন), এবং ওয়ান পায়াওয়ান (সৌভাগ্যের দিন)। এই উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো ব্যাংককের জনপ্রিয় এলাকা খাও সান রোডে উদযাপিত জল উৎসব। উৎসবের এই সময়টায় ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে সবাই মিলে জলের উৎসবে মেতে ওঠা শুধু থাইল্যান্ডেই নয়, মিয়ানমার এবং লাওসেও খুব জনপ্রিয় একটি ব্যাপার।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরেক দেশ কম্বোডিয়ার ঐতিহ্যবাহী জল উৎসব 'বন ওম টুক' প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো এপ্রিলে না হয়ে বছরের শেষদিকে নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়। পানি নিয়ে এই উন্মত্ত খেলা বিদেশি পর্যটকদের জন্য এক দুর্দান্ত আকর্ষণ।

লাওসের নববর্ষ উদযাপন অনেকটাই প্রতিবেশী থাইল্যান্ডের মতো। তিনটি দিন- সাংখান লুয়াং (পুরানো বছরের শেষ দিন), সাংখান নাও (কোনো বছরেরই অংশ নয়) এবং সাংখান কেউন পি মাই (নতুন বছরের প্রথম দিন) নামে পরিচিত। স্থানীয়রা তাদের সবচেয়ে ভালো রেশমি পোশাক পরিধান করে এবং বাচি উদযাপন করে। অন্য দেশগুলোর মতো, এখানেও শোভাযাত্রা, মেলা, নানা রকম রীতি, সঙ্গীত এবং নৃত্যের আয়োজন হয়। কিন্তু এর বাইরেও, মিস নিউ ইয়ার (নাং সংখান) নামে একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।

যে দেশেই বসবাস হোক না কেন, বছরের এই সময়টায় এসে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক জাতিগোষ্ঠীই আমাদের মতো করে একটি বছর শেষ করে এবং নতুন একটি বছরকে বরণ করে নেয়।

অনুবাদ: আনজিলা জেরিন আনজুম

Comments

The Daily Star  | English

Protesters stage sit-in near Bangabhaban demanding president's resignation

They want Shahabuddin to step down because of his contradictory remarks about Hasina's resignation

47m ago